গাভাস্কার যেদিন নিজেই আউট হয়ে যেতে চেয়েছিলেন!

>

ক্রিকেট বিশ্বকাপ দুয়ারে দাঁড়িয়ে। চলছে রোমাঞ্চমাখা অপেক্ষা, চলছে স্মৃতিচারণাও। ফিরে দেখা বিশ্বকাপ শিরোনামে প্রথম আলো অনলাইনের নতুন ধারাবাহিক। প্রথম পর্বে থাকছে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে খেলা সুনীল গাভাস্কারের ‘অদ্ভুত’ সেই ইনিংসের গল্প। লিখেছেন সঞ্জয় বসাক

টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সফল ওপেনার তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিখ্যাত ‘পেস চতুষ্টয়’সহ আরও অনেক কিংবদন্তি বোলারদের সময়ে খেলে ১০ হাজারের বেশি রান। সাদা পোশাকের ক্রিকেটে তাঁর সাফল্যের প্রমাণ। তবে বিশ্বকাপে এসেও যে এমন ‘টেস্ট ম্যাচ’ খেলবেন সুনীল গাভাস্কার, সেটি বোধ হয় ভাবতে পারেননি কেউই। বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম ম্যাচেই গাভাস্কার এমন এক ইনিংস খেলেছিলেন, পারলে নিজে ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে সেই ঘটনা চিরতরে মুছে ফেলেন!

সুনীল গাভাস্কার
সুনীল গাভাস্কার

মূল গল্পে যাওয়ার আগে একটু প্রেক্ষাপট বলে নেওয়া দরকার। টেস্ট ক্রিকেটের প্রায় এক শ বছর পর শুরু হয় ওয়ানডে। ১৯৭১ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচের চার বছরের মাথায় শুরু হয়ে গেল বিশ্বকাপ। ১৯৭৫ বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার আগে ইংল্যান্ড ছাড়া অন্য দলগুলোর তাই ওয়ানডে ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা বলতে গেলে ছিলই না। ৭ জুন লর্ডসে বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম ম্যাচ খেলার সৌভাগ্য হয়েছিল ভারতের। কিন্তু এর আগে তারা ওয়ানডে খেলতে পেরেছিলই মোটে দুটি।

দারুণ আবহাওয়া ও ব্যাটিং উইকেটে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামে ইংল্যান্ড। ওপেনার ডেনিস অ্যামিসের ১৪৭ বলে ১৩৭ রানের দুর্দান্ত ইনিংসে ভর করে ৬০ ওভারে ৪ উইকেটে তোলে ৩৩৪ রান। জয়ের জন্য লক্ষ্যটা একটু বেশি হয়ে গেলেও ভারতের হাল ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ ছিল না। তাদের সবচেয়ে বড় ভরসার নাম ছিলেন সুনীল গাভাস্কার।

সেই গাভাস্কারই এমন ব্যাটিং করলেন, যেটি নিয়ে কথা উঠলে লিটল মাস্টার নিজেই লজ্জায় লাল হয়ে যান। শুরুতে মনে হচ্ছিল, নতুন বলের সুইং কাটিয়ে দেওয়ার কৌশল নিয়ে মাঠে নেমেছেন বলে কিছুটা ধীরগতিতে ব্যাট করছেন। কিন্তু সময় গড়াতে থাকলেও গাভাস্কারের ব্যাট চলতে লাগল সেই শম্বুক গতিতেই। শেষ পর্যন্ত পুরো ৬০ ওভার উইকেটে থেকে গাভাস্কারের রান দাঁড়াল ১৭৪ বলে অপরাজিত ৩৬! গাভাস্কারের এমন মন্থর ব্যাটিংয়ের ছাপ পড়ল ভারতের স্কোরকার্ডেও। মাত্র ৩ উইকেট হারালেও ৬০ ওভারে তাদের সংগ্রহ দাঁড়াল ১৩২ রান! হাতে ৭ উইকেট রেখেও ২০২ রানের বিশাল পরাজয়।

সব ছাপিয়ে আলোচনায় গাভাস্কারের এই ইনিংস। ভারত এর আগে ওয়ানডে তেমন খেলেনি, এই যুক্তিতেও গাভাস্কারকে আড়াল করা যায়নি। ওই ম্যাচেই তো ইংল্যান্ড ওয়ানডে ব্যাটিংটা দেখিয়ে দিয়েছিল। এর মধ্যে ক্রিস ওল্ডই তো এখনকার ‘আন্দ্রে রাসেল’টাইপ ইনিংস খেলেছিলেন ৩০ বলে ৫১ রান করেন।

ম্যাচ শেষে স্বাভাবিকভাবেই শুরু হলো তাঁর সমালোচনা। সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার ডেনিস কম্পটন বললেন, ‘ভারতীয়রা এ রকম করুণ ব্যাটিং করবে, এটা কেউই আশা করেনি। আর এর মূল দায়টা নিতে হবে গাভাস্কারকেই।’ কিন্তু অমন আশ্চর্য মন্থর ব্যাটিংয়ের রহস্য কী? ম্যাচ শেষে এক বিবৃতিতে ভারতীয় দলের ম্যানেজার জি এস রামচাঁদ বললেন, ‘ইংল্যান্ডের দেওয়া লক্ষ্যকে অনতিক্রম্য মনে করেছিলেন গাভাস্কার, তাই পরের ম্যাচগুলোর জন্য ব্যাটিং অনুশীলন করে নিয়েছেন এই ম্যাচে।’ বলাই বাহুল্য, রামচাঁদের এই খোঁড়া যুক্তি মন ভরাতে পারেনি কারও।

তবে দুই দিন পরই রামচাঁদের বিবৃতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। ডেইলি এক্সপ্রেসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রীতিমতো ধুয়ে দিলেন গাভাস্কারকে, ‘আমার দেখা সবচেয়ে লজ্জাজনক ও স্বার্থপর ইনিংস ছিল সেদিনের ইনিংসটি। সে (গাভাস্কার) আমাকে এসে বলেছিল, উইকেট শট খেলার জন্য খুব ধীর ছিল। কিন্তু ঠিক আগের ইনিংসেই ইংল্যান্ড ৩৩৪ রান করে যাওয়ার পরে এই যুক্তি কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যায় না। পুরো দল এ ঘটনায় বিব্রত। আমাদের জাতীয় মর্যাদা এভাবে ধুলায় মিশে যেতে পারে না।’

গুঞ্জন আছে, দল নির্বাচন পছন্দ হয়নি বলেই প্রতিবাদস্বরূপ এমন ব্যাটিং করেছিলেন গাভাস্কার। আবার আরেক পক্ষের দাবি, শ্রীনিবাস ভেংকটরাঘবনকে অধিনায়ক বানানোয় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি এ কাজ করেছেন।

কিন্তু যাঁর ইনিংস নিয়ে এত সমালোচনা, সেই গাভাস্কারের কী মন্তব্য? সে সময় গাভাস্কার মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছিলেন। তবে বহু বছর পরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, এটি ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ইনিংস। সেদিন ফর্মে ছিলেন না বলেও দাবি তাঁর, ‘এটা এমন একটা ইনিংস ছিল, যার কোনো ব্যাখ্যা আজও আমার কাছে নেই। ইনিংসের শুরুর দিকে এমন কিছু শট খেলেছিলাম, যেগুলো আমি দ্বিতীয়বার চোখেও দেখতে চাই না! ওই ইনিংসের পর আমি একপ্রকার মানসিক চাপে পড়ে গিয়েছিলাম।’

ইনিংসটি খেলার পথে গাভাস্কার কতটা চাপে ছিলেন, সেটি পরিষ্কার হয় তাঁর অন্য একটি কথায়, ‘ওই ইনিংসে বেশ কয়েকবার এমন হয়েছে, আমি স্টাম্প ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, যেন বোলার আমাকে বোল্ড করতে পারে!’

ওই ম্যাচে ৪৬ বলে ২২ রান করা অংশুমান গায়কোয়াড়ের ভাষ্য, গাভাস্কারের এ রকম ব্যাটিং ভারতীয় দলকেই বিস্মিত করে দিয়েছিল, ‘তাঁর ব্যাটিংয়ের ধরন দেখে আমরা সবাই অবাক হয়েছিলাম। তিনি কেন এমন ব্যাটিং করেছিলেন, সেটা আমাদের পক্ষে বলা মুশকিল। যখন তাঁর সঙ্গে ব্যাট করছিলাম, দলের বা তাঁর নিজের পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো প্রকার আলোচনা হয়নি। আমি তাঁর থেকে এত জুনিয়র ছিলাম, তাঁকে কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি বরং আমার নিজের সামর্থ্য প্রমাণেই বেশি ব্যস্ত ছিলাম।’ ড্রেসিংরুমে ফেরার পর গাভাস্কারকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি বলেও দাবি গায়কোয়াড়ের।

বিশ্বকাপ থেকে খালি হাতে দেশে ফেরার পর ম্যানেজারের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গাভাস্কারকে তলব করেছিল ভারতীয় বোর্ড। ম্যানেজারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, তাঁর এই ইনিংস দলের জুনিয়রদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। তবে শেষ পর্যন্ত বোর্ড গাভাস্কারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

সেই বিশ্বকাপ ছাড়াও আরও তিনটি বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিলেন গাভাস্কার, ছিলেন ভারতের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্যও। কিন্তু সব ছাপিয়ে বিশ্বকাপ আর গাভাস্কার শব্দ দুটি এলেই অবধারিতভাবে চলে আসে তাঁর এই ইনিংসের কথা।

ক্রিকেটের সর্বকালের স্মরণীয়-বরণীয় ব্যাটসম্যানদের একজন, তবু তাঁকেও কসুর করবে না ইতিহাস!