কেট উইন্সলেটের জন্য এতই ভালোবাসা জয়সওয়ালের
যশস্বী জয়সওয়ালের জীবনে আপাতত কোনো অতৃপ্তি নেই বললে ভুল হবে। দুবাইয়ের সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেলে দিন কাটাচ্ছেন, ব্যাটিং টিপস নিচ্ছেন স্টিভ স্মিথের কাছ থেকে। জস বাটলার আছেন আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের ধার বাড়ানোর জন্য। তবু এখনো স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেছে বলাটা সম্ভব হচ্ছে না তাঁর পক্ষে।
আপাতত ১৮ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যানের স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন শুধু একজনই, কেট উইন্সলেট। ইংলিশ এই অভিনেত্রীর মহাভক্ত রাজস্থান রয়্যালস ওপেনার। বিবিসির টেস্ট ম্যাচ স্পেশালের আইপিএল পডকাস্টে অকপটে নিজের ভালোবাসার কথা জানিয়েছেন জয়সওয়াল, ‘আমার প্রিয় চলচ্চিত্র টাইটানিক আর প্রিয় অভিনেত্রী কেট উইন্সলেট। তাঁকে অনেক ভালোবাসি, একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই।’ ভারতের ব্যাটিং-ভবিষ্যৎ বলে ভাবা হচ্ছে যাঁকে, তিনি নিজেকে একজন রোমান্টিক পুরুষ হিসেবেই ভাবতে পছন্দ করেন।
বুর্জ খলিফা থেকে মাত্র ২০ মিনিট দূরত্বে বসে পারস্য উপসাগরের গর্জন শুনতে শুনতে রোমান্টিক হতেই পারেন জয়সওয়াল। কিন্তু কৈশোর পেরোনোর আগেই এমন বিলাসী জীবন যাপনের স্বাদ পাওয়া জয়সওয়ালের জীবনে রোমান্টিকতা বলতে কিছু নাও থাকতে পারত। একটু এদিক-ওদিক হলেই যে ক্রিকেটার হওয়ার নেশায় ঘর ছাড়ার সিদ্ধান্তটা ভয়ংকরতম ভুল বলে প্রমাণিত হতে পারত।
জয়সওয়ালের ভাগ্য ভালো জ্বালা সিং নামে একজন তাঁর জীবনে এসেছিলেন। নিজে একটা ক্রিকেট একাডেমি চালান। সেখানেই একদিন হঠাৎ কানে আসে জয়সওয়ালের নাম। মাত্র ১২ বছরের এক কিশোর অনায়াসে খেলছেন ‘এ’ ডিভিশনের বোলারদের, শুনে আগ্রহী হবেন না কোন কোচ! একটু খোঁজ নিতেই শোনেন, নির্দিষ্ট কোনো কোচ ছাড়াই এত দুর্দান্ত খেলছে এই কিশোর। শুধু কোচ ছাড়াই খেলছে না জয়সওয়াল, একা একা দিন কাটাচ্ছে মুম্বাইয়ের মতো বড় শহরে। পরিবার পরিজন থেকে হাজার মাইল দূরে থেকেও ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। দিন কাটাচ্ছে ক্রিকেট খেলে, রাত কাটাচ্ছে নতুন কোনো আশ্রয়ের খোঁজে; অধিকাংশ রাতেই ঘুমাচ্ছে ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠা ক্ষুধাকে চেপে রেখে।
জ্বালা সিং শুধু জয়সওয়ালের প্রশিক্ষণের দায়িত্বই বুঝে নিলেন না, তাঁকে থাকার একটা জায়গাও করে দিলেন। মাত্র দুই বছরের মধ্যেই জয়সওয়ালের নাম মুম্বাইয়ের আজাদ ময়দান ছাড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে যায়। জাইলস শিল্ড টুর্নামেন্টের এক ম্যাচে ত্রিশতক করে পরে বল হাতে তুলে নিয়েছিলেন ১৩ উইকেট। স্কুল পর্যায়ের টুর্নামেন্টের কোনো ম্যাচে সর্বোচ্চ রান ও সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড এখনো তাঁর। গত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ রান করেছেন। ফাইনালে বাংলাদেশের বিপক্ষে হেরে গেলেও সর্বোচ্চ ইনিংসটি তাঁর। এর আগেই ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের ইতিহাস ওলট-পালট করার প্রিয় কাজটা করেছেন আরেকবার। বিজয় হাজারে ট্রফিতে ১৫৪ বলে ২০৩ রান করে সর্বকনিষ্ঠ ডাবল সেঞ্চুরিয়ানের রেকর্ড তিন বছর কমিয়ে এনেছেন।
কিন্তু এসব কিছুই চমক জাগায় না, যতটা না জাগায় তাঁর ক্রিকেটীয় যাত্রা। উত্তর প্রদেশের সুরিয়াভাঁ গ্রামে জন্ম। অমিত প্রতিভা থাকলেও তাঁকে কেউ ক্রিকেট নিয়ে এগোনোর সাহস দিতে পারছিলেন না। ‘আমি শুধু ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি, কিন্তু ভারতে গ্রামে সুযোগ (ক্রিকেট ক্যারিয়ার গড়ার) পাওয়া খুব কঠিন। বড়রা সবাই বলত, ক্রিকেট খেলতে চাইলে মুম্বাই যাও। আমার মাথায় ওটাই গেঁথে গেল। ঘুমাতে গেলেও মাথায় ওটা ঘুরত। মায়ের সঙ্গে কথা বললেও এটাই বলতাম, আমি মুম্বাই যেতে চাই’—জীবনের গল্প শোনাতে গিয়ে বললেন জয়সওয়াল।
ছয় ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ জয়সওয়াল নিজের ইচ্ছা পূরণে ঘর ছাড়লেন। শুধু ঘরই ছাড়লেন না, প্রতিজ্ঞা করলেন যত দিন না বলার মতো কিছু করবেন, তত দিন ঘরে ফিরবেন না। জয়সওয়ালের বয়স তখন কত? দশ ছাড়িয়েছে মাত্র।
মুম্বাইয়ে গিয়ে স্বপ্নটা পূরণ হয়েছে তাঁর। বিখ্যাত আজাদ ময়দানে অনুশীলন করছিলেন দিনভর। যে ময়দানে খেলেই উঠে এসেছেন শচীন টেন্ডুলকার ও পৃথ্বী শ-দের মতো ক্রিকেটাররা। সেখানেই নিজের হাতে থাকা শট পরখ করে নিচ্ছিলেন। ক্রিকেটীয় ব্যাকরণ মেনে শান দিচ্ছিলেন ফরোয়ার্ড ডিফেন্সে। দিনটা ঘনিয়ে এলেই সমস্যার শুরু, যে ধরনের সমস্যার কথা কখনো কল্পনা করতে হয়নি টেন্ডুলকার বা পৃথ্বী শ-কে।
টিকে থাকার লড়াইটা শুরু হতো রাতে। আশ্রয় ও খরচ মেটানোর জন্য একটা দোকানে চাকরি নিয়েছিলেন জয়সওয়াল। কিন্তু সারা দিন ক্রিকেট খেলে দোকানে ঠিকভাবে কাজ করা হচ্ছিল না। এতই পরিশ্রান্ত থাকতেন যে তাঁকে রেখে কোনো লাভ হচ্ছিল না দোকানের। ফলাফল, বের করে দেওয়া হলো জয়সওয়ালকে। সে স্মৃতি এখনো মনে আছে এই ওপেনারের, ‘আমার তখন এমন অবস্থা (কাউকে পেলে বলি)— “শুধু আজ রাতটা থাকতে দাও।” খুব একা ছিলাম, অনেক কঠিন এক সময় ছিল আমার জন্য। পরদিন আমার কোচকে বললাম সমস্যার কথা, তিনি তার ঘরে থাকতে বললেন। সেখানেই ছিলাম দুই-তিন মাস।’
এই আশ্রয়ও টিকল না বেশি দিন। মুম্বাইয়ের মতো মেগাসিটির বাস্তব রূপ আবারও নিষ্ঠুরতা নিয়ে ফিরে এল জয়সওয়ালের কাছে, ‘মুম্বাইয়ে থাকার জায়গা পাওয়া খুব কঠিন তাই আমাকে আরেকটা জায়গা খুঁজে নিতেই হতো। আমি তাই আমার ক্রিকেট দলের মাঠকর্মীদের তাঁবুতে আশ্রয় নিলাম। ওরা সোজা জানিয়ে দিল, তাঁবুতে থাকতে হলে রান করতে হবে, অনেক রান।’
শৌচাগার নেই, নেই পানি, বিদ্যুতের ব্যবস্থা। তবু সেই তাঁবুতেই সুখী জয়সওয়াল। কারণ ক্রিকেট পাগল ছেলেটার যে একটা বড় সুবিধা হয়ে গেল এতে, ‘আমি ভাবলাম মাঠের পাশে তাঁবুতে থাকাটা আমার জন্য ভালোই হবে। কারণ এখন আমি ঘুম থেকে উঠেই অনুশীলনে যেতে পারব। অথবা চাইলে স্কোরারের কাজ করে বা আম্পায়ারিং করে কিছু টাকাও পাব। আমার লাভ হবে এতে।’
স্কোরারের দায়িত্ব কিংবা মাঝেমধ্যে আম্পায়ারিং করেই তো আর চলা যায় না। তাই রাস্তায় নেমে খাবার বিক্রিও করতে হয়েছে জয়সওয়ালকে। সে দিনগুলোর কথাই বা কীভাবে ভোলেন। একদিকে বিক্রি যেন বেশি হয় সে চেষ্টা করছেন, ওদিকে প্রার্থনা করছেন কোনোভাবেই যেন কোনো বিত্তশালী সতীর্থের চোখে পড়ে না যান।
কিন্তু এত কিছু করেও লাভ হতো না। এমনিতেই ভাত, ডাল, রুটি আর আলুই ছিল তাঁর খাবারের তালিকায়। একজন উঠতি ক্রিকেটার হিসেবে প্রয়োজনীয় প্রাণীজ আমিষের জন্য অপেক্ষা চলত সপ্তাহের ছুটির দিনটার, ‘আমি রবিবারের জন্য অপেক্ষায় থাকতাম।’ সেদিনই মুরগি খেতে পারতেন জয়সওয়াল। তবে সে রুটিনও মানা হতো না প্রায়ই। পর্যাপ্ত অর্থ থাকত না হাতে। তাঁবুতে ঘুমোতে যেতেন এক পেট ক্ষুধা নিয়ে।
এর মাঝে হাজির হতো সেই সব দিন, যেদিন খেলা কিংবা ক্ষুধাও ভুলে যেতেন। ১৩০০ কিলোমিটার দূরে থাকা মায়ের কথা মনে পড়ত সেদিন। ক্লান্ত শরীরে একবার মার স্নেহের ভাগ পাওয়ার জন্য মন কাঁদত তাঁর। কিন্তু সে কথা কখনো কাউকে বলতে যেতেন না, ‘যখনই মায়ের কথা মনে পড়ত, কাঁদতাম আমি। কিন্তু যাই হোক না কেন, কাউকে কিছু বলতাম না। কারণ তাহলে আমাকে ফিরে যেতে বলত। আমি শুধু তাদের বলতাম, ভালো আছি, চিন্তা করো না।’
সে দিনগুলো পেরিয়ে এসেছেন বেশ কবছর হলো। এখন তাঁকে একনামে চেনে সবাই। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েছেন, লিস্ট ‘এ’-তে অবিশ্বাস্য ৭১ গড়, কড়া নাড়ছেন জাতীয় দলের দরজায়। আইপিএলে তাঁকে পেতে যুদ্ধ লেগে গিয়েছিল দলগুলোর মাঝে। ২ কোটি ৪০ লাখ রুপিতে তাঁকে দলে টেনেছে রাজস্থান রয়্যালস। আইপিএলে ইনিংস উদ্বোধন করতে নামছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা এক ব্যাটসম্যানের সঙ্গে, ‘তিনি (স্মিথ) বলেন, যাও আর উপভোগ করো। তিনি খুবই দারুণ এক মানুষ। যখন তিনি এলেন, অনেক প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছিলাম। কীভাবে সেরা উপায়ে প্রস্তুত হওয়া যায়, মানসিক শক্তি বাড়ানো যায় কীভাবে। তিনি বলেছেন, যখনই দরকার হবে জিজ্ঞেস করো, কোনো দ্বিধা রেখ না। একজন অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের এমন আচরণ, তাঁর অধীনে তরুণ কারও খেলা দারুণ এক ব্যাপার।’
স্মিথ, জফরা আর্চার কিংবা বাটলারের সঙ্গে ড্রেসিং রুম ভাগাভাগি করেও এখনো শেকড় ভোলেননি জয়সওয়াল। এই তো আইপিএলে তাঁর একটি ভিডিও দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল সেদিন। মাঠে মহেন্দ্র সিং ধোনিকে দেখে নমস্কার করছেন। ভবিষ্যতে ‘মহাতারকা’ হতে পারবেন কি না, সময়ই বলবে। আপাতত সম্ভাব্য সেরা পথেই এগোচ্ছেন জয়সওয়াল।
উইন্সলেটের সঙ্গে দেখা না হওয়ার অতৃপ্তিটা তাই আর কিছুদিন থাকুক না! (বিবিসি অবলম্বনে)