৩৬ বছরের ছোট্ট জীবন। সেটিও শেষ হয়ে গেছে ১৯১৪ সালে। তারপরও ক্রিকেট ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন তিনি। নইলে কি আর মৃত্যুর এত বছর পরও কাউকে নিয়ে কেউ লিখতে বসে!
টেস্ট খেলেছেন মাত্র ৮টি। তাতে ৪৬.৩০ গড়ে ৬০২ রান। এ আর বলার মতো কি! পরের ৭টি টেস্ট এখানে আসলে শুধুই ‘সংখ্যা’। শুধু অভিষেক টেস্টটা খেলেই যদি থেমে যেতেন, তাতেও সমস্যা হতো না। অমর হয়েই থাকতেন আর.ই. ফস্টার। ১৯০৩ সালের ডিসেম্বরে সিডনিতে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো ব্যাটিং করতে নেমেই যে সেঞ্চুরিটি করেছিলেন, সেটিই আসলে নিশ্চিত করে দিয়েছে তাঁর অমরত্ব।
অভিষেকে সেঞ্চুরি করেছিলেন ভালো কথা, কিন্তু এ নিয়ে এত কাব্য করার কী আছে? আরও কতজনই তো তা করেছেন। তা করেছেন। তবে আর. ই. ফস্টারের বাকি সবার চেয়ে আলাদা হয়ে যাওয়ার কারণ, শুধু সেঞ্চুরি করেই তিনি থামেননি। সেঞ্চুরিটিকে রূপ দিয়েছেন ডাবলে। অবশ্যই বড় কীর্তি, তবে এটিও তো অনন্য নয়। এই কীর্তির পুনরাবৃত্তি হয়েছে আরও ছয়জনের ব্যাটে (লরেন্স রো, ব্রেন্ডন কুরুপ্পু, ম্যাথু সিনক্লেয়ার, জ্যাক রুডলফ, কাইল মায়ার্স ও ডেভন কনওয়ে)। তাহলে টেস্টে তাঁর একমাত্র সেঞ্চুরিটিই কীভাবে নিশ্চিত করে দিল ফস্টারের অমরত্ব?
ডাবল সেঞ্চুরি করেও যে থামেননি ফস্টার। সেটিকে প্রায় রূপ দিয়ে ফেলেছিলেন ট্রিপলে। মাত্র ১৩ রানের জন্য যা পারেননি। তাঁর ওই ২৮৭ তখন টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ স্কোর। যে রেকর্ড ভেঙেছে প্রায় ২৭ বছর পর, অ্যান্ডি স্যান্ডহামের ব্যাট থেকে আসা টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরিতে।
ওই ২৮৭-তে গড়া ফস্টারের আরও দুটি রেকর্ড কিন্তু এখনো অম্লান। একটি টেস্ট অভিষেকে সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ড। যে রেকর্ডটি এত বছরেও ভাঙার সম্ভাবনা জাগেনি কখনো। সবচেয়ে কাছাকাছি এসেছিলেন জ্যাক রুডলফ। ৬৫ রান দূরত্বে থাকাটাকে যদি ‘কাছাকাছি’ বলা যায়! দক্ষিণ আফ্রিকান বাঁহাতির অপরাজিত ২২২ বাংলাদেশের বিপক্ষে চট্টগ্রামে। ফস্টারের ওই রেকর্ডের শতবর্ষ পূর্তির বছরে।
অন্য যে রেকর্ড, সেটি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ইংল্যান্ডের কোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ টেস্ট ইনিংস। ১১২ বছর যা ইংল্যান্ডের সীমানা ছাড়িয়ে অস্ট্রেলিয়ায় যেকোনো বিদেশি ব্যাটসম্যানেরই সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড হয়ে ছিল। ২০১৫ সালের নভেম্বরে পার্থে ২৯০ রানের এক ইনিংস খেলে রস টেলর ফস্টারের রেকর্ডটির মহিমা একটু কমিয়ে দেন।
ক্রিকেট ও ফুটবল দুই খেলার ইংল্যান্ড জাতীয় দলেরই অধিনায়কত্ব করার রেকর্ডটি ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড়ের মতোই অবিনশ্বর।
টেস্ট অভিষেকে সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ডটি এত বছর ভাঙেনি বলে কোনো দিনই ভাঙবে না ঘোষণা দিয়ে দেওয়ায় একটু ঝুঁকি আছে। হয়তো নেই-ও। ফস্টারের আরেকটি রেকর্ড প্রসঙ্গে এমন হয়তো-টয়তো বলার প্রয়োজনই পড়ছে না। ক্রিকেট ও ফুটবল দুই খেলার ইংল্যান্ড জাতীয় দলেরই অধিনায়কত্ব করার রেকর্ডটি ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড়ের মতোই অবিনশ্বর।
এই লেখা মূলত ক্রিকেটার আর. ই. ফস্টারকে নিয়ে, ফুটবলের অংশটা তাই আগে সেরে নিই। ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে কয়টি ম্যাচ খেলেছেন, এ নিয়ে একটু তর্ক আছে। বেশির ভাগ লেখাতেই পাচ্ছি ৫টি, কোথাও কোথাও আবার ৬টি। ওয়েলসের বিপক্ষে ৩টি ম্যাচ নিয়ে কোনো তর্ক নেই, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ১টি করে ম্যাচ খেলার বিষয়টিও একই রকম তর্কাতীত।
যে ম্যাচটি নিয়ে সংশয়, সেটিই আসলে ফুটবলার ফস্টারের সবচেয়ে বেশি কীর্তিধন্য। ১৯০১ সালে ইংল্যান্ড ও জার্মানির মধ্যকার প্রথম ম্যাচ। হোয়াইট হার্ট লেনের সেই ম্যাচে ইংল্যান্ড জিতেছিল ১২-০ গোলের অবিশ্বাস্য ব্যবধানে। ফস্টার একাই করেছিলেন ৬ গোল। ইতিহাসে এখনো এটি ইংল্যান্ড-জার্মানি ম্যাচ হিসাবেই লেখা আছে। তবে এটির অফিশিয়াল আন্তর্জাতিক ম্যাচের স্বীকৃতি মেলেনি। ১৯০৮ সালে অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি সফরের আগে কোনো বিদেশি দলের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের কোনো ম্যাচেরই নয়।
ক্রিকেটার ফস্টারে ফিরি। অভিষেক ইনিংসে করেছিলেন ২৮৭, আর বাকি ১৩ ইনিংস মিলিয়ে ৩১৫ রান। তারপরও আর. ই. ফস্টারের টেস্ট ক্যারিয়ার মাত্র ৮ টেস্টের হতো না, যদি স্টকব্রোকার পেশার কারণে ক্রিকেট তাঁর কাছে সেকেন্ড প্রায়োরিটি না হয়ে যেত। ১৯০৩-০৪ মৌসুমের অস্ট্রেলিয়া সফরের পর আবার টেস্ট খেলেন ১৯০৭ সালে।
সেই প্রত্যাবর্তন দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে অধিনায়ক হিসাবে। টেস্টে ফস্টারের পঞ্চাশ পেরোনো আর একমাত্র ইনিংসটি ওভালে সেই সিরিজের শেষ টেস্টে, যেটি হয়ে থাকে তাঁর ক্যারিয়ারেরই শেষ টেস্ট (অস্ট্রেলিয়ায় দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে করেছিলেন অপরাজিত ৪৯, চোট পেয়ে অবসর নিতে বাধ্য হওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংস ব্যাটিংই করতে পারেননি)। সে বছরের শেষে অস্ট্রেলিয়া সফরেও তাঁকে অধিনায়ক করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ব্যবসাই ফস্টারের কাছে বেশি প্রাধান্য পায়।
এই যে ফস্টার-ফস্টার লিখছি, গত শতাব্দীর শুরুর দিকে উস্টারশায়ারে শুধু ‘ফস্টার’ বলে কিন্তু আর. ই. ফস্টারকে চেনানো মুশকিল হতো। ফস্টাররা সাত ভাইই তখন উস্টারশায়ারে খেলেন। উস্টারশায়ারকে তাই মজা করে অনেকে তখন ‘ফস্টারশায়ার’ও বলত। সাত ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয়জনই সবচেয়ে বিখ্যাত। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে দুবার এক ম্যাচে খেলেছেন ফস্টারদের চার ভাই, তবে রেজিনাল্ড এরস্কাইন ফস্টার ছাড়া আর কোনো ভাই টেস্ট খেলতে পারেননি।
স্পোর্টিং ফ্যামিলি বলতে যা বোঝায়, ফস্টাররা ছিলেন তাই। বাবা হেনরি ফস্টার ক্রিকেটটা মোটামুটি ভালোই খেলতেন, গলফও। অকাল মৃত এক বোন ছাড়া বাকি ১০ ভাইবোনই ছিলেন খেলার পাগল। দুই বোন ইংল্যান্ডের পক্ষে গলফ খেলেছেন, টেনিসও ভালো খেলতেন। সাত ভাই-ই পড়েছেন মালভার্ন স্কুলে। বাবা হেনরি ফস্টার যেখানে হাউস মাস্টার হিসাবে কাজ করেছেন, মা ছিলেন হাউস মিসট্রেস।
ফস্টার ভাইদের নামে নামাঙ্কিত উস্টারশায়ারের নিউ রোড মাঠের একটা স্ট্যান্ড। ২০০৫ সালের ইংল্যান্ড সফরে উস্টারশায়ারের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রস্তুতি ম্যাচ কাভার করতে এই মাঠে পা রাখার পর আমার চোখ যা প্রথমেই খুঁজে বের করেছিল। ইংল্যান্ডে প্রায় প্রতিটি কাউন্টিরই সমৃদ্ধ ক্রিকেট লাইব্রেরি আছে। উস্টারশায়ারও লাইব্রেরিটিও খুব ভালো। কিন্তু সেখানে গিয়ে একটু হতাশই হলাম। উস্টারশায়ারের ইতিহাস নিয়ে একাধিক বই আছে, পেপার কাটিংয়ের তো ছড়াছড়ি, ফাইলের পর ফাইল। ফস্টার ভাইদের নিয়েও অনেক কিছু পেলাম।
কিন্তু যা খুঁজছিলাম, সেটি পেলাম না। ফস্টারদের নিয়ে কোনো বই নেই। বারবার এ নিয়ে জিজ্ঞেস করায় উস্টারশায়ারের অনেক ইতিহাসের সাক্ষী লাইব্রেরিয়ান বিরক্ত হওয়ার বদলে একটু যেন লজ্জাই পেয়েছিলেন। তাঁকে সেই লজ্জা থেকে মুক্তি দিয়েছেন অ্যান্থনি কলিন্স নামে এক ভদ্রলোক। ফস্টারদের নিয়ে কোনো বই নেই দেখে আমারই মতো অবাক কলিন্স নিজেই লিখে ফেলেছেন তা। ২০১৮ সালে বেরিয়েছে ‘ফস্টারশায়ার: দ্য স্টোরি অব আ গ্রেট মালভার্ন ফ্যামিলি।’
‘টিপ’ ফস্টার নামে বেশি পরিচিত আর. ই. ফস্টারকে নিয়ে, ফস্টারদের ওই বিখ্যাত ক্রীড়া পরিবার নিয়ে যেকোনো দিনই লেখা যায়। আজ লেখার অবশ্য সুনির্দিষ্ট একটা কারণ আছে। ১৮৭৮ সালের এই দিনেই জন্ম হয়েছিল ‘টিপ’ ফস্টারের। এক সময়কার প্রাণঘাতী রোগ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে অকালে অনন্তলোকে চলে যাওয়া ফস্টারের কাছে পৌছুঁবে কি না জানি না, তারপরও বলতে কী সমস্যা!
শুভ জন্মদিন, মিস্টার ফস্টার!