কোহলিকে সরিয়ে রোহিতের ভারতের ‘মসনদে’ ওঠার ভেতরের গল্প
তিন মাসও হয়নি বিরাট কোহলি জানিয়েছিলেন, তিনি ভারতের ওয়ানডে ও টেস্ট দুই দলেরই নেতৃত্ব দিতে চান। এর মধ্যে টি-টোয়েন্টির অধিনায়কত্ব স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেওয়া কোহলির জায়গায় রোহিত শর্মাকে অধিনায়ক করা হলো। এরপর দিন দুয়েক আগে হঠাৎ খুবই অনাড়ম্বরে রোহিতকে ওয়ানডে দলের নেতৃত্বও দিয়ে দিল ভারতের ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই)। কীভাবে কী হলো, সেটির ভেতরের খবর গতকাল তুলে ধরার চেষ্টা করেছে ভারতের দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
২০২৩ সালে নিজেদের মাটিতে ওয়ানডে বিশ্বকাপ আয়োজন করবে ভারত, তার আগে ওয়ানডের অধিনায়কত্ব ছাড়ার ইচ্ছা কোহলির ছিল না। কিন্তু বিসিসিআইয়ের মনে হয়েছে, সাদা বলের ক্রিকেটে (টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে) নেতৃত্বের খোলনলচে বদলে ফেলা দরকার। কিন্তু সেই বদলের খবরটা এল কী অদ্ভুতভাবে!
দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের টেস্ট দল ঘোষণা দেওয়া বিবৃতির শেষে গিয়ে দুই দিন আগে ছোট্ট একটা বাক্যে বিসিসিআই লিখে দিল, ‘এর পর থেকে ভারতের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক হিসেবে জনাব রোহিত শর্মার নাম ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সর্বভারতীয় নির্বাচক কমিটি।’
এর পাশাপাশি একই বিবৃতিতে ভারতের টেস্ট দলেও কোহলির পাশে সহ-অধিনায়ক হিসেবে রোহিতের নাম ঘোষণা করে বিসিসিআই। এর আগে রোহিতের সহযোগী ছিলেন অজিঙ্কা রাহানে। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে আগে কোহলি অধিনায়ক থাকার সময়ে রোহিতই সহ-অধিনায়ক ছিলেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, বিসিসিআইয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কোহলিকে সরিয়ে রোহিতকে ওয়ানডে অধিনায়ক করার সিদ্ধান্তটা নিয়ে আরও কিছুদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছিল বিসিসিআইয়ের কার্যালয়ে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচকেরাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কেন এই সিদ্ধান্ত, সে ব্যাখ্যায় দুই দিন আগে বিসিসিআই সভাপতি ও ভারতের কিংবদন্তি অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী জানিয়েছিলেন, ‘বিসিসিআই কোহলিকে টি–টোয়েন্টির নেতৃত্ব থেকে সরে না দাঁড়ানোর অনুরোধ করেছিল। কিন্তু সে বিসিসিআইয়ের কথা শোনেনি। নির্বাচকদের মনে হয়েছে সাদা বলের ক্রিকেটে ভিন্ন দুজন অধিনায়ক রাখার প্রয়োজন নেই।’
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে বিসিসিআইয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কণ্ঠেও একই সুরই থাকল, ‘লাল বল আর সাদা বলের ক্রিকেটের দলে পার্থক্যটা একেবারে পরিষ্কার রাখতে চেয়েছে বিসিসিআই। কোনো সংশয় যাতে তৈরি না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে দীর্ঘতম সংস্করণ আর সংক্ষিপ্ততর সংস্করণগুলোর ক্রিকেটের নেতৃত্ব পুরোপুরি আলাদা রাখতে চেয়েছে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তটা নির্বাচকদের হাতে দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা রোহিতকে ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবেও নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
এখানে ঝামেলাটা হলো, টি-টোয়েন্টির অধিনায়কত্ব ছাড়ার সময়ে নিজের সিদ্ধান্তটা কোহলি নিজেই নিয়েছিলেন, ঘোষণাটাও তিনিই দিয়েছেন। টি-টোয়েন্টির অধিনায়কত্ব ছাড়ার সময়ে কোহলি জানিয়েছিলেন, তিনি সে সময়ের ভারত দলের কোচ রবি শাস্ত্রী, বিসিসিআই সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলী ও বিসিসিআই সচিব জয় শাহর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন। এর কিছুদিন আগে আইপিএলের দল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর অধিনায়কত্ব ছাড়াও ছিল কোহলির নিজের সিদ্ধান্ত।
কিন্তু এবার ভারতের ওয়ানডের নেতৃত্বে বদল বিসিসিআইয়ের সিদ্ধান্ত। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, সিদ্ধান্তের আগে কোহলিকে বিসিসিআইয়ের দিক থেকে কিছু জানানোই হয়নি!
বিসিসিআইয়ের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একটা বড় প্রভাব ফেলেছে গত মাসে শেষ হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের পারফরম্যান্স। বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়ে ভারত, এরপরই বিসিসিআই আর কোহলির সুর একইতালে মেলেনি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ভাষ্য, প্রথম সুযোগেই কোহলিকে ওয়ানডে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা ভেবে রেখেছিল বিসিসিআই। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের টেস্ট দল ঘোষণা সেই সুযোগ হয়েই এল।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, কোহলির অবস্থান যে নড়বড়ে হয়ে গেছে, সেটির প্রথম ইঙ্গিত এসেছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে, যখন মহেন্দ্র সিং ধোনিকে বিশ্বকাপের দলের পরামর্শক করে পাঠায় বিসিসিআই। অধিনায়ক হিসেবে আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে জিততে পারেননি কোহলি, সেটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিততে উন্মুখ ভারতীয় বোর্ডকে কিছুটা উদ্বিগ্ন করে রেখেছিল। বোর্ডের ভেতরের সূত্রের কথা উল্লেখ করে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সই কোহলির ভাগ্য লিখে দেওয়ার কথা ছিল। তা-ই হয়েছে।
তবে কোহলি টি-টোয়েন্টির অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আগেই হয়ে গেলেও, সিদ্ধান্তটার কথা যে বিশ্বকাপের আগেই প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছেন কোহলি, সেটি চমকে দিয়েছে বিসিসিআইকে। কোহলি তখন ওয়ানডে ও টেস্টের অধিনায়কত্ব চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা জানিয়েছিলেন, সেটিও বিসিসিআইয়ের নজরে বিশেষভাবে এসেছে। ২০২৩ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ বলে কোহলি এখনই ওয়ানডের অধিনায়কত্ব ছাড়তে চাননি।
কিন্তু টি-টোয়েন্টির অধিনায়কত্ব ছেড়ে কোহলি আসলে ক্ষমতার ভার কিছুটা হারিয়ে ফেলেছিলেন। অধিনায়কত্বে তাঁর ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়েছিলেন বিসিসিআইয়ের হাতে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, একদিক থেকে দেখলে বিসিসিআইয়ের প্রতি কোহলির বার্তাটা তখন এমন ছিল যে—চাইলে আমাকে ওয়ানডের অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দিতে পারেন। গত বুধবার তা-ই করেছে বিসিসিআই।
পেছনে ফিরে দেখলে, ভারতীয় ক্রিকেটে অধিনায়কত্বে থাকা না থাকার সিদ্ধান্ত কখনোই খেলোয়াড়দের তেমন প্রভাব ছিল না। ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জেতার এক বছরের মধ্যেই কপিল দেব অধিনায়কত্ব হারিয়েছিলেন। সুনীল গাভাস্কার অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন ১৯৮৫ বিশ্ব ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর। সৌরভ গাঙ্গুলীর অধিনায়কত্বও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল ভারতের ক্রিকেটের এক জটিল সময়ে। এমনকি তিনটি আইসিসি ইভেন্ট জেতা মহেন্দ্র সিং ধোনিকেও অধিনায়কত্ব ছাড়ার আগে নির্বাচক কমিটি বার্তা দিয়ে রেখেছিল। তখন নির্বাচক কমিটির মনে হয়েছিল, সাদা বলের নেতৃত্বে ধোনির বদলে অন্য কাউকে দরকার। ধোনির হাত থেকে ব্যাটনটা তখন যায় কোহলির হাতে।
কোহলি সম্ভবত ইতিহাসে কান পাতেননি।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বদল হচ্ছে, টেস্টেও রাহানেকে সরিয়ে রোহিতকে সহ-অধিনায়ক করা হয়েছে। ভারতীয় দলে রোহিতের ক্রমবর্ধমান দাপট দেখে মনে হতেই পারে, অধিনায়ক হিসেবে কোহলির দিন শেষের গান শুনছে।
সাদা বলে ভারতের ইতিহাস-সেরা অধিনায়কদের একজনই ছিলেন কোহলি। ৯৫ ওয়ানডেতে ৬৫ জয় তাঁর, জয়ের হার ৭০-এর ওপরে। ৪৫ টি-টোয়েন্টিতে তাঁর অধীনে ভারত জিতেছে ২৭ ম্যাচে। অন্যদিকে কোহলির ‘ডেপুটি’ থাকার সময়েই রোহিত ভারতকে ১০ ওয়ানডে ও ১৯ টি-টোয়েন্টিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ দিয়ে সাদা বলের ক্রিকেটে ভারতের পূর্ণকালীন অধিনায়ক হিসেবে তাঁর শুরু হয়েছে। সেখানে নিউজিল্যান্ডকে ধবলধোলাই-ই করেছে ভারত। এর পাশাপাশি অধিনায়ক হিসেবে রোহিতের দক্ষতার প্রমাণ দেয় আইপিএলে তাঁর জেতা পাঁচ শিরোপাও।
২০১৭ সালে ধোনির কাছ থেকে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ভারতের অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর কোহলি প্রায় সব দেশেই ভারতকে সিরিজ জিতিয়েছেন। কিন্তু আইসিসির টুর্নামেন্ট জিততে পারেননি। সবচেয়ে কাছে গিয়েছিল ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে, সেখানে ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের কাছে হেরে যায় ভারত। কিন্তু এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এসেছে কোহলির অধিনায়কত্বে সবচেয়ে বড় ধাক্কা হয়ে। পাকিস্তানের পর নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে শুরু বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বই পেরোতে পারেনি ভারত।
বিশ্বকাপের পর বিসিসিআই অবশ্য প্রকাশ্যে বিশ্বকাপ-ব্যর্থতাকে সেভাবে গুরুতর কিছু হিসেবে দেখায়নি। ‘একটা খারাপ টুর্নামেন্ট কেটেছে’ বলে বিশ্বকাপে ব্যর্থতাকে আড়াল করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানাচ্ছে, এর পর থেকেই বোর্ড সাদা বলের ক্রিকেটে ভারতকে পুরোপুরি নতুন অধিনায়কের অধীনে নেওয়ার ব্যাপারে কাজ শুরু করে।
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে পরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আর ১২ মাসও বাকি নেই। এর এক বছর পর ভারতের মাটিতে ওয়ানডে বিশ্বকাপ। রোহিতকে এর মধ্যে দল গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ ও সময় দিতে চায় বিসিসিআই।
কোহলির বাজে ফর্মও ভারতীয় দলে তাঁর দাপট কমে যাওয়ার একটা কারণ। গত দুই বছরে ১২ ওয়ানডেতে কোহলির রান ৫৬০, কোনো সেঞ্চুরি নেই। গড় ৪৬.৬৬, যেখানে তাঁর ক্যারিয়ার গড় ৫৯.০৭। এই সময়ে ২০ টি-টোয়েন্টিতে কোহলি ৪৯.৫০ গড়ে করেছেন ৫৯৪ রান। আর টেস্টে? ১৩ ম্যাচে রান ৫৯৯। গড় মাত্র ২৬.০৪!
ঝামেলাটা হলো, ভারতীয় ক্রিকেট সেভাবে কখনোই আলাদা সংস্করণে আলাদা অধিনায়ক নিয়ে খেলেনি। কদিন আগেই ভারতের কোচের দায়িত্ব পাওয়া রাহুল দ্রাবিড় নতুন এই ধারণায় কীভাবে দলকে টেনে নেন, রোহিত আর কোহলির মধ্যে সম্ভাব্য ‘ক্ষমতার দ্বন্দ্ব’ কীভাবে সামলে নেন, সেটিই দেখার।
টেস্টে কোহলির অধীনেই ভারত অনন্য উচ্চতায় উঠেছে, কোহলি টেস্টে ভারতের সফলতম অধিনায়কই! কিন্তু ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, সেখানেও রোহিতের ছায়া দিনে দিনে বড়ই হচ্ছে!