অবসর, প্রত্যাবর্তন, এরপর বিশ্বকাপ রেকর্ডে নাম এঙ্গেলব্রেখটের
ছেলেটি না বলে লোকটি বলাই ভালো। ৩৫ বছর বয়সী কাউকে ‘ছেলেটি’ বলা ঠিক মানায় না। তবে সাত বছর আগে তাঁর মধ্যে তারুণ্যের যথেষ্টই অবশিষ্ট ছিল। তখন ক্রিকেটকে তাঁর আরও বেশি করে ভালোবাসার কথা। কিন্তু সিব্র্যান্ড এঙ্গেলব্রেখট সেই তারুণ্যেই (২০১৬ সালের ডিসেম্বরে) কিনা ছেড়েছিলেন ক্রিকেট!
ভাগ্যের কী লীলা, সাত বছর পর সেই এঙ্গেলব্রেখটেরই আন্তর্জাতিক অভিষেক ঘটল এবারের বিশ্বকাপে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নেদারল্যান্ডসের ৯৯ রানে হারের ম্যাচে ৩৪ বলে ২৯ রান করে অভিষিক্ত হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। একদম খারাপও বলা যায় না। রায়ান ক্লাইন ও আরিয়ান দত্তের সঙ্গে তাঁর দুটি মাঝারি রানের জুটিতে ২০০ পার হয়েছিল নেদারল্যান্ডসের।
এর পরের ম্যাচে জন্মভূমি দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৩৭ বলে ১৯ রানের ইনিংসে তেমন ভালো করতে পারেননি। কিন্তু আজ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৮২ বলে ৭০ রানের ইনিংসে এঙ্গেলব্রেখট বুঝিয়ে দিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলের হয়ে খেলার যোগ্যতা তাঁর কোনো অংশে কম ছিল না! আগে ব্যাট করা ডাচরা ৪৩ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল। দলীয় সংগ্রহ ১০০ হয় কি না সন্দেহ!
সপ্তম উইকেট জুটিতে অধিনায়ক লোগান ফন বিককে সঙ্গে নিয়ে ১৩০ রানের জুটি গড়েন এঙ্গেলব্রেখট। তাতে নেদারল্যান্ডস যেমন ২৬২ রানের পুঁজি পেয়েছে, তেমনি এঙ্গেলব্রেখটও পেয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে নিজের প্রথম ফিফটি। অথচ এসবের কোনো কিছুই হওয়ার কথা ছিল না। সাত বছর আগে ক্রিকেট ছাড়ার পর এখন বিশ্বকাপে খেলবেন, সেটা স্বয়ং এঙ্গেলব্রেখটই কি তখন ভাবতে পেরেছিলেন?
লক্ষ্ণৌয়ে গত মঙ্গলবার নেদারল্যান্ডস-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচে এঙ্গেলব্রেখটের ব্যাটিংয়ে তেমন ভালো করতে না পারার কারণ হিসেবে কেউ কেউ রসিকতাও করতে পারেন। এঙ্গেলব্রেখট সম্ভবত স্মৃতির ঝাঁপিতে ডুব দিয়েছিলেন, তাই মাঠে মনোযোগ ছিল না!
প্রিটোরিয়ায় এবি ডি ভিলিয়ার্স ও ফাফ ডু প্লেসি যে স্কুলে পড়েছেন, এঙ্গেলব্রেখট সেই স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র। ২০০৮ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে অবিশ্বাস্য একটি ক্যাচ নিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছিলেন এঙ্গেলব্রেখট। তখন তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়। দেশটির ঘরোয়া ক্রিকেটে ৫৪টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ, ৫৭টি লিস্ট এ ও ৪৫টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার পর এঙ্গেলব্রেখট বুঝতে পেরেছিলেন নিকট ভবিষ্যতে ক্রিকেটে তাঁর ক্যারিয়ার খুব একটা এগোবে না। তাই মনোযোগটা ক্রিকেট থেকে সরিয়ে নিয়ে মাত্র ২৮ বছর বয়সে অবসর ঘোষণা করেছিলেন।
কিন্তু ভবিষ্যতে অন্য পথে হাঁটতে কিছু কাজ অবসর নেওয়ার আগেই সেরে রেখেছিলেন এঙ্গেলব্রেখট। ফিন্যান্সে ডিগ্রি নেওয়ার পাশাপাশি প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টেও পোস্টগ্র্যাজুয়েশন সেরে রেখেছিলেন। ক্রিকইনফোকে কিছুদিন আগে এঙ্গেলব্রেখট বলেছেন, ‘২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ফেয়ারট্রি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেছিলাম। করপোরেট ক্যারিয়ারে দুই বছরের মধ্যে এমবিএ-ও করেছি। অর্থাৎ কয়েক বছর ক্রিকেট থেকে দূরে ছিলাম।’
২০২১ সালের জানুয়ারিতে ইউরোপে ব্যবসার পদক্ষেপ নেয় ফেয়ারট্রি। রিয়েল এস্টেট ও ইক্যুইটি বিজনেস সম্প্রসারণ করতে প্রজেক্টের প্রধান হিসেবে এঙ্গেলব্রেখটকে পাঠানো হয় নেদারল্যান্ডসে। তখন ছুটির দিনে বিনোদনমূলক ক্রিকেট খেলতেন।
এঙ্গেলব্রেখট সে সময় স্মরণ করে বলেছিলেন, ‘পরিবারের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসে যাওয়ার পর আমি আবারও ব্যাট হাতে তুলে নিই। কারণ, তাদের সমাজে মিশে যেতে এবং বন্ধু বানাতে এটাই ছিল সবচেয়ে সহজ পথ। তবে ব্যাট হাতে তুলে নেওয়ার পর বুঝলাম, আমি ক্রিকেট কতটা মিস করেছি! আবারও খেলাটির ভালোবাসায় পড়ে যাই।’
বিনোদনমূলক ক্রিকেট থেকে ধীরে ধীরে ডাচদের ক্লাব ক্রিকেটে ঢুকে পড়েন এঙ্গেলব্রেখট। ডাচদের অন্যতম সেরা ক্লাব ভুরবার্গ ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে টানা তিনটি ফাইনাল খেলেছেন। চাকরি আর খেলা পাশাপাশি চালিয়েই ডাচদের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ক্রিকেটে নাম লিখিয়েছিলেন। ডাচদের প্রধান কোচ রায়ান কুক তাঁকে প্রায় এক দশক আগে থেকেই চিনতেন। সেটি দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটে কেপ কোবরা ফ্র্যাঞ্চাইজি দলে। কুক তাঁকে ডাচ জাতীয় দলে নেওয়ার পথ খুঁজছিলেন। ডাচদের ক্রিকেট বোর্ডও (কেএনসিবি) আগ্রহী ছিল। গত জুনে বিশ্বকাপ বাছাই শেষেই এই প্রচেষ্টা শুরু হয়ে যায়।
এঙ্গেলব্রেখটের ভাষায়, ‘আমি নিজেও এটা নিয়ে খোঁজখবর নিয়েছি এবং কথা বলেছি। আইসিসিতে খোঁজ নেওয়ার পর তারা জানাল “আমি (ডাচদের হয়ে) খেলার যোগ্য।”এরপর সবকিছু খুব দ্রুতই ঘটে গেল। এক সপ্তাহ পরই নেদারল্যান্ডস এ দলের হয়ে অভিষিক্ত হই।’
এঙ্গেলব্রেখট জানিয়েছেন, প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে আসার পর তাঁর কর্মস্থল আরও প্রেরণা জুগিয়েছে। বিশ্বকাপে এঙ্গেলব্রেখট যেন খেলতে পারেন, সে জন্য তাঁর ওপর থেকে কাজের চাপ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
সেই এঙ্গেলব্রেখট ক্রিকেটে ফিরে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেললেন বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে। আর আজ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে লোগান ফন বিককে (৫৯) সঙ্গে নিয়ে সপ্তম উইকেটে গড়েছেন রেকর্ড।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে সপ্তম উইকেটে সর্বোচ্চ রানের (১৩০) জুটি গড়েছেন এঙ্গেলব্রেখট। ভেঙেছেন ২০১৯ বিশ্বকাপে গড়া মহেন্দ্র সিং ধোনি ও রবীন্দ্র জাদেজার রেকর্ড। তা–ও দল যখন বিপদে, সেই মুহূর্তে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে!
অথচ বিশ্বকাপ তো দূরের কথা এঙ্গেলব্রেখটের ক্রিকেটেই থাকার কথা ছিল না। ক্রিকেট সত্যিই খুব মজার খেলা!