এমন বাবাই তো চাই
>টেস্ট ক্রিকেটের মেজাজ তাঁর রক্তের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই মিশিয়ে দিয়েছেন বাবা। এমনও বলেছিলেন, দরকার হলে শুধু টেস্ট ক্রিকেট খেলবে, অন্য কিছুর দরকার নেই। টি-টোয়েন্টির জয়-জয়কারের এই যুগে এমন টেস্ট-পাগল বাবা আর তাঁর ছেলের গল্পটা মুগ্ধ করার মতোই
বাবা বলে ছেলে নাম করবে। সে তো সব বাবাই বলে। শহিদুল ইসলামও ব্যতিক্রম নন। ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে তিনি পেশাগত সূত্রেই। সেটা শুধু পেশা নয়, নেশাও। সেই নেশা সংক্রমিত করতে চেয়েছেন ছেলের মধ্যেও। এ পর্যন্ত গল্পটায় খুব বেশি বিশেষত্ব নেই। তবে একটা জায়গায় এসে গল্পটা অন্য রকম হয়ে গেল। শহিদুল শুধু চাননি তাঁর ছেলে বড় ব্যাটসম্যান হোক, চেয়েছেন বড় ক্রিকেটের বড় ব্যাটসম্যান বানাতে। টি-টোয়েন্টি খেলাটা আরব মরুভূমিতে আরও শুকিয়ে যখন টি-টেনের জয়জয়কার ঘোষণার বন্দোবস্ত করে ফেলেছে, টি-টোয়েন্টি খেলা মানে যখন অনেক টাকার নিশ্চয়তা, ভালো একটা বাড়ি, ঝাঁ-চকচকে গাড়ির নিশ্চয়তা; এমন যুগেও শহিদুল তাঁর ছেলেকে বানাতে চেয়েছেন টেস্ট ব্যাটসম্যান! তাতে যদি টি-টোয়েন্টির সোনার ডিম পাড়া হাঁস না-ও মেলে, ক্ষতি নেই!
আজ সাদমান ইসলামের ব্যাটিংয়ে বাবার বুকের ছাতি নিশ্চয়ই কয়েক বিঘত বড় হয়ে গেছে। বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক শহিদুল আজ ম্যাচ শেষে প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘ওর ধৈর্য, শান্ত থাকাটা আমার কাছ থেকেই পাওয়া। টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের সংগ্রামই করতে হয়েছে বেশির ভাগ সময়ে। এ কারণে সব সময় ওকে একটা জিনিসই শিখিয়েছি, নিজের উইকেটের মূল্যটা বুঝবা। নিজের উইকেট সহজেই হারানো যাবে না। অনেক সময় অনেকে খুশি হতে পারে না ওর ব্যাটিংয়ের ধরনে। ওর খারাপ লাগে। তবুও বলি, তুমি এভাবেই খেলবে। দরকার হলে শুধু টেস্টই খেলবা। টেস্টের মর্যাদা অনেক। আমি ওকে ধৈর্য ধরাটাই শিখিয়েছি।’
ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে ধরে এ-মাঠে ও-মাঠে ঘুরেছেন। নিজেদের বাসার ড্রয়িংরুমের চেয়ে সাদমান বেশি চেনেন ক্রিকেটের অলিগলি। আজ ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে একটি কথা যেমন বেশ কবার বললেন, একবারও তাঁর মনে হয়নি টেস্ট ক্রিকেট খেলছেন। অথচ টেস্ট বলে নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেরই স্বাদ পেলেন আজ প্রথম। বাবার কথা বলছিলেন সাদমান, ‘বাবার ভূমিকা অবশ্যই আছে। আব্বু সব সময় ক্রিকেটে সহযোগিতা করেছেন। আমি সব সময় ক্যাম্পে যেতাম। অনূর্ধ্ব ১৫-১৭ ক্যাম্পে সব সময় আমাকে নিয়ে যেতেন। তখন আমি ছোট ছিলাম। তখন থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল খেলোয়াড় হব। যেভাবে আব্বু খেলার জন্য বলেছেন, সেভাবে খেলেছি। আমি একাডেমি কিংবা স্কুল ক্রিকেট থেকে ওভাবেই তৈরি হয়েছি। আমাকে অনেক সমর্থন করেছেন খেলার জন্য। কীভাবে খেলতে হয়, কীভাবে ক্রিকেটারদের জীবন থিতু করতে হয়, সেগুলো এখনো আমাকে বলেন। নিজেকে ওভাবেই গড়ে তোলার চেষ্টা করি।’
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট অবশ্য খেলছেন প্রায় চার বছর ধরে। সেখানেও পিতৃ-আজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছেন। তাঁর ব্যাটিং অনেকের মন জুগিয়ে চলেনি, তবে বড় দৈর্ঘ্যের মেজাজ কখনো হারাননি। সাদমান প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৩ হাজারের বেশি রান করেছেন যেখানে স্ট্রাইক রেটের চেয়ে (৪৫.৯০) চেয়ে গড় বেশি (৪৬.৫০)। তাঁর খেলার মধ্যে একটা সুস্থির সৌন্দর্য আছে। সাদমান বললেনও, ‘আমি সময় নিয়ে খেলতে পছন্দ করি। ধৈর্য ধরে, শান্ত থেকে ব্যাটিং করার চেষ্টা করি। আজও আমার পরিকল্পনা ছিল সেটাই। পরিকল্পনা ঠিকঠাক কাজেও লাগাচ্ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ইনিংসটা আরও লম্বা করতে পারিনি। খারাপ লাগা বলতে এটাই।’
ইনিংস লম্বার কথাই যখন বললেন, সেঞ্চুরির প্রসঙ্গটা তুললেন এক প্রশ্নকর্তা সাংবাদিক। সেঞ্চুরি হাতছাড়া করেছেন বলে কোনো আক্ষেপ নেই, বরং আক্ষেপ দলকে আরও একটু বেশি সময় দিতে না-পারায়; এ কথা যখন বলছিলেন, তাতে একবিন্দু বিনয় বা মিথ্যে আছে বলে মনে হয়নি। না, সেঞ্চুরি কে না চায়! তা তিনিও চেয়েছেন। অভিষেকটা আরও স্মরণীয় হতো, সে কি আর বলতে! তবে সাদমানের আক্ষেপ অন্য জায়গায়, ‘এমন কোনো হতাশা (সেঞ্চুরি না পাওয়ার) নেই। একটু তো সবারই থাকে...ডেব্যু ম্যাচে সেঞ্চুরির চাওয়া তো সবারই থাকে। তবে ও রকম কোনো হতাশা নেই। চেষ্টা করেছি দলের জন্য। যতটুকু দেওয়ার দরকার ছিল, সে রকম ব্যাটিং করেছি। হয়তো পুরোটা করতে পারিনি। যে রকম দরকার ছিল, সেভাবে শেষ করতে পারিনি। আমার মনে হয় আরেকটু দিতে পারতাম দলকে।'’
এখনো দ্বিতীয় ইনিংস বাকি। সুযোগ তিনি পাবেন আরও একটা। তবে সাদমান যখন গলা বাড়িয়ে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিচ্ছিলেন, বোঝাই যাচ্ছিল, তাঁর দৃষ্টিসীমা আরও অনেক দূরে।