এশিয়া কাপের আলোচিত পাঁচ

আরেকটি ফাইনাল-দুঃখে শেষ হয়েছে এশিয়া কাপ। তবে সেটি দিয়ে গেছে মনে রাখার মতো অনেক কিছুই। ঘটনা আর পারফরম্যান্স মিলিয়ে বাংলাদেশের আলোচিত পাঁচ, অন্য কারও চোখে যা অন্য রকমও হতে পারে—


১. তামিমের বীরত্ব

এই এশিয়া কাপের শুরুটাই মহানাটকীয়তায়। উদ্বোধনী দিনে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা, সাধারণ একটা গ্রুপ ম্যাচই তো! সেটিই হঠাৎ একটানে অন্য উচ্চতায় উঠে গেল তামিম ইকবালের সৌজন্যে। ইনিংসের শুরুতে হাতে বাউন্সারের ছোবল খেয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর জেনেছেন, হাড় ভেঙে গেছে। স্লিংয়ে হাত ঝুলিয়ে বসে থাকা তামিম আর ব্যাটিংয়ে নামতে পারবেন বলে কেউ ভাবেনি। মুশফিকুর রহিমকে সঙ্গ দিতে শেষ পর্যন্ত যে নামলেন, তাতে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার ভূমিকা আছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা তো তামিমই নিয়েছেন। ঝুঁকিটাও। ক্রিকেটে ভাঙা হাত নিয়ে ব্যাটিং এর আগেও অনেকে করেছেন। তবে ভাঙা হাত নিয়ে একটি, মাত্র একটিই বল খেলা নিয়ে এমন আলোড়ন আগে কখনো ওঠেনি। খেলার সীমানা ছাড়িয়ে সেটি যে হয়ে গেছে আরও অনেক বড়। ফাইনালের আগের দিনও মাশরাফি নইলে কেন বলবেন, ‘তামিম যখন ভাঙা হাত নিয়ে ব্যাটিং করতে নেমেছে, সেদিনই আমরা এশিয়া কাপ জিতে গেছি।’


২. মুশফিক মানেই ভরসা

ফাইনালের মুশফিক আসল মুশফিক নয়। তাঁর চিন্তাচেতনা, মানসিকতা, দলের প্রতি নিবেদন, ক্রিকেটীয় বুদ্ধিমত্তা—এসবের সঙ্গে কেদার যাদবের বলে ওই সময় ওই শটটা মেলানো যায় না। আবার এটাও তো ঠিক, মানুষ মাত্রই ভুল করে, খেলায় করে আরও বেশি। মুশফিকও করেছেন। না করলে কে জানে, আরেকটি ফাইনালও বাংলাদেশের জন্য হয়তো এমন স্বপ্নভঙ্গের অন্য নাম হয়ে থাকে না। মুশফিকের ব্যক্তিগত অর্জনের ডালাটাও আরেকটু ভরে ওঠে। ফাইনালের আগে এই এশিয়া কাপে তাঁর চেয়ে বেশি রান ছিল শুধু শিখর ধাওয়ানের। মাত্রই ৩০ রানের পার্থক্য। ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের লড়াইয়ে মুশফিক তাই ভালোভাবেই ছিলেন। ফাইনালে আরও ১৫ রান যোগ করেই যে স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন শিখর ধাওয়ান। শেষটা হয়তো সুন্দর হয়নি, তবে বাংলাদেশকে ফাইনালে তোলায় মুশফিকের অনেক বড় অবদান।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ১৪৪ রানের ক্যারিয়ার-সেরা ইনিংসটিতেই বাংলাদেশের সুপার ফোরে ওঠা। পাকিস্তানের বিপক্ষে অলিখিত সেমিফাইনালেও তিনিই নায়ক। পরে সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে যা বলেছেন, সেটিই মুশফিককে বোঝার জন্য যথেষ্ট, ‘৯৯ রানে আউট হওয়ায় দুঃখ নেই। কারণ আমরা জিতেছি। সেঞ্চুরি করার পরও দল হারলেই বরং দুঃখ পেতাম।’ তাঁর ব্যাটে ধারাবাহিকতা–সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরটা ছিল আরও দারুণ, ‘এটা এমন কিছু নয়। আমরা যারা দুই শর মতো ম্যাচ খেলে ফেলেছি, আমাদের তো প্রতি তিন ম্যাচের দুটিতে রান করা উচিত।’

৩. ফিজের ফেরা

অস্ত্রোপচারের ধকল সামলে আবার মাঠে ফেরার পর অনেকবারই বলা হয়েছে কথাটা—মোস্তাফিজ আবার দেখা দিচ্ছেন পুরোনো রূপে। সেই পুরোনো রূপটা কেমন, সেটি সবচেয়ে ভালো জানে ভারত। ঘটনাচক্রে ২০১৫ সালে মোস্তাফিজের মহা সাড়ম্বর আবির্ভাবের ওই ওয়ানডে সিরিজেই ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বশেষ জয়। সে সময় বলে যে গতি ছিল, এখনো তা পুরোপুরি ফিরে আসেনি। তবে তাঁর বোলিংয়ের বাকি সব কারুকাজ এবার পরিপূর্ণ মহিমাতেই প্রকাশিত। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সুপার ফোরের ম্যাচে তাঁর করা শেষ ওভারটি ক্রিকেটের ক্লাসে দেখানোর মতো। আফগানদের মাত্র ৮ রান করতে না দিয়ে বাংলাদেশকে টুর্নামেন্টে রেখেছিলেন মোস্তাফিজ। পাকিস্তানের বিপক্ষে পরের ম্যাচে আরও দুর্দান্ত। সেদিনের ৪৩ রানে ৪ উইকেটের ভিন্ন একটা তাৎপর্য আছে। ম্যাচের আগে ছিটকে পড়েছেন সাকিব আল হাসান, অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণের নেতা। মোস্তাফিজের কাঁধে তাই ছিল বাড়তি দায়িত্ব। বলা যায় প্রথমবারের মতো বোলিংয়ের নেতৃত্বভার। মোস্তাফিজ তাতে সাড়া দিয়েছেন ওয়ানডেতে ১৬ ম্যাচ পর আবার ৪ উইকেট নিয়ে। আইপিএলের সৌজন্যে ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা মোস্তাফিজকে খুব ভালো চেনেন। তারপরও ফাইনালে তাঁদের ভালোই ভুগিয়েছেন। ধোনি আর ভুবনেশ্বরকে আউট করে খুলে দিয়েছিলেন সম্ভাবনার দুয়ারও। শেষ ওভারটা মোস্তাফিজ করলে ৬ রানও হয়তো হয় না—এই আলোচনাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, ফিজ আসলেই ফিরেছেন।

৪. সবকিছুতেই রাজি মিরাজ

ফাইনালে তাঁর ওপেনিংয়ে নেমে যাওয়াটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তবে বলামাত্র যে মেহেদী হাসান মিরাজ রাজি হয়ে গেছেন, এতে একটুও অবাক হওয়ার কিছু নেই। দল তাঁর কাছে যা চায়, সেটি করতে তিনি সব সময়ই প্রস্তুত। ওয়ানডেতে এর আগে কখনো ছয় নম্বরের ওপরে ব্যাটিং করেননি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই না, এমনকি বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ারেও নয়। ফাইনালে ওপেন করতে নেমেই ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের রেকর্ড জুটির অংশীদার হয়ে গেছেন, না হলেও ব্যাপারটা প্রতীকী হয়ে বুঝিয়ে দিত মিরাজকে। তাঁর কাছে যেটি প্রথম চাওয়া, সেই বোলিংটা অবশ্য ফাইনালে এসে টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো ভালো হলো না। তারপরও দেখা যাচ্ছে, ইকোনমি রেট অর্থাৎ ওভারপ্রতি রান দেওয়ার বিচারে মিরাজের ওপরে আছেন শুধু জুনাইদ খান ও মুজিব উর রেহমান। মিরাজের ইকোনমি ৩.৫৬, মুজিব উরের ৩.৪৯। জুনাইদ মাত্র একটাই ম্যাচ খেলেছেন বলে তাঁর ২.১১ সেভাবে না ধরলেও চলে। ক্রিকেটার হিসেবে নিজেকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেওয়ার কাজটা এই এশিয়া কাপে ভালোমতোই করেছেন মিরাজ। তাঁকে সাকিব আল হাসানের উত্তরসূরি বলাটা মনে হচ্ছে না বাড়াবাড়ি কিছু।

৫. অবশেষে লিটন দাস

এই এশিয়া কাপটা লিটন তো অবশ্যই মনে রাখবেন। লিটনকেও মনে রাখবে এশিয়া কাপ। ফাইনালে যে ইনিংসটি খেলেছেন, তাতে মনে না রেখে উপায় কী! লিটনের ওই সেঞ্চুরি শুধুই একটা সেঞ্চুরির সীমা ছাড়িয়ে আরও বড় কিছু। ওপেনিংয়ে তামিম ইকবালের যোগ্য সঙ্গী খুঁজে বেড়ানো হচ্ছে আজ অনেক দিন। কতজনের সঙ্গে ওপেন করেছেন, তামিম নিজেও হয়তো তা মনে করতে পারবেন না। এই সেঞ্চুরির পর দীর্ঘস্থায়ী সমাধান মনে হচ্ছে লিটনকেই। তাঁর প্রতিভা নিয়ে সংশয় নেই। ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ কয়েক মৌসুম ধরে রানের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কখনো কখনো একটু ঝলকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছিল লিটনের প্রতিভার প্রদর্শনী। এই এশিয়া কাপে অন্য প্রান্তে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলেও লিটনের ওপর আস্থা রেখে গেছেন অধিনায়ক। অবশেষে সেই আস্থার প্রতিদান দিলেন লিটন। হয়তো সমাধান হয়ে এলেন বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যারও।