প্রথম টেস্ট ম্যাচ দেখেছেন ১৯৪৮ সালে। সাংবাদিকের ভূমিকায় প্রথম টেস্ট ম্যাচ ১৯৫৫ সালে। যখন তাঁর কিশোরকালই কাটেনি। প্রায় পাঁচ দশক তিনি হয়ে ছিলেন ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের কণ্ঠস্বর’। ছিলেন, কারণ ২০১৬ সালের এই দিনে লোকান্তরিত হয়েছেন টনি কোজিয়ার। এতটাই ক্রিকেট অন্তঃ প্রাণ ছিলেন, কে জানে, ওই কল্পলোকে গিয়েও হয়তো কোনো ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন করে ধারাভাষ্য দিতে শুরু করেছেন! কোজিয়ারের মৃত্যুর পর লেখা শ্রদ্ধার্ঘ্যটা আবারও।
মৃত্যুর ওপারে যে রহস্যময় জগতে পাড়ি জমালেন টনি কোজিয়ার, সেখানে কি আইসক্রিম পাওয়া যায়?
কী অদ্ভুত প্রশ্ন!
কোজিয়ারের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর থেকেই কানে বাজছে তাঁর অমর কণ্ঠ। তা তো বাজবেই। ক্রিকেটলেখক হিসেবেও ছিলেন অসাধারণ, তবে সেই পরিচয় ছাপিয়ে টনি কোজিয়ার মানেই ওই ‘রোদ ঝলমল’ কণ্ঠস্বর। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সঙ্গে সমার্থক হয়ে গিয়ে যেটি পরিণত ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের কণ্ঠস্বরে’ই।
সঙ্গে ওই অদ্ভুত প্রশ্নটাও মনে জাগছে—মৃত্যুর ওপারে যে রহস্যময় জগতে পাড়ি জমালেন টনি কোজিয়ার, সেখানে কি আইসক্রিম পাওয়া যায়? আইসক্রিম না পেয়ে ব্যথিত-রাগান্বিত-হতভম্ব টনি কোজিয়ারের রক্তাভ মুখটা যে বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে।
২০০৯ সালে বাংলাদেশ দলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের সময়কার কথা। গ্রেনাডাতে দুই দলের খেলোয়াড় ও ধারাভাষ্যকারদের সঙ্গে একই হোটেলে আছি। সেই হোটেল, গ্র্যান্ড আনসে বিচ হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট যেন বিশাল এক বাগানবাড়ি। সেখানেই একদিন সন্ধ্যার পর রাতের খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছি শুনে পর টনি কোজিয়ার ও জেফরি ডুজন তাঁদের সঙ্গী হওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন।
খাওয়ার অংশটুকুর স্মৃতি ভয়াবহ। ইতালিয়ান খাবার আমার দুই চোখের বিষ। ওঁরা দুজন কিনা নিয়ে গেলেন একটা ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টেই! শুধু কোজিয়ার ও ডুজনের সঙ্গ পাওয়ার লোভেই বিবমিষা জাগানো সেই খাবার নীরবে গলাধঃকরণ করে গেলাম। মনকে বোঝালাম, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের অতীত-বর্তমান নিয়ে যে আড্ডাটা হলো, সেটির বিনিময় মূল্য হিসেবে এটি কিছুই না।
মজাটা হলো খাওয়া শেষ হওয়ার পর। কোজিয়ার আইসক্রিম অর্ডার করে জানলেন, এই রেস্টুরেন্টে কোনো আইসক্রিম নেই। শোনার পর তাঁর প্রতিক্রিয়া তো আগেই লিখেছি। বিশালদেহী ওই লোকটি যেন চোখের পলকে অবুঝ শিশু! কিশোর ওয়েটারের দিকে তাকিয়ে বারবার বলতে লাগলেন, ‘ও মাই গড! ও মাই গড! জেফরি, শুনেছ, ও বলছে এখানে নাকি আইসক্রিম নেই। আশপাশেও কোথাও নেই।’ প্রাপ্তবয়স্ক কারও কাছে আইসক্রিম খেতে পারা না-পারা এমন ‘জীবন-মৃত্যুর’ ব্যাপার হতে পারে, সেটি ওই প্রথম জানলাম।
টনি কোজিয়ারকে নিয়ে মাইকেল হোল্ডিংয়ের স্মৃতিচারণায়ও দেখলাম, এই আইসক্রিম প্রসঙ্গ এসেছে। হোল্ডিংকে ধারাভাষ্যে এনেছিলেন এই কোজিয়ারই। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটে টনি কোজিয়ারকে যে তিনি গ্যারি সোবার্সের পাশে স্থান দিয়েছেন, এটা নিশ্চয়ই শুধু সেই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে নয়। এই স্বীকৃতি কোজিয়ারের প্রাপ্য।
ক্রিকেটই সম্ভবত একমাত্র খেলা, যেটির লেখক-ধারাভাষ্যকারেরাও খেলোয়াড়দের মতোই বরণীয়। ক্রিকেটে ডন ব্র্যাডম্যান যেমন বিখ্যাত, তেমনি নেভিল কার্ডাসও। কেউ জ্যাক হবসের নাম জানলে জন আর্লটের নামও তাঁর শোনার কথা। তবে টনি কোজিয়ারের মতো আর কেউ বোধ হয় তাঁর দেশের ক্রিকেটের এতটা সমার্থক হয়ে উঠতে পারেননি।
‘দেশ’ বলে ফেললাম, তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো আর একটি দেশ নয়। নানা দ্বীপরাষ্ট্র মিলে শুধু ক্রিকেটেই তাঁরা এক দল হয়ে অন্য সব দেশের সঙ্গে খেলে। টনি কোজিয়ারের দেশ যেমন বারবাডোজ। কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক ওরেলের ওই সর্বজনীন চেতনা ধারণ করে কোজিয়ার যত না বারবাডিয়ান ছিলেন, তার চেয়ে বেশি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান। এ কারণেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের দুর্দশা তাঁর হৃদয়ে অবিরাম রক্তক্ষরণ ঘটাত। ক্যারিবিয়ানে খেলাটির বৃহত্তর তাৎপর্য অনুধাবন করতে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটারদের অক্ষমতা ক্ষুব্ধ করে তুলত তাঁকে।
এই মর্মবেদনা খুব ভালো বুঝতে পেরেছিলাম ২০০৯ সালের ওই সফরেই। টনি কোজিয়ারের সঙ্গে যা একটু ঘনিষ্ঠতাও ওখানেই। বাংলাদেশ থেকে আমিই ছিলাম একমাত্র সাংবাদিক। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান সাংবাদিকেরও দু-একজনের বেশি দেখা মিলত না প্রেসবক্সে। টনি কোজিয়ার কমেন্ট্রি শেষ করেই প্রেসবক্সে এসে বসতেন। প্রায় নিয়মিতই আড্ডা হতো। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটে ওই সিরিজ দুঃস্বপ্নের অন্য নাম।
নিয়মিত খেলোয়াড়েরা ধর্মঘটে যাওয়ায় খেলছে দ্বিতীয় দল আর বাংলাদেশের কাছে হেরে চলেছে ম্যাচের পর ম্যাচ। ওরেল-সোবার্স-লয়েডদের ওই প্রবল প্রতাপান্বিত সব দলের একরকম অংশ হয়েই দেশ-বিদেশ ঘোরা কোজিয়ারের জন্য এ যে কত বড় যন্ত্রণা, সেটি তাঁর মুখ দেখেই পরিষ্কার বোঝা যেত।
বড় একটা ইন্টারভিউও করেছিলাম সেবার। যাতে যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘এত দিন বলতাম, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট মৃত্যুশয্যায়। এখন বলব, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট মরেই গেছে।’
ক্রিকেটের সঙ্গেই জীবন জড়িয়ে যাওয়ার গল্পটাও বলেছিলেন সবিস্তার। বাবাও ছিলেন সাংবাদিক। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অনেক পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৫৫ সালে যখন তিনি সেন্ট লুসিয়ার দ্য ভয়েস পত্রিকার সম্পাদক, টনি কোজিয়ার বারবাডোজে স্কুলছাত্র। স্কুলের পক্ষে ক্রিকেট খেলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া সফরে। বাবা তাঁকে বললেন, ‘ক্রিকেট দেখতে চাইলে যেতে পারো।’ ছেলে বলল, ‘আমি ক্রিকেট কাভার করতে চাই।’ পনেরো বছরের টনি তা করেও ফেললেন! ধারাভাষ্যে অভিষেক এর পাঁচ বছর পর, শুরুটা ত্রিনিদাদ রেডিওতে। এর পর তো রেডিও, টিভি, সংবাদপত্র, ওয়েবসাইট সব জয় করার গল্প।
মনে আছে, আধুনিক ধারাভাষ্য শুধুই সাবেক টেস্ট ক্রিকেটারদের সম্পত্তি হয়ে যাওয়া নিয়ে অনুযোগ করেছিলেন কোজিয়ার। ওই সাক্ষাৎকারটি আবার পড়তে গিয়ে একটা কথায় চোখ আটকে গেল, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের মতো আমিও বোধ হয় শেষ প্রান্তে চলে এসেছি।’
কথাটা ধারাভাষ্য নিয়ে বলেছিলেন, না জীবন নিয়ে—এই সংশয়ের উত্তর ওই সাক্ষাৎকারে নেই। এখন আর সেই উত্তর খোঁজার দরকারই বা কী!
প্রথম প্রকাশ: ১৩ মে ২০১৬। প্রথম আলো।