২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

কোহলি তাহলে ‘অস্ট্রেলিয়ান’

বিরাট কোহলি ও স্টিভেন স্মিথবিসিসিআই

বিরাট কোহলি আসলে অস্ট্রেলিয়ান।

চমকে যাচ্ছেন তো?

ফৌজদারি উকিল প্রেমনাথ কোহলি ও গৃহিণী সরোজ কোহলি দম্পতির তিন সন্তানের কনিষ্ঠজন ‘চিকু’র জন্ম দিল্লিতে, বেড়ে ওঠা পশ্চিম দিল্লির উত্তম নগরে, ক্রিকেটের প্রথম পাঠও পশ্চিম দিল্লি ক্রিকেট একাডেমিতেই। সেখান থেকে দিল্লি রাজ্য দল, ভারতের বয়সভিত্তিক দল ও জাতীয় দলে খেলে খেলে ‘চিকু’ আজ ক্রিকেট-বিশ্বের ‘কিং কোহলি’। তিন সংস্করণ মিলিয়ে তাঁর ক্যারিয়ারের ২৬৯৪২ রানের মধ্যে ৩৪২৬ রান এসেছে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ ও বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলা ৫৯ ম্যাচ থেকে। এর বাইরে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বলতে বিভিন্ন সময় সেখানে বেড়াতে যাওয়া, এ-ই তো। তাঁর অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট আছে বলেও কখনো শোনা যায়নি। তাহলে কোহলি অস্ট্রেলিয়ান কী করে হন!

আরও পড়ুন

কিন্তু দাবিটা যে এক অস্ট্রেলিয়ানই করেছেন। এমন একজন, যাঁর নামটাও সমকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় কোহলির সঙ্গেই উচ্চারিত হয়। কোহলি যদি ভারতের সর্বকালের সেরাদের একজন হন, তাহলে তিনিও অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরাদের একজন। কোহলিকে অস্ট্রেলিয়ান দাবি করা সেই ভদ্রলোকের নাম স্টিভেন স্মিথ!

স্মিথ আসলে কী বলেছেন, সেটা জানার আগে জেনে নেওয়া যাক স্মিথ কোন উপলক্ষে কথাটা বলেছেন। আগামী ২২ নভেম্বর শুরু হচ্ছে বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি। অস্ট্রেলিয়া-ভারতের মধ্যে ৫ টেস্টের এই সিরিজটা সাম্প্রতিক কালে অ্যাশেজের মতো অভিজাত ও রোমাঞ্চকর এক লড়াই হয়ে উঠেছে। উন্মাদনা ও উত্তেজনায় কিছু দিক থেকে হয়তো অ্যাশেজের চেয়েও বেশি এখন এই সিরিজের আবেদন। তো সেই সিরিজ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই দুই পক্ষ থেকেই নানা রকম কথাবার্তা, আলোচনা, তর্কবিতর্ক হচ্ছে।

তো সেই সিরিজ নিয়েই সম্প্রতি স্টার স্পোর্টসে একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন স্টিভেন স্মিথ, যেটার উল্লেখযোগ্য অংশ প্রকাশিত হয়েছে স্টার স্পোর্টসের এক্স হ্যান্ডলে। সেখানেই কোহলির প্রশংসা করতে গিয়ে একটা পর্যায়ে স্মিথ বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, চিন্তা ও কাজের দিক থেকে কোহলি একজন অস্ট্রেলিয়ান।’ তারপর কথাটাকে আরও ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন মনে করেই যেন যোগ করলেন, ‘যেভাবে সে লড়াই করে, যেভাবে চ্যালেঞ্জ নেয়, প্রতিপক্ষকে হারানোর চেষ্টা করে...সম্ভবত ভারতীয়দের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে বেশি অস্ট্রেলিয়ান।’

আরও পড়ুন

বোঝাই যাচ্ছে, এখানে ‘অস্ট্রেলিয়ান’ বলতে স্মিথ জাতীয়তা বোঝাননি, বুঝিয়েছেন মানসিকতাকে। কেমন সেই মানসিকতা, সেটা স্মিথের কথা থেকে কিছুটা বোঝা যাওয়ার কথা, বোঝা যাবে ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার সাফল্য আর সেই সাফল্যের ধরন দেখলেও। তারপরও আরেকটু পরিষ্কার করে বোঝার জন্য বিবিসির প্রয়াত ব্রিটিশ ক্রীড়া সাংবাদিক, ক্রিকেট ভাষ্যকার ও ‘টেস্ট ম্যাচ স্পেশাল’ নামে বিবিসির বিখ্যাত অনুষ্ঠানের আলোচক জন আর্লটের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।

খেলাধুলায় অস্ট্রেলিয়ার এই হার না মানা মানসিকতা বোঝাতে ১৯৪৯ সালে আর্লট ‘অস্ট্রেলিয়ানিজম’ নামে একটা শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। বিবিসিতেই তিনি এ নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলেন, স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ‘দ্য ইনভিন্সিবল’ দলের স্মরণীয় সেই ইংল্যান্ড সফরের পর। ১৯৪৮ সালের বিখ্যাত সেই সফরে ৫টি টেস্ট ম্যাচসহ ইংল্যান্ডে মোট ৩৪টি ম্যাচ খেলেছিল, হারেনি ১টিও! ২৫ জয় আর ৯ ড্র নিয়ে নিজের ক্যারিয়ারের সর্বশেষ ইংল্যান্ড সফর শেষ করেছিলেন ব্র্যাডম্যান। সেই সফরের পর আর্লট বিবিসিতে লিখেছিলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ানিজম হচ্ছে জেতার একক সংকল্প, আইনের মধ্যে থেকে জেতার শেষ চেষ্টা করা, দরকার হলে সেটার শেষ সীমা পর্যন্ত যাওয়া। এর মানে হচ্ছে, মানুষের শরীরের শেষ সামর্থ্যটুকু দিয়ে জেতার চেষ্টা করা। অস্ট্রেলিয়ানরা বিশ্বাস করে, তারা এটা পারবে এবং প্রায়ই সেটা দেখে আমাদের বিস্মিত হতে হয় যে ওদের জন্য অসম্ভব বলতে কি কিছু আছে!’

প্রয়াত ব্রিটিশ ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রিকেট ভাষ্যকার জন আর্লট
আইসিসি ফেসবুক পেজ

শুধু ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়া নয়, আর্লটের এই কথা যুগে যুগে সত্য প্রমাণ করেছে অ্যালান বোর্ডারের অস্ট্রেলিয়া, স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়া, রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়া, এমনকি এখনকার অস্ট্রেলিয়াও। স্মিথ সেই অস্ট্রেলিয়ানিজম দেখেন কোহলির মধ্যেও এবং সম্ভবত স্মিথ ভুল করছেন না। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই ২০১৪ সিরিজে অ্যাডিলেড ও মেলবোর্নে ১৪১ ও ১৬৯ রানের ইনিংস, এর আগের বছর জোহানেসবার্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১১৯, ২০১৮ সালে এজবাস্টনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪৯, এমন আরও কত ইনিংস সাক্ষী দেবে কোহলির হার না মানা মানসিকতার, নিজেকে সামর্থ্যের শেষ সীমা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার।

আরও পড়ুন

প্রতিপক্ষ দলে এমন একজন ব্যাটসম্যান থাকা যেকোনো সময়ই বাড়তি চাপের, হুমকিরও। তার ওপর সেই ব্যাটসম্যানের সঙ্গে যদি প্রতিনিয়ত একটা অলিখিত লড়াই থাকে শ্রেষ্ঠত্বের, তাহলে তো চাপটা আরও বেশি হওয়ার কথা। স্মিথ সেই চাপ কতটুকু টের পান? অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানের উত্তর, ‘আসলে সে রকম কিছু নয়। আমার ওকে হারাতেই হবে, এভাবে ভাবি না আমি। ব্যাপারটা হচ্ছে মাঠে নেমে নিজের সেরাটা দেওয়া, যত বেশি পারা যায় রান করা এবং অস্ট্রেলিয়াকে সাফল্য এনে দিতে সাহায্য করা, সেটাই মূল লক্ষ্য।’

মাঠের বাইরেও স্মিথের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক কোহলির
এএফপি

দুই দেশ এখন সম্ভবত ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁদের দুজনের মধ্যেও একটা লড়াই সব সময় চলছে, এ অবস্থায় দুজনের সম্পর্কটা কেমন? স্মিথের উত্তরটা ক্রিকেটপ্রেমীদের খুশিই করবে হয়তো, ‘আমাদের সম্পর্ক দারুণ। প্রায়ই আমরা একে অন্যকে বার্তা পাঠাই। সে চমৎকার একজন মানুষ, দুর্দান্ত খেলোয়াড়। এই গ্রীষ্মে ওর মুখোমুখি হওয়াটা দারুণ ব্যাপার হবে।’

অস্ট্রেলিয়ার সেই গ্রীষ্মের অপেক্ষায় তো থাকাই যায়।