ভিত্তিমূল্য ছিল ৪০ লাখ। প্রথম দামটা বলেছিল দিল্লি ক্যাপিটালস। পরে কলকাতা নাইট রাইডার্স ও পাঞ্জাব কিংস। লড়াই জমে উঠে লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্ট ও রাজস্থান রয়্যালসও যোগ দিলে। দাম বাড়তে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে। শেষ পর্যন্ত সঞ্চালক যখন ‘সোল্ড’ বললেন, ততক্ষণে ৮ কোটি ২৫ লাখ রুপিতে গিয়ে ঠেকেছে টিম ডেভিডের দাম!
দিল্লি, কলকাতা, পাঞ্জাব, লক্ষ্ণৌ বা রাজস্থান নয়, ডেভিডকে পেল শেষ পর্যন্ত মুম্বাই ইন্ডিয়ানস। মুম্বাইয়ের আইপিএল-ইতিহাসে সবচেয়ে দামি বিদেশি খেলোয়াড়ের নাম এখন টিমোথি হেস ডেভিড। সিঙ্গাপুরের একজন ক্রিকেটারের এত দাম পাওয়া আপনাকে অবাক করতে পারে। তবে গত কয়েক বছর বিভিন্ন দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগগুলো যাঁরা অনুসরণ করেন, তাঁরা হয়তো অতটা অবাক হবেন না। বিগ ব্যাশ, ক্যারিবিয়ান সুপার লিগ, পিএসএল খেলে এরই মধ্যে মারদাঙ্গা ব্যাটসম্যান হিসেবে ভালোই যে নাম কামিয়েছেন টিম ডেভিড। টিম ডেভিডের দ্বৈত সত্তাটাও হয়তো তাঁদের জানা। সেটি কী? টিম ডেভিড যতটা সিঙ্গাপুরিয়ান, প্রায় ততটাই অস্ট্রেলিয়ান!
জন্মসূত্রে সিঙ্গাপুরিয়ান, কিন্তু ক্রিকেট–দীক্ষা অস্ট্রেলিয়ায়। সিঙ্গাপুর ১৯৭৪ সাল থেকেই আইসিসির সহযোগী সদস্য, কিন্তু ক্রিকেট খেলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশটি খুব বেশি কিছু করতে পারেনি। সেই সিঙ্গাপুরের হয়েই ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফিতে খেলেছিলেন টিম ডেভিডের বাবা রড ডেভিড। রড এমনিতে পেশায় প্রকৌশলী, ক্রিকেট খেলতেন শখে। ভদ্রলোককে পুরোপুরি সিঙ্গাপুরিয়ান বলা যাবে না, কারণ তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছিল অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। ক্রিকেটের হাতেখড়িও সেখানেই। সিঙ্গাপুরে থিতু হয়েছিলেন পেশাগত কারণে। তারপর দেখলেন তিনি যেটুকু ক্রিকেট পারেন, সেটাই সিঙ্গাপুর জাতীয় দলে খেলার জন্য যথেষ্ট। ব্যস, ক্রিকেটও চলল পাশাপাশি।
টমের জন্ম ওই সময়টায়, ১৯৯৬ সালে। বাবাকে ক্রিকেট খেলতে দেখেই তাঁরও ক্রিকেটের প্রেমে পড়া। তবে ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে ওঠার সুযোগটা আসে অনেকটা ভাগ্যক্রমে। ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফির পরই এশিয়ায় অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে সিঙ্গাপুর ছেড়ে আবার অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান রড ডেভিড। থিতু হন পার্থে। ব্যস, স্কুল ও কলেজজীবনটা ক্রিকেটময় হয়ে যায় টম ডেভিডের।
ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বয়সভিত্তিক দলে খেলেছেন ডেভিড। অনূর্ধ্ব-১৯ থেকে অনূর্ধ্ব-২৩ পর্যন্ত সব দলেই। ক্যারিয়ারের বড় ব্রেকটা পান ২০১৮ সালে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার অনূর্ধ্ব-২৩ দলে খেলার সময়। ৫ ম্যাচে ৪০০ রান করার পরই ডাক পেয়ে যান বিগ ব্যাশে পার্থ স্করচার্স দলে। খুব আহামরি কিছু করতে পারেননি। কিন্তু বল পেটানোর একটা সহজাত সামর্থ্য যে আছে, সেটা ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন পার্থের হয়ে ওই মৌসুমের ৯টা ইনিংসে।
মূলত সেটা দেখেই ২০২০-২১ মৌসুমে ডেভিডকে দলে নেয় হোবার্ট হারিকেনস। প্রথম ম্যাচেই ৩৩ বলে ৫৮ রান করে সিডনি সিক্সার্সের বিপক্ষে হয়ে যান ম্যাচসেরা। এরপরই হোবার্টের মিডল অর্ডার-লোয়ার মিডল অর্ডারে নিয়মিত হয়ে যান ডেভিড। ওই মৌসুমে হোবার্টের হয়ে ১৪ ম্যাচ খেলে ২৭৯ রান করেছিলেন ১৫৩ স্ট্রাইক রেটে। ওই মৌসুমটাই মূলত ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টিতে পরিচিত করে তোলে তাঁকে।
সিঙ্গাপুরের হয়ে অভিষেক হয়ে গিয়েছিল অবশ্য ২০১৯ সালেই। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্বও আছে, সুতরাং জাতীয় দল হিসেবে প্রথম পছন্দ অস্ট্রেলিয়াই ছিল। কিন্তু সেখান থেকে ডাক পাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে থাকতেই সিঙ্গাপুরের হয়ে খেলার সুযোগ আসে। ডেভিড সেই সুযোগটাই নিয়ে নেন। দেড় বছরে সিঙ্গাপুরের হয়ে ১৪টি ম্যাচ খেলে ৫৫৮ রান করেছেন ১৫৮ স্ট্রাইক রেটে। এর মধ্যে ২০২০ সালে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে ৩২ বলে অপরাজিত ৯২ রানের ইনিংসও আছে একটা।
আমি অবশ্যই অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলতে চাই। যদি কখনো সেই সুযোগ আসে, অবশ্যই আমি তা লুফে নেব। তবে আপাতত আমি সিঙ্গাপুরের হয়ে খেলতে পারছি বলেই খুশি।
তবে সহযোগী দেশগুলোর টি-টোয়েন্টির মান তো তেমন আহামরি নয়। ক্রিকেট বিশ্বেরও এ নিয়ে খুব একটা আগ্রহ নেই। সিঙ্গাপুরের হয়ে পারফরম্যান্স দিয়ে তাই খুব একটা নিজেকে চেনাতে পারেননি ডেভিড, যতটা চিনিয়েছেন বিগ ব্যাশ খেলে। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলার আশাও এখনো ছেড়ে দেননি ডেভিড। গত বছরই বিগ ব্যাশে খেলার সময় ক্রিকইনফোকে বলেছিলেন, ‘আমি অবশ্যই অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলতে চাই। যদি কখনো সেই সুযোগ আসে, অবশ্যই আমি তা লুফে নেব। তবে আপাতত আমি সিঙ্গাপুরের হয়ে খেলতে পারছি বলেই খুশি।’
হোবার্টের হয়ে সেই পারফরম্যান্সের পর লাহোর কালান্দার্সের হয়ে গত বছর পিএসএলে সুযোগ পেয়েছেন, ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন সেন্ট লুসিয়া কিংস দলে। ইংল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি ব্লাস্ট খেলেন সারের হয়ে, সাউদার্ন ব্রেভ দলের হয়ে ‘দ্য হানড্রেড’ টুর্নামেন্টেও। সব মিলিয়ে গত বছরটা আসলেই স্বপ্নের মতো কেটেছে ডেভিডের।
আইপিএলে অভিষেকও কিন্তু গত বছরই। সংযুক্ত আরব আমিরাতে করোনা বিরতির পর আইপিএলের বাকি অংশের খেলার জন্য তাঁকে ফিন অ্যালেনের বদলি হিসেবে নেয় রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু। তবে একটার বেশি ম্যাচ খেলা হয়নি।
লাহোর কালান্দার্সের হয়ে পিএসএলে নিজের প্রথম মৌসুমে ৬ ইনিংসে ১৮০ রান করেছিলেন ৪৫ গড়ে, ১৬০–এর মতো স্ট্রাইক রেটে। পরেরবার প্লাটিনাম ক্যাটাগরির খেলোয়াড় হিসেবে তাঁকে দলে নিয়েছে চ্যাম্পিয়ন মুলতান সুলতানস। চলমান পিএসএলে এখন পর্যন্ত মুলতানের হয়ে ৭ ম্যাচে ২২১ রান করেছেন ৫৫ গড়ে। এর চেয়েও উল্লেখযোগ্য অবশ্য তাঁর স্ট্রাইক রেট—১৮১।
টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটের সবচেয়ে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানদের একজন ডেভিড ওয়ার্নারের যেখানে সোয়া ছয় কোটি রুপি দাম উঠেছে, সেখানে আরেক ডেভিড, এই টিম ডেভিডের দাম কেন সোয়া আট কোটি রুপি, এর কারণটা কিছুটা হলেও বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই।