ভারত: ৫০ ওভারে ৩৯৭/৪
নিউজিল্যান্ড: ৪৮.৫ ওভারে ৩২৭
ফল: ভারত ৭০ রানে জয়ী
মোহাম্মদ শামির এমনিতেও আলোচনায় থাকার কথা ছিল। ড্যারিল মিচেলের সঙ্গে কেইন উইলিয়ামসনের জুটিটা যখন ভারতের জন্য একটু হলেও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে, তখনই গ্যালারি থেকে একটা হুস শব্দ উঠল। হতাশার প্রকাশ, অবিশ্বাসেরও। অমন সহজ একটা ক্যাচ কীভাবে ফেলে দেন মোহাম্মদ শামি!
এসব সময় স্টিভ ওয়াহ ফিরে আসেন। হার্শেল গিবসও। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে হেডিংলির সেই ম্যাচ। হার্শেল গিবস আগেই উদ্যাপন করতে গিয়ে স্টিভ ওয়াহর ক্যাচ ফেলে দিলেন। স্টিভ ওয়াহ তাঁকে বললেন, ‘বাছা, তুমি তো এইমাত্র বিশ্বকাপটাই ফেলে দিলে!’ পরে স্টিভ ওয়াহ জানিয়েছেন, কথাটা ঠিক ওভাবে তিনি বলেননি। কিন্তু গল্পটা এত সুন্দর যে তথ্য দিয়ে তা নষ্ট করতে চায়নি কেউ। ওটাই চলছে।
শামিও বিশ্বকাপটা ফেলে দিলেন কি না, এই প্রশ্ন তখন উঠছে। যদিও নিউজিল্যান্ডের গন্তব্য তখনো অনেক দূর। ৩৯৮ রানের পাহাড়ে চড়তে বলা হয়েছে তাদের। সেই পথের অর্ধেকটাও পেরোনো হয়নি। রান ২ উইকেটে ১৮৬। তারপরও মিচেল ও উইলিয়ামসনের জুটি যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে অসম্ভবও সম্ভব হয়ে যাওয়াটাকে ঠিক উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। দুপুর থেকে ওয়াংখেড়ের মুখর গ্যালারি অনেকটাই নীরব। রোহিত শর্মা পরে বলবেন, এই ওয়াংখেড়ে তাঁর খুব চেনা। কোনো স্কোর করেই এখানে নিশ্চিন্ত থাকার কোনো উপায় নেই। ওই সময়টায় তিনিও একটু চিন্তাতেই পড়ে গিয়েছিলেন।
তা মোহাম্মদ শামি তখন কী করতে পারেন? যে ভুল করেছেন, তা তো আর সংশোধনের কোনো পথ নেই। তবে নিজেই যেহেতু বোলার, কিছু করার সুযোগ তো ছিলই। তাই বলে এতটা? এর আগে নিউজিল্যান্ডের প্রথম দুটি উইকেটই নিয়েছেন। সেটি নিজের প্রথম দুই ওভারেই, প্রথমটি তো প্রথম বলেই। ক্যাচ ফেলে যে উইলিয়ামসনকে নতুন জীবন দিয়েছেন, তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার কাজটাও নিজেই করলেন। নতুন জীবনে তাঁকে ১৭ রানের বেশি করতে না দিয়ে। এক বল পরই তাঁর শিকার নতুন ব্যাটসম্যান টম ল্যাথামও। প্রায়শ্চিত্ত তো হয়েই গেল।
মোহাম্মদ শামির হয়তো মনে হলো, এটাও যথেষ্ট নয়। যে কারণে ম্যাচের সমাপ্তিও তাঁর হাতে। যখন তাঁর নামের পাশে ৭ উইকেট। শিকারের তালিকায় নিউজিল্যান্ডের হয়ে একাই লড়ে যাওয়া ড্যারিল মিচেলও আছেন। বিশ্বকাপে পঞ্চমবারের মতো কোনো বোলারের ৭ উইকেট নেওয়ার কীর্তি। শুধু রান একটু বেশি দিয়ে ফেলেছেন বলে সেরা বোলিংয়ের তালিকায় নামটাও ৫ নম্বরে। ম্যাচ শেষ হওয়ার একটু পরই ক্রিকইনফোর কমেন্টারিতে এক পাঠকের মন্তব্যটাও মনে হচ্ছে শামির বোলিংয়ের মতোই দুর্দান্ত। এটা সেমিফাইনাল নয়, শামি–ফাইনাল।
ম্যাচ শেষ হওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ওয়াংখেড়ের প্রেসবক্সের ঠিক নিচে তুমুল উৎসব শুরু হয়ে গেল। ঢাক বাজছে, আর সেটির তালে তালে চলছে নাচ। আহমেদাবাদের প্রস্তুতিও। ১২ বছর আগে এই ওয়াংখেড়েতে ধোনির ছক্কায় শেষ হওয়া ফাইনালে বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। এবার আরেকটি বিশ্বকাপ জয়ের দুয়ারেও পৌঁছে দিল ওয়াংখেড়ে। রাউন্ড রবিন লিগে টানা ৯ ম্যাচে ভারতের জয়রথ সেমিফাইনালেও হয়ে থাকল একই রকম অপ্রতিরোধ্য। ১৯ নভেম্বর আহমেদাবাদের ফাইনালে প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়াই হোক বা দক্ষিণ আফ্রিকা, ম্যাচ–পূর্ব ফেবারিটের তকমাটা থাকবে ভারতের গায়েই।
ম্যাচের আগে উইকেট নিয়ে বড় বিতর্ক। আগেই ঠিক করে রাখা নতুন উইকেটের বদলে খেলা হচ্ছে এর পাশের উইকেটে। যেখানে এর আগে বিশ্বকাপের দুটি ম্যাচ হয়েছে। আগে ব্যবহৃত উইকেটে সেমিফাইনাল হতে পারবে না, এমন কোনো নিয়ম নেই। এত লম্বা টুর্নামেন্টের শেষ দিকে আগের পরিকল্পনা বদলে যাওয়াও নতুন কিছু নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে আইসিসি।
কিন্তু জানিয়েছে তো সংবাদমাধ্যমে খবরটা প্রকাশিত হওয়ার পর। যে খবরের উৎস আবার আইসিসি নিযুক্ত পিচ বিশেষজ্ঞ অ্যান্ডি অ্যাটকিনসনের ফাঁস হয়ে যাওয়া ই-মেইল। যাতে পরিষ্কারই নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিতে এমনিতেও কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ভারতের চাওয়া পূরণ করতেই ব্যবহৃত উইকেট। স্পিনাররা যাতে বেশি সুবিধা পান।
নিউজিল্যান্ডের অবশ্য খুব একটা অভিযোগ করার সুযোগ নেই। তাদের ব্যাটিং করার সময় বল এমন কোনো টার্ন করেনি। সর্বনাশও তো কোনো স্পিনারের হাতে নয়। উইকেট তো দুই দলের জন্য একই থাকে। কোন উইকেটে খেলা, ওয়াংখেড়েতে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, টসে জিতেছে কোন দল। বিশ্বকাপে এই মাঠে আগে ব্যাটিং করা আর পরে ব্যাটিং করায় এমনই আকাশ-পাতাল পার্থক্য যে রোহিত শর্মা টসে জেতার পর প্রেসবক্সে একটা রসিকতা খুব বাজার পেল। ক্রিকেট ইতিহাসে এই প্রথম নাকি কোনো অধিনায়ক টস জেতার পর তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি, তিনি কী করতে চান।
ওয়াংখেড়েতে টসে জিতে ব্যাটিং করাটা নিয়ম। একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে নিয়ম সাড়ে তিন শর বেশি রান করাও। দক্ষিণ আফ্রিকা তো দুই ম্যাচে চার শই করে ফেলেছিল প্রায়। ভারতও তা-ই করল। মাত্র ৩ রানের জন্যই যা হলো না। রোহিত শর্মা এই বিশ্বকাপে নিজে মরার ঝুঁকি নিয়ে প্রতিপক্ষকে মারার মিশন নিয়ে ব্যাটিং করতে নামছেন। ১৬২ স্ট্রাইক রেটের ২৯ বলে ৪৭ রানের ইনিংসে এদিনও তাতে সফল। নবম ওভারে যখন আউট হয়ে ফিরছেন, স্কোরবোর্ডে উঠে গেছে ৭১ রান।
এই বিশ্বকাপে রোহিত শর্মা শুরুর জ্বালানিটা দিয়ে যাচ্ছেন, এরপর ভারতকে টেনে নিচ্ছে কোহলি-ইঞ্জিন। আর এদিন তো ভারতের ইনিংস পুরোপুরিই কোহলিময়। শ্রেয়াস আইয়ার যে সেঞ্চুরিটা করেছেন, তাতে যেকোনো দিন তাঁকে নিয়ে অনেক কাব্য হতো। কিন্তু এটি যে বিরাট কোহলির দিন। যেদিন তিনি শৈশব-কৈশোরের নায়কের সামনে একের পর এক তাঁর রেকর্ড ভাঙতে থাকবেন। ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির রেকর্ডে একক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার আগেই এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড। যেটিও ছিল শচীন টেন্ডুলকারেরই।
ম্যাচটা শুধুই বিরাট কোহলির হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে খুশি থাকতে হলো পার্শ্বনায়ক হয়েই। তাহলে নায়কের নাম? আর কে, মোহাম্মদ শামি!