২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

করোনার সময় ধৈর্য ধরা শিখবেন যাকে দেখে

>করোনার করাঘাতে মানুষের জীবন এখন নিস্তরঙ্গ, কর্মজীবন স্থবির। ভাইরাসের প্রকোপে না পড়ার জন্য কেউই বাইরে যাচ্ছেন না, দিনের পর দিন ঘরে বসে আছেন। ব্যাপারটা যথেষ্টই কষ্টসাধ্য। অনেক ধৈর্য দাবি করে। এই অবস্থায় ধৈর্যের পাঠ নিতে যদি ক্রিকেটের দ্বারস্থ হওয়া যায়, তবে কেমন হয়?
বার্ট আয়রনমঙ্গার। ছবি: আইসিসি টুইটার পেজ
বার্ট আয়রনমঙ্গার। ছবি: আইসিসি টুইটার পেজ

পৃথিবী আবার কবে স্বাভাবিক হবে কেউ জানে না। কিন্তু মানুষ বাঁচে আশায়। তাই দিতে হচ্ছে ধৈর্যের পরীক্ষা। এক টানা ঘরে বসে থাকার। সবার অপেক্ষা, একদিন এই করোনা-কাল কাটবে নিশ্চয়!

ঘরে থাকার ধৈর্য ও অপেক্ষাই এখন মানুষের লড়াইয়ের বড় পুঁজি। আটপৌরে লোকটি তাতে নিঃসন্দেহে বড় প্রেরণা। আটপৌরে বলার কারণ পরে বলা যাবে। আগে তুলে আনা যাক সংখ্যা দুটো—৯৯.৯৪ ও ১.৬৯।

প্রথমটি না বললেও বলে। ক্রিকেটের সম্ভবত সবচেয়ে ‘আইকনিক’ সংখ্যা। বাউরাল-বিস্ময়ের সেই ব্যাটিং গড়। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান! পরেরটি মাত্র ১৪ টেস্ট খেলা এক বাঁ হাতি স্পিনারের ওভারপ্রতি রান দেওয়ার গড়। সংখ্যাটা যেমন মনোলোভা তেমনি এর যাত্রা শুরুর পূর্বাপর গল্প বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলিয়ে দেওয়ার মতো।

১৯২৮ সালের ৩০ নভেম্বর। ব্রিসবেন টেস্টের প্রথম দিন। ইতিহাস এ ম্যাচকে ইংল্যান্ডের ৬৭৫ রানে জয়ের জন্য যতটা মনে রেখেছে ব্র্যাডম্যানের অভিষেক টেস্ট হিসেবে মনে রেখেছে তার চেয়ে বেশি। সে দিন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অভিষিক্ত হয়েছিলেন আরও একজন।

বার্ট ‘ডেইন্টি’ আয়রনমঙ্গার। অনেকের চোখেই অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরা বাঁ হাতি স্পিনার।

এবার হয়তো ধরতে পেরেছেন। ওই দুটোর সংখ্যার যোগসূত্র আর কি। দুজনের অভিষেকই এক ম্যাচে, দুজনেই কোনো না কোনোভাবে সেরা!

অমিলও আছে। অভিষেকের সময় ব্র্যাডম্যানের ছিলেন ২০ বছর বয়সের তরতাজা যুবক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা কাটিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখা অস্ট্রেলিয়ার এক মশাল বাহক। বার্ট ঠিক তার বিপরীত। শ্রমজীবী, সেকেলে, বাগানের বিশ্বস্ত মালি সেটি ৬০ বছর বয়স পেরিয়েও, টান কিংবা পানের অভ্যাস বিবর্জিত একজন পারিবারিক মানুষ, যাঁর বাসায় ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত একটা টেলিফোন পর্যন্ত ছিল না! গাড়ির তো প্রশ্নই ওঠে না।

এমন একজন মানুষ অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলে খেলার অপেক্ষায় পার করেছেন নিজের যৌবন। ক্রিকেটাররা অবসর নিয়ে যে বয়সে পুরোদস্তুর ধারাভাষ্যকার কিংবা কোচ, কিংবা ছেলেপিলে নিয়ে পরিবারটা উপভোগ করেন, বার্টের অভিষেক ঘটেছিল তখন। 

১৯৩৩ সালে সিডনিতে পঞ্চম টেস্টে অস্ট্রেলিয়া দল। বার্ট পেছনের সারিতে বাঁ থেকে তৃতীয়। ছবি: আইসিসি
১৯৩৩ সালে সিডনিতে পঞ্চম টেস্টে অস্ট্রেলিয়া দল। বার্ট পেছনের সারিতে বাঁ থেকে তৃতীয়। ছবি: আইসিসি

বার্টের জন্ম ১৮৮২ সালে। কৃষক পরিবারে ১০ সন্তানের মধ্যে ছিলেন সবার ছোট। জীবনের পঁচিশতম বসন্ত পর্যন্ত ছিলেন রেলওয়ের শ্রমিক। তার আগে ছিলেন কৃষক। ১৯১৩ সালে তাঁর পরিবার মেলবোর্নে আসার পর কাজ করেছেন পানশালায়, বিক্রি করেছেন তামাক। সেন্ট কিল্ডা সিটি কাউন্সিলের বাগানে মালির চাকরি পাওয়ার পর সেখানে ঘাস কাটার মেশিন টেনেছেন ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত। এর মাঝে ক্রিকেট খেলার জন্য বন্ধ থেকেছে বেতন।

বার্টের অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে এসব কোনো বাধা উড়ে গেছে খড়কুটোর মতো। ক্রিকেটে আসায় অর্থাৎ স্পিনার হয়ে ওঠার পথে সবচেয়ে বড় লড়াইটি তিনি জিতেছিলেন শৈশবেই। সেটাও আরেক ট্র্যাজেডি। ছোটবেলায় ফসল কাটার যন্ত্রে কেটে নিয়েছিলেন বাঁ হাতের তর্জনী। বোন উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে তৎক্ষণাৎ বার্টের আঙুল ঠেসে ধরেছিলেন ময়দার মধ্যে। রক্তপাত বন্ধ হওয়ায় বেঁচে যান। তর্জনী রক্ষা পায়নি। শুধু আঙুলের গোড়ার অংশটুকু ছিল।

বার্ট এই কাটা আঙুল নিয়ে বাঁ হাতি স্পিনার হলেন কীভাবে সে এক বিস্ময়। বাঁক খাওয়ানো দুর অস্ত, বাঁ হাতের তর্জনী না থাকলে যে বল গ্রিপ করাই দুঃসাধ্য।কিন্তু ওই যে ইচ্ছাশক্তি আর চেষ্টা, এটুকু পুঁজি করেই তর্জনীর গোড়া দিয়েই তাক লাগানোর মতো বাঁক পেতেন বার্ট। তাও ঝুলিয়ে নয়, জোরের ওপর এবং স্যাঁতসেঁতে পিচে! উইকেট একটু এদিক-সেদিক হলেই বাঁকের সঙ্গে বাউন্সে নাভিশ্বাস তুলেছেন ব্যাটসম্যানদের। 

‘আয়রন গ্রিপ’ বার্টের আঙুল। ছবি: টুইটার
‘আয়রন গ্রিপ’ বার্টের আঙুল। ছবি: টুইটার

বার্টের বোলিং নিয়ে ‘সিজনস ইন দ্য সান’ বইয়ে বব কোলম্যান লিখেছেন, ‘যেন স্কুলপড়ুয়া কোনো ছেলে মার্বেল ছুড়ছে। তার সহনশক্তি এবং লাইন-লেংথ কিংবদন্তিতুল্য। বলা হয়ে থাকে, উইকেটে তিনটি পেনি রাখলে সে সারা বিকেল ধরে তার ওপর বল ফেলতে পারবে।’

১৯২৪-২৫ মৌসুমে সফরকারী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভিক্টোরিয়ার হয়ে হ্যাটট্রিক করেছিলেন বার্ট। তার আগেই নজর (১৯১৩) কেড়েছিলেন ওয়ারউইক আমস্ট্রংয়ের। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর অভিষেক বেশ দেরিতে, ২৭ বছর বয়সে। অস্ট্রেলিয়া দলে ডাক পান এর ১৮ বছর পর। অর্থাৎ, ৪৬ বছরে (৪৫ বছর ২৩৭ দিন) পা রেখে। টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সে অভিষিক্ত ক্রিকেটারদের মধ্য চতুর্থ হয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন বার্ট। সবুরে মেওয়া ফলানোর পর ওই বয়সে দলের জন্য তিনি নিজেকে কতটুকু নিংড়ে দিয়েছিলেন সেটিও কিংবদন্তিতুল্য।

বৃষ্টিস্নাত খোলা উইকেটে বার্ট ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই ‘আনপ্লেয়েবল’। ১৪ টেস্টে তাঁর ৭৪ উইকেট দিয়ে তেমন কিছু বোঝা যায় না। তবে একটা পরিসংখ্যান দেওয়া যায়। ন্যূনতম ১৪ টেস্ট খেলেছেন এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বল (৪৬৯৫) করেছেন বার্ট। ৬৫ প্রথম শ্রেণির ম্যাচের(৪৬৪ উইকেট) মধ্যে ১৫টিতেই ৪০০-র বেশি করে বল করেছেন তিনি। এর সবগুলোই খেলেছেন ৪৫ বছর পেরিয়ে। ব্রিসবেনে অভিষেক টেস্টেই বল করেছিলেন ৯৪.৩ ওভার।

এবার অর্জনে তাকানো যাক। ৪৮ ও ৪৯ বছর বয়সে সবচেয়ে বেশি বয়স্ক বোলার হিসেবে ইনিংসে ৫টি, ৬টি ও ৭টি করে উইকেট নেওয়ার রেকর্ড গড়েছেন। সবচেয়ে বেশি বয়স্ক বোলার হিসেবে গড়েছেন ম্যাচে ন্যূনতম ১০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড। ১৯৩১-৩২ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচে ২৪ রানে নিয়েছিলেন ১১ উইকেট। টেস্ট ইতিহাসে এটি সবচেয়ে কম রানে ম্যাচে ন্যূনতম ১০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড।

ক্রিকেট লিখিয়ে ও ঐতিহাসিক গিডিওন হাই লিখেছিলেন, ‘আর কোনো অস্ট্রেলিয়ান বোলার তার মতো কিপটে হতে পারেনি। স্যাঁতসেঁতে উইকেটে তার মতো ভয়ংকরও নয়।’ পরিসংখ্যানও বলছে টেস্টে কমপক্ষে ৫০০ ওভার বল করেছেন এমন বোলারদের মধ্যে তৃতীয় সেরা ইকোনমি রেট বার্টের, অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে সেরা।

ব্যাটিংয়ে ঠিক তার উল্টো। একেবারে আদর্শ ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান। একটা কৌতুক প্রচলিত আছে, এমসিজিতে ম্যাচ চলাকালীন বার্টের স্ত্রী একবার ফোন করেছেন। খেলোয়াড়দের কেউ একজন ফোন ধরে জানালেন, বার্ট ব্যাট করতে নেমেছে। ওপাশ থেকে লাইন না কেটে জবাব এল, ঠিক আছে। অপেক্ষা করছি।

এ স্রেফ মুখের কথাই। কারণ অস্ট্রেলিয়া দলে খেলাকালীন বার্টের বাসায় ফোন ছিল না। তাঁর ব্যাটিংয়ের ‘মুনশিয়ানা’(!) বোঝাতেই সম্ভবত এই রসিকতার জন্ম। তবে বার্টের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে দুঃখের পাতা হয়ে থাকবে ইংল্যান্ড। তাঁর অ্যাকশন নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কখনোই কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু কথিত আছে, অ্যাকশন নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় বার্টকে কখনো সফরে আমন্ত্রণ জানায়নি ইংল্যান্ড। এ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক ভিক রিচার্ডসন স্পোর্টিং গ্লোবে ‘ক্রিকেট ট্র্যাজেডি’ কলামে অভিযোগটি উড়িয়ে দিয়ে তুমুল সমালোচনা করেছিলেন।

সারা জীবন শ্রমজীবী ছিলেন, তাই চওড়া কাঁধ ও আড়ষ্ট পায়ের অধিকারী ছিলেন। ফলে সেভাবে দৌড়াতে পারতেন না বার্ট। তাই ফিল্ডার হিসেবে ছিলেন যাচ্ছেতাই। বডিলাইন সিরিজে ৯৮ রানে ব্যাট করা হ্যারল্ড লারউডের ক্যাচ নেওয়াই সম্ভবত ফিল্ডার হিসেবে তাঁর সেরা সাফল্য। 

৯৮ রানে আউট হয়ে ফিরছেন লারউড। বার্টের ক্যাচের শিকার। ছবি: ওল্ড ক্রিকেট আর্কাইভ টুইটার পেজ
৯৮ রানে আউট হয়ে ফিরছেন লারউড। বার্টের ক্যাচের শিকার। ছবি: ওল্ড ক্রিকেট আর্কাইভ টুইটার পেজ

সেই সিরিজেই ব্র্যাডম্যান ৯৮ রানে অপরাজিত থাকতে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে বার্ট উইকেটে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ভেবো না বাছা! নিরাশ করব না।’ ব্র্যাডম্যান কিন্তু সেঞ্চুরি তুলে নিতে পেরেছিলেন। ৭৪ উইকেটের পাশে তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারে মোট ৪২ রানও ব্যাটিং সামর্থ্যকে বুঝিয়ে দেয়। সঙ্গে থাকবে প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারে এক চতুর্থাংশ ইনিংসে নির্ভেজাল শূন্য মেরে আউট হওয়ার কেরদানি!

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বয়স্ক হিসেবে শেষ টেস্ট (৫০ বছর) খেলা বার্ট ধৈর্যের পুরস্কার পেয়েছিলেন নিজের শেষ সিরিজে, সেই বডিলাইনেই! ক্যারিয়ার শেষ করেছিলেন আইসিসি র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ বোলার হিসেবে। ক্ল্যারি গ্রিমেট, বিল ও’রেইলিদের সে সময়ে এই অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটানো বার্ট সবচেয়ে বেশি বয়সী বোলার হিসেবে র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে ওঠার রেকর্ডধারীও। 

সেই স্কোরকার্ড। ছবি : টুইটার
সেই স্কোরকার্ড। ছবি : টুইটার

৫৩ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ছাড়ার পরেও আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে ব্রুউন্সইকের হয়ে নিয়েছিলেন ১২ উইকেট। ক্রিকেট ছাড়ার পর শেষ দিন পর্যন্ত পরিচর্যা করেছেন বাগান।

বার্টকে বলা হয় ‘দ্য আয়রন গ্রিপ।’ অথচ স্পিনের আঙুলই ছিল না! তবু জাদু দেখিয়ে গেছেন ওই বয়সে। তিনি আঙুল ছাড়াই আঙুলের স্পিনার, জাদুকাঠি ছাড়াই জাদুকর!

১৯৭১ সালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমানো বার্টের ধৈর্য, একাগ্রতা ও নিষ্ঠার প্রসঙ্গ এই করোনা-কালে টেনে আনার কারণ, আজ তাঁর জন্মদিন।