গাদ্দাফি স্টেডিয়ামটা বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টাই চোখের সামনে থাকছে। কাল রাতে যেমন হোটেলের জানালা দিয়ে অনেকটা সময় ফ্লাডলাইট জ্বলে থাকার দৃশ্য চোখে পড়ল। নইলে এমনিতে রাতের বেলায় নিশতার পার্ক স্পোর্টস কমপ্লেক্সের ভেতর গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের আশপাশের রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের বাতি ছাড়া আর কিছু জ্বলতে দেখা যায় না। প্রায় অন্ধকারে ঢেকে থাকে পুরো এলাকা। স্টেডিয়ামের এত কাছে থেকেও তাই বোঝার উপায় নেই এখানে একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট চলমান এবং সেই টুর্নামেন্টের প্রথম সেমিফাইনাল আজ!
সেটাই হওয়ার কথা, কারণ আজ তো আর সেমিফাইনাল লাহোরে হচ্ছে না। হচ্ছে দুবাইয়ে। ভারত–অস্ট্রেলিয়া প্রথম সেমিফাইনাল লাহোরে না হয়ে দুবাইয়ে কেন হচ্ছে, কেন চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালও সেখানেই হতে পারে; এসব অজানা নয় কারও। বিশ্ব ক্রিকেটে ভারতের কথাই শেষ কথা বলে পাকিস্তানকে হাইব্রিড চ্যাম্পিয়নস ট্রফির থিওরি মেনেই এই টুর্নামেন্টের আয়োজক হতে হয়েছে। ভারতের বিপক্ষে এমনকি স্বাগতিক পাকিস্তানকেও গিয়ে খেলতে হয়েছে দুবাইয়ে। ওদিকে শেষ চারের আগে সব দলই ফাঁকা সময়টা পাকিস্তানের চেয়ে দুবাইয়ে কাটানোটাকে শ্রেয় মনে হয়ছে। পাকিস্তানের দিক থেকে এসবের দারুণ জবাব হতে পারত, যদি পাকিস্তান দলটা টুর্নামেন্টে ভালো কিছু করত। সেমিফাইনালের আগেই তারা টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়ায় তা হয়নি।
অবশ্য পাকিস্তানে সেমিফাইনালের আলো যে নিউজিল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা কালকের ম্যাচেও পড়বে, সে নিশ্চয়তা নেই। এই ম্যাচ নিয়ে গতকাল পর্যন্তও কোনো আলোচনা ছিল না এখানে। দেখা যায়নি লাহোরের স্টেডিয়াম পাড়ায় কোনো চাঞ্চল্য। সে রকম থাকার কথাও নয় অবশ্য। দ্বিতীয় সেমিফাইনালের দুই দল—নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা দুবাই থেকে লাহোরে আসবেই তো আজ।
হোটেলের জানালায় ফিরে আসা যাক। এখানে দাঁড়ালে ফিরোজপুর রোডের ওপারের গাদ্দাফি ক্রিকেট স্টেডিয়াম, ন্যাশনাল হকি স্টেডিয়াম, ন্যাশনাল স্পোর্টস একাডেমি, ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমি, লাহোর ক্রিকেট একাডেমি, টেনিস ও ব্যাডমিন্টন কোর্ট, আল–হামরা ওপেন এয়ার থিয়েটার মিলিয়ে প্রায় পুরো নিশতার পার্ক স্পোর্টস কমপ্লেক্সটাই একসঙ্গে দৃশ্যমান হয়। কিন্তু দাঁড়িয়ে দেখবেন আসলে নিথর, নিস্তব্ধ ক্রীড়া স্থাপনার সারি। কোথাও কেউ নেই, কোথাও কিছু নেই। আছে শুধু প্রবেশপথগুলোয় নিরাপত্তাচৌকি।
পাকিস্তানের বিদায়ের পর ‘মৃত’ একটা টুর্নামেন্ট নিয়ে এই দেশের মানুষের আগ্রহ থাকার কোনো কারণ নেই। ব্যর্থতার জন্য ক্রিকেটার আর ক্রিকেট বোর্ডকে কচুকাটা করার রেওয়াজ অবশ্য এখানেও আছে এবং একটু বেশিই আছে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি উপলক্ষে পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটাররা কোনো না কোনো টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে বিশ্লেষক হিসেবে চুক্তিবদ্ধ। তাঁদের কথার বাণে প্রতিনিয়তই এফোঁড়–ওফোঁড় হচ্ছে পাকিস্তানের বর্তমান ক্রিকেট।
তবে এর মধ্যেও আজ দুবাইয়ের সেমিফাইনালের দিকে একটা আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকবে পাকিস্তানের মানুষ—যদি অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে বিদায় হয়ে যায় ভারতের! আগামীকালের দ্বিতীয় সেমিফাইনালের মতো চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালও হবে তখন লাহোরে। কিন্তু তাতেও গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে প্রাণস্পন্দন আসবে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। পাকিস্তানের মানুষ যে ক্রিকেট বলতে পাকিস্তানের ক্রিকেটকেই আগে বোঝে! অন্য দলের ক্রিকেটটা তাদের কাছে তখনই আগ্রহের, যখন সেই দলটা পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহদের জনপ্রিয়তা এই দেশে যে কোনো পাকিস্তানি ক্রিকেটারের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো।
যদিও পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশের পারফরম্যান্সও এবার পাকিস্তানের মানুষকে হতাশ করেছে। রাওয়ালপিন্ডি স্টেডিয়ামে যেদিন বাংলাদেশ–পাকিস্তান ম্যাচটি বৃষ্টির কারণে হতে পারল না, সেদিন বৃষ্টির মধ্যেই খেলা দেখতে আসা কয়েকজন পাকিস্তানি দর্শকের সাক্ষাৎ মিলেছিল স্টেডিয়ামের স্যুভেনির শপে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স মেনে নিতে না–পারা এক দর্শকের মন্তব্য ছিল, ‘অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দলটা কী রকম হয়ে গেল! সাকিব–তামিমরা যখন ছিল, তখন বাংলাদেশ জিতেছে যেমন, আবার হেরেছেও। তবু দলটার মধ্যে কিছু একটা ছিল, মনে হতো যেকোনো সময় জিতে যাবে। তারা ফাইট করত। এখনকার দলে সে রকম কিছু নেই।’
পাকিস্তান নিয়ে তাদের আলোচনার শুরু হলো এরপরই, তবে বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ায় সেটি আর পুরো শোনা হয়নি। যেতে যেতে দূর থেকে যা কানে আসছিল, তাতেও ভালো কিছু থাকার কোনো কারণ ছিল না। শুধু হতাশা আর হতাশা।
আর এখন তো চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে অকালে শেষের অন্ধকার নামিয়ে আনার দায়ও নিতে হবে পাকিস্তান দলকে। পাকিস্তান সেমিফাইনাল পর্যন্ত এলে এই দেশে এখনো নিশ্চিত জীবন্ত থাকত টুর্নামেন্টটা। তাকিয়ে থাকতে হতো না দুবাইয়ের আজকের সেমিফাইনালের দিকে, যেখানে ভারতের হারই এখন একমাত্র কাম্য পাকিস্তানের মানুষের। মোহাম্মদ রিজওয়ানদের অনুপস্থিতিতে হলেও তখন অন্তত ফাইনালের আতশবাজি পুড়বে পাকিস্তানেই। আজ ভারত হারলে তাই অন্য এক ‘জয়’ হবে পাকিস্তানেরও।