অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হতে পারতেন, হতে পারতেন আলবেনিয়ার রাজা। এর বাইরেও যা করেছেন, সেটাই বিস্ময়ের শেষ সীমায় নিয়ে যায়। ইংল্যান্ডের হয়ে ক্রিকেট ও ফুটবল দুটিই খেলেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, করেছেন সাংবাদিকতাও। চার্লস বার্জেস ফ্রাই এমনই এক বিস্ময়ের নাম। তাঁর দেড় শতম জন্মবার্ষিকীতে দুই বছর আগে প্রকাশিত লেখাটি প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য আবার প্রকাশিত হলো।
ধরা যাক, আপনি একটা উপন্যাস লিখবেন বলে ঠিক করেছেন। আগেই ভেবে রেখেছেন, নায়ক হবেন একজন স্পোর্টসম্যান। ফুটবলার না ক্রিকেটার এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে ভুগতে একসময় বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন, দুটি হলেই সমস্যা কী! সব তো আমার হাতেই। আমি লেখক, আমার হাতে অসীম ক্ষমতা। তার ওপর একটু আগেই রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন, ‘সেই সত্যি যাহা রচিবে তুমি...’
চাইলে যা ইচ্ছা করতে পারেন। তারপরও দুটি খেলাতেই সমান ভালো হওয়াটা বাস্তবোচিত নয় ভেবে নায়কের ফুটবলে দক্ষতাটা একটু কমিয়ে দিলেন। সেটা খুব বেশি না, তাতেও নায়ক জাতীয় দলে খেলবে। ক্রিকেটে শুধু খেলবেই না, টেস্ট দলের অধিনায়কত্বও করবে এবং একটি টেস্টেও হারবে না। টেস্ট ক্যারিয়ার ২৬ ম্যাচেই থামিয়ে দিয়ে ফার্স্ট ক্লাস ক্যারিয়ারটা বর্ণাঢ্য করে সাজালেন।
ঠিক করলেন, সেটিতে রান হবে ৩১ হাজারের মতো। একটু ভেবে আরও সুনির্দিষ্ট হলেন—৩৯৪ ম্যাচে নায়ক করবেন ৩০ হাজার ৮৬৬ রান। ব্যাটিং গড় হবে ৫২.৬৬। ৩৯৪ ম্যাচ, শেষ দুই অঙ্কের সঙ্গে মিলিয়ে সেঞ্চুরি, তাহলে ৯৪টি হোক। যার ৬টি হবে টানা ছয় ইনিংসে। তাতে বিশ্ব রেকর্ডই নাহয় হলো। একটু-আধটু বোলিং করালেই–বা সমস্যা কি! ফাস্ট মিডিয়াম বোলিংয়ে তাই ১৬৬ উইকেটও পাইয়ে দিলেন তাঁকে। একটু মসলা যোগ করতে বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন তুলে বোলার-অধ্যায়টাকে নাহয় সংক্ষিপ্ত করে দিলেন।
একটু এদিক-ওদিক হলেই ফ্রাই হয়ে যেতে পারতেন আলবেনিয়ার রাজা! বিশ্বযুদ্ধের জেরে রাজপরিবার জার্মানিতে পালিয়ে যাওয়ায় নতুন রাজা খোঁজা হচ্ছিল। সি বি ফ্রাইকে দেখে ভীষণ পছন্দ হয়ে গিয়েছিল আলবেনিয়ার।
লেখকের ক্ষমতা ততক্ষণে আপনাকে উদ্দাম করে তুলেছে। আপনার মনে হচ্ছে, শুধু ফুটবল-ক্রিকেটই কেন, আমার নায়ক অ্যাথলেটিকসেও খুব ভালো হবে। স্প্রিন্ট, জ্যাভলিন, হাই জাম্প....সব কিছুতেই ভালো, তবে সবচেয়ে ভালো লং জাম্পে। কতটা ভালো, সেটি পরিষ্কার করতে এটিতে বিশ্ব রেকর্ড করিয়ে দেবেন তাঁকে। এখানেই না থেমে আপনি ভাবতে শুরু করেছেন, নায়ককে আর কী খেলায় নামানো যায়? গলফ, স্কেটিং, রোয়িং, স্কিইং, টেনিস...একটার পর একটা খেলার নাম আসছে মাথায়।
থাকুক না, সবগুলোই থাকুক। লিখলেই হবে, নায়ক এ সব খেলাতেই ভালো। রাগবি ইউনিয়নে আরেকটু বেশি ভালো। সেটিকে একটু এগিয়ে রাখা যাক। আপনার হাতে সর্বশক্তিমান কলম, নায়কের সিভিতে এসবও তাই যোগ হয়ে গেল। খেলায় যখন এত ভালো, ফুটবল-ক্রিকেট-অ্যাথলেটিকসে ইউনিভার্সিটি ব্লু তো পাবেই। রাগবিতেও চাইলে দিয়ে দেওয়া যায়। না, একটু অপূর্ণতা থাক্। একটা ইনজুরি-টিনজুরির কারণে রাগবির ব্লুটা নাহয় ফসকেই গেল।
খেলার অংশটুকু শেষ করে আপনার মনে হতে থাকল, সুযোগ যেহেতু আছেই, আরও কিছু করি। আমার নায়ক পড়াশোনাতেও খুব ভালো হবে। ভালো মানে সেরকম ভালো। বৃত্তি নিয়ে অক্সফোর্ডে পড়বে। ক্ল্যাসিকাল মডারেশনে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে বেরোবে। লাতিন আর গ্রিকে থাকবে বিশেষ দখল। এই দুই ভাষায় কবিতা-টবিতাও লিখবে। নামী পত্রিকায় তা ছাপাও হবে। সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা, লেখার হাত খুব ভালো। নায়কের কর্মকাণ্ডে সেটির কোনো ছাপ থাকবে না! ক্রিকেট–জীবনেই তাই সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয়ে যাবে। খেলা ছাড়ার পর পুরোদস্তুর সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এত পড়াশোনা, শুধু ক্রিকেট নিয়ে লিখে কি মন ভরে! ম্যাগাজিনের সম্পাদনার কাজেও নেমে যাবে নায়ক। মহাকালের কাছে চিহ্ন রেখে যেতে কিছু বইও তো থাকা দরকার। আপনার উপন্যাসের নায়ককেও তাই ঔপন্যাসিক বানিয়ে দেবেন। ভালো খেলতে পারেন, ভালো লিখতেও—ক্রিকেটের ওপর বই হবে না! সেটি ব্যাটিং টেকনিকের ওপর হলেই ভালো। অমন খটমটে জিনিস প্রাঞ্জল ভাষায় না হলে বোঝানো কঠিন। বইয়ের নামও ঠিক করে ফেললেন—‘ব্যাটসম্যানশিপ’।
প্রায় তিন দশকের ক্রিকেট–জীবন, কত গ্রেটদের সঙ্গে খেলেছেন, দেখেছেন আরও বেশি। আরও দুটি বই তাহলে যোগ হতেই পারে—একটা হোক গ্রেট ব্যাটসম্যানদের কর্মপদ্ধতি নিয়ে, গ্রেট ফিল্ডার ও বোলারদের নিয়ে আরেকটা। একই রকম নাম থাকুক দুটিরই। গ্রেট ব্যাটসম্যান: দেয়ার মেথডস্ অ্যাট আ গ্ল্যান্স এবং গ্রেট বোলারস্ অ্যান্ড ফিল্ডারস্: দেয়ার মেথড অ্যাট আ গ্ল্যান্স।
এমন বর্ণাঢ্য জীবন, সেটি অবশ্যই আত্মজীবনীতে লিপিবদ্ধ করে রাখা উচিত। সেই চিন্তা থেকে নায়ক আত্মজীবনীও লিখবেন। নাম কী হতে পারে? ‘লাইফ ওয়র্থ লিভিং’ হলে কেমন হয়!
এতক্ষণ শুধু নায়কের গুণ নিয়েই ভেবেছেন। তাঁর একটা চেহারাও তো আঁকা দরকার। সেটি ঠিক করে ফেললেন। দীর্ঘদেহী ছিপছিপে শরীর, লম্বাটে মুখে টিকোলো নাক, ঈষৎ কোঁকড়ানো চুল...কল্পনায় গ্রিক দেবতাদের যেমন দেখে মানুষ, ঠিক তেমন।
নায়কের এই চরিত্র চিত্রণের পর আপনার মন একটু খচখচ করতে লাগল। ‘সেই সত্যি যা রচিবে তুমি’ ঠিক আছে, কিন্তু নায়কের যে ছবিটা আঁকা হলো, সেটি তো আর ‘মানুষ’ থাকল না। রূপ নিয়ে নিল এক অতিমানবের। বিশ্বাসযোগ্যতার একটা ব্যাপার তো আছে, নাকি!
কথা তো সত্যিই! আপনিই বলুন না, এমন একজনকে নায়ক বানিয়ে কোনো উপন্যাস লেখা হলে সেটি পড়তে পড়তে হাসবেন না? ‘ধেৎ, যতসব গাঁজাখুরি গল্প’ বলে হয়তো আর পড়বেনই না।
রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতায় ‘সেই সত্যি যাহা রচিবে তুমি...’ বলার পরই বাল্মীকিকে নারদ বলছেন, ‘ঘটে যা, তা সব সত্য নহে’। এখানে একটু ব্যতিক্রম হচ্ছে। কল্পিত ওই উপন্যাসে নায়কের জীবনে যা যা ঘটেছে, তার সবই সত্যি। নায়কের নাম? চার্লস বার্জেস ফ্রাই। সি বি ফ্রাই নামে যিনি অমর হয়ে আছেন ক্রিকেটের ইতিহাসে। এবার নায়কের বদলে সি বি ফ্রাই বসিয়ে ওপরের অংশটা পড়ুন। অবিশ্বাস্য এক অলরাউন্ডারের সংক্ষিপ্ত জীবনী পড়া হয়ে গেল আপনার।
‘অলরাউন্ডার’ কথাটাকে এখানে শুধু ক্রিকেটীয় অর্থে ধরবেন না। জীবনের সব ক্ষেত্র মিলিয়েই অলরাউন্ডার। এর আগে কেউ এমন আসেনি, পরেও না, আর কোনো দিন আসবেও না। সিবি ফ্রাই যেন মূর্ত জীবনানন্দের ওই কবিতার পঙ্ক্তিতে—এই পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।
কল্পিত নায়কের বর্ণনা থেকে সি বি ফ্রাইয়ের ফার্স্ট ক্লাস ক্যারিয়ার আপনার জানা হয়ে গেছে। ১৮৯২ থেকে ১৯২১-২২ মৌসুম পর্যন্ত বিস্তৃত সেই ক্যারিয়ারে ইংল্যান্ড ছাড়াও খেলেছেন পাঁচটি দলে। তবে শেষ কাউন্টি সাসেক্সের সি বি ফ্রাই-ই স্মরণীয় হয়ে আছেন সবচেয়ে বেশি। এর একটা কারণ রণজিৎসিংজির সঙ্গে তাঁর যুগলবন্দী।
১৮৯০ থেকে ১৯১৪ সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগপর্যন্ত যে সময়টা নিয়ে রোমান্টিসিজম ‘গোল্ডেন এজ অব ক্রিকেট’ শব্দবন্দে প্রকাশিত, সেই সময়ের এক স্বর্ণালি অধ্যায় ফ্রাই আর রণজিৎসিংজির পার্টনারশিপ। ছাত্রজীবনে যে অঙ্ককে যমের মতো ভয় করে এসেছেন, ফ্রাইয়ের ব্যাটিং যেন ছিল সেই অঙ্ক। কোচিং ম্যানুয়াল মেনে চলা কপিবুক ইংলিশ ব্যাটিং। ফ্রাইয়ের ব্যাটিং যদি অঙ্ক হয়, রঞ্জির ব্যাটিং ছিল কবিতা।
উপমহাদেশীয় পেলব কবজির মোচড়ে ইংল্যান্ডকে তখন মাতোয়ারা করে তুলেছেন লেগ গ্ল্যান্সের উদ্ভাবক। নেভিল কার্ডাসই সম্ভবত লিখেছিলেন, ‘ফ্রাই আর রঞ্জি যখন জুটি বাঁধত, মনে হতো, পাশ্চাত্যের যুক্তিবোধ আর প্রাচ্যের শিল্পিতা হাত ধরে নাচছে।’ ব্যাটিংয়ে বিপরীত দর্শনের দুই ব্যাটসম্যান আবদ্ধ ছিলেন গভীর বন্ধুত্বে। মাঠের বাইরেও তাঁরা জুটি, তা আরও জমাট। সেটি ভেঙে দেওয়ার জন্য কোনো বোলার তো ছিল না।
লেগ গ্ল্যান্স যদি রঞ্জির সমার্থক হয়, ফ্রাইয়ের সমার্থক ছিল অন ড্রাইভ। শুধু ড্রাইভ শটটাই আছে তাঁর সম্বল, এক সমালোচকের এই কথার বড় চমৎকার জবাব দিয়েছিলেন ফ্রাই, ‘হতে পারে, আমার হাতে একটাই শট, তবে সেই শটে আমি মাঠের দশ জায়গায় বল পাঠাতে পারি।’
টানা ছয় ইনিংসে সেঞ্চুরির বিশ্ব রেকর্ড ১৯০১ সালে। যেটি টিকে আছে এখনো। প্রায় চার দশক একমেদ্বিতীয়ম হয়ে থাকার পর সেটিতে ভাগ বসান স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। এর আরও তিন দশক পরে মাইক প্রোক্টর। ফ্রাইয়ের টেস্ট রেকর্ডটা ততটা উজ্জ্বল নয়। সেঞ্চুরি মাত্র দুটি। ব্যাটিং গড় ৩২.১৮।
কাউন্টিতে এমন দোর্দণ্ড প্রতাপ, অথচ টেস্টে ম্রিয়মাণ। সি বি ফ্রাই যেন সেকালের গ্রায়েম হিক। অধিনায়ক হিসেবে অবশ্য পরাজয়ের সঙ্গে দেখাই হয়নি। ৬টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন ইংল্যান্ডকে। সব কয়টিই ১৯১২ সালে টেস্ট ইতিহাসের একমাত্র ট্রায়াঙ্গুলার টুর্নামেন্টে। টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষও সেখানেই। নয় বছর পর সেটি পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ অবশ্য এসেছিল। ১৯২১ অ্যাশেজে সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সাসেক্সের হয়ে দুই ইনিংসে ৫৯ ও ৩৭ রান করার পর নির্বাচকেরা আবার তাঁকে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ৪৯ বছর বয়সী ফ্রাই যা ফিরিয়ে দেন। ফিরিয়ে দেন সিরিজের মাঝপথে আরও একবার।
ক্রিকেট আর ফুটবলে মিলে গিয়েছিল তাঁর সেরা সময়টা। ১৯০১ সালে ইংল্যান্ডের হয়ে একমাত্র ম্যাচটি খেলেন আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। ১৯০২ সালে সাউদাম্পটনের জার্সি গায়ে খেলেন এফএ কাপ ফাইনাল। শেফিল্ড ইউনাইটেডের সঙ্গে সেই ফাইনাল ১-১ গোলে ড্র হয়। রিপ্লেতে সাউদাম্পটন হেরে যাওয়ায় ফ্রাইয়ের আর গলায় পদক পরা হয়নি। ব্যাটিংয়ের ধরনের সঙ্গে মিল রেখেই ফুটবলে ছিলেন ডিফেন্ডার। দুর্দান্ত অ্যাথলেটিসিজমের কল্যাণে শক্তির জায়গা ছিল দুরন্ত গতি।
যা হয়েছে, সেটিও অনন্য। তবে স্পোর্টসম্যান সি বি ফ্রাইয়ের মুকুটে হয়তো আরেকটি পালক যোগ হতো, যদি তিনি ১৮৯৬ সালে ইতিহাসের প্রথম অলিম্পিকে যেতে পারতেন। এর তিন বছর আগেই অক্সফোর্ডে ইউনিভার্সিটি ট্রায়ালে তাঁর বিশ্ব রেকর্ড ছোঁয়া ২৩ ফুট ৬ ইঞ্চির সেই লং জাম্প। পরের বছর লন্ডনে প্রথম আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিকসে জিতেছেন স্প্রিন্ট ও লং জাম্প।
লং জাম্পের বিশ্ব রেকর্ডটি খুব বেশিদিন টেকেনি, তবে ইউনিভার্সিটি রেকর্ড হিসাবে টিকে ছিল দীর্ঘ ২১ বছর। এর অনেক আগেই অনেকগুলো নিকনেম হয়ে গেছে ফ্রাইয়ের। চার্লস দ্য থার্ড, লর্ড অক্সফোর্ড...এসবও যথেষ্ট মনে না হওয়ায় ‘অলমাইটি’! ফ্রাইয়ের অলিম্পিকে যেতে না পারার একটা কারণ, দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট সফর। আরেকটা কারণ, এথেন্স অলিম্পিক নিয়ে প্রচার–প্রচারণাও সেভাবে হয়নি।
উপন্যাসের কল্পিত নায়কের মোড়কে শুরু করেছিলাম সি বি ফ্রাইয়ের গল্প। আসলে তো কল্পকাহিনিকেও হার মানায় তাঁর জীবনের সত্যিকার কাহিনি। কত নাটকীয়তার ছড়াছড়ি তাতে! যার কিছু কল্পকথাই মনে হতে বাধ্য। যেমন এটা কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়, একটু এদিক-ওদিক হলেই ফ্রাই হয়ে যেতে পারতেন আলবেনিয়ার রাজা! সেই প্রস্তাব কিন্তু সত্যি পেয়েছিলেন তিনি। ১৯২১ সালে জেনেভায় লিগ অব নেশনসের সম্মেলন। যাতে ভারতের তিন প্রতিনিধির একজন মনোনীত হয়েছেন রণজিৎসিংজি।
তত দিনে যিনি ভারতে ফিরে হয়ে গেছেন হিজ হাইনেস কুমার রণজিৎসিংজি, জামসাহেব অব নবনগর। তাঁর বক্তৃতা লেখার জন্য রঞ্জি সঙ্গে নিয়ে গেছেন বন্ধু ফ্রাইকে। সেখানেই আলবেনিয়ার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দেখা। বিশ্বযুদ্ধের জেরে আলবেনিয়ার রাজপরিবার জার্মানিতে পালিয়ে যাওয়ায় নতুন রাজা খুঁজছে তারা। শর্ত দুটি। এক. নতুন রাজার ধমণীতে থাকতে হবে ইংরেজ–রক্ত। দুই. বার্ষিক আয় থাকতে হবে কমপক্ষে দশ হাজার পাউন্ড। সি বি ফ্রাইকে দেখে তাদের ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল। কিন্তু ব্যাপারটা ভেস্তে গেল টাকার কারণে। অত টাকা ফ্রাই কোথায় পাবেন?
হতে পারে, আমার হাতে একটাই শট, তবে সেই শটে আমি মাঠের দশ জায়গায় বল পাঠাতে পারি।
টাকাপয়সা নিয়ে ফ্রাই সারা জীবনই ভুগেছেন। বেহিসেবি খরচের হাত অক্সফোর্ডে থাকতেই তাঁকে দেনায় জর্জরিত করে তুলেছে। টাকার জন্য প্রাইভেট পড়িয়েছেন, ন্যুড মডেল পর্যন্ত হয়েছিলেন একবার। মানসিক রোগের প্রথম লক্ষণও দেখা দেয় তখনই। পরে যা আবারও ফিরে ফিরে এসেছে। মানসিক রোগের ঠিকুজি বের করা কঠিন। কে জানে, এমন বহুমুখী প্রতিভা ধারণ করাটা ফ্রাইয়ের জন্য বিষম চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল কি না! গ্ল্যামার, খ্যাতি, জনপ্রিয়তার ঝলমলে আলোর আড়ালে অন্ধকার একটা দিকও তো ছিল ফ্রাইয়ের জীবনে। রাজনীতি করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। ঘরেও দুদণ্ড শান্তি মেলেনি। বিয়ে করেছিলেন বয়সে দশ বছরের বড় বিয়েত্রিস হোম সামনারকে।
স্ত্রীর সঙ্গে যৌথভাবেই লিখেছেন তাঁর একমাত্র উপন্যাস মাই মাদার্স সান। বিয়েত্রিস সম্পর্কে যা জানা যায়, তাতে সন্দেহ হয়, নিজের নামটা যোগ করতে ফ্রাইকে তিনি বাধ্য করেছিলেন কি না! প্রচণ্ড বদমেজাজী ও কর্তৃত্বপরায়ণ এক মহিলা, তার ওপর এক ধনাঢ্য ব্যক্তির প্রেমিকা। সম্পর্কের ধরনে রক্ষিতা বলাই ভালো। যাঁর ঔরসে বিয়েত্রিস সন্তান পর্যন্ত ধারণ করেছেন।
ফ্রাইয়ের মানসিক রোগ আবারও মাথাচাড়া দেওয়ার পেছনে বিয়েত্রিসেরও দায় দেখেন অনেকে। অমন প্রতাপশালী এক পুরুষের দাম্পত্য জীবন কেটেছে কি না সারাক্ষণ বউয়ের ভয়ে জড়সড় হয়ে। তখনো সেটি গোপন ছিল না। পরে তো নয়ই। ফ্রাইয়ের জামাতা শাশুড়ি সম্পর্কে প্রকাশ্যেই বলেছেন, এই মহিলার সঙ্গে বিয়ে হলে যে কারোরই মেন্টাল ব্রেক ডাউন হতো। বিষময় সেই দাম্পত্য জীবন কেন এবং কীভাবে ৪৮ বছর স্থায়ী হলো, তা একটা বিস্ময়ই বটে। সেটিরও সমাপ্তি বিয়েত্রিসের মৃত্যুতে। শুধু সি বি ফ্রাইয়ের জন্যই নয়, তিন ছেলেমেয়ের জন্যও যা ছিল একরকম মুক্তির অনুভূতি। ছেলে স্টিভেন ফ্রাই ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলেছেন, স্টিভেনের ছেলে চার্লসও। মৃত্যু নাকি সব তিক্ততা মুছে দেয়। অথচ সি বি ফ্রাইয়ের জীবনীকারকে স্টিভেন ফ্রাই সরাসরিই বলেছেন, ‘আমার মা আমার বাবার জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’
উপন্যাসের ধোঁকা দিয়ে শুরু হয়েছিল লেখাটা। উপন্যাসের আলোকেই যদি ভাবি, নানামুখী প্রতিভায় ভাস্বর সি বি ফ্রাইয়ের আপাত অবাস্তব এক জীবনে দুঃখের এই মোচড়টা বোধ হয় দরকার ছিল। সুখ-দুঃখ মিলিয়েই তো উপন্যাস। নইলে তো সি বি ফ্রাইয়ের জীবনকে মনে হতো রূপকথার কোনো গল্প। তাঁর কীর্তি আর অর্জনের ডালার দিকে তাকালে তারপরও কি তেমনই মনে হয় না! এত কিছু বলেও তো মনে হচ্ছে, আরও কিছু বাকি রয়ে গেল। অনেক কিছু বিস্তারিত বলা হলো না। খেলার বিস্ময় কী না করেছেন খেলা ছাড়ার পর! শিক্ষকতা করেছেন, পত্রিকায় লিখেছেন ফুটবল-ক্রিকেট দুটি নিয়েই। ইভেনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় ক্রিকেট রিপোর্টিং করার পাশাপাশি কলাম লিখেছেন অনেক বছর। পত্রিকার সার্কুলেশন বেড়ে গেছে তাঁর নিজস্ব লেখার ধরনের কারণে। রেডিওতে কমেন্ট্রি করেছেন। তরুণদের জন্য সি বি ফ্রাইস্ ম্যাগাজিন ও দ্য ক্যাপ্টেন নামে ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন।
ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জন্য দরিদ্র তরুণদের প্রশিক্ষিত করার মেরিন স্কুলের দায়িত্বে ছিলেন ৪২ বছর। সম্মানসূচক ক্যাপ্টেন র্যাঙ্ক দিয়ে রয়্যাল নেভি যেটির স্বীকৃতি দেয়। ট্রেনিং স্কুল মারকারি, সংক্ষেপে টিএস মারকারি নামের যে জাহাজটি ছিল এই প্রশিক্ষণস্থল, সেটির মালিক ছিলেন ফ্রাইয়ের স্ত্রী বিয়েত্রিসের ওই প্রেমিক। মধ্য ত্রিশের দশকে অ্যাডলফ হিটলারের আমন্ত্রণে জার্মানিতে গিয়েছিলেন জার্মান তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে। বয়স ষাট পেরোনোর পর সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ খুঁজতে পাড়ি জমিয়েছেন হলিউডে। সি বি ফ্রাইয়ের জীবন যেন এক অনিঃশেষ গল্প। এমন কেউ আর আসবে না কোনো দিন। জীবনানন্দের কাছ থেকে ধার নিয়ে ওই যে বললাম, ‘এই পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।’
এই পৃথিবী ১৪৮ বছর আগে এই দিনে পেয়েছিল চার্লস বার্জেস ফ্রাইকে। হ্যাপি বার্থডে, মিস্টার ফ্রাই! হ্যাপি বার্থডে!