কেমন ছিল হাথুরুসিংহের ‘প্রথম ইনিংস’
বাংলাদেশ দলের কোচ হিসেবে প্রথম দফায় হাথুরু ছিলেন আলোচিত-সমালোচিত। এবারের পর্বটা কেমন হবে, তা নিয়ে কৌতূহল সবার।
২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি। ঠিক ৫ বছর ৪ মাস পর আবারও ফিরে আসছেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। ২০১৪ সালের ১০ জুন দায়িত্ব নিয়ে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ ছিলেন এই শ্রীলঙ্কান। সেই সময়ে আলোচিত-সমালোচিত হাথুরুসিংহের ফিরে আসার খবর আবারও জন্ম দিয়েছে আলোচনার—বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) যে তাঁকে তিন সংস্করণের প্রধান কোচ হিসেবে ফিরিয়ে আনছে, তাতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভালো হবে, নাকি খারাপ?
প্রথম দফায় বাংলাদেশ দলের কোচ হিসেবে কাগজ-কলমে হাথুরুসিংহকে সফলই বলতে হবে। ২১ টেস্টের মধ্যে জয় ৬টিতে, ৫২ ওয়ানডের মধ্যে জয় ২৫টিতে ও ২৯টি টি-টোয়েন্টি খেলে জয় ছিল ১০টিতে। টেস্ট, ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতে সিরিজ জয় এসেছে যথাক্রমে ১, ৬ ও ১টি।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের টালমাটাল একটা সময়ে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেসহ টানা ছয়টি ওয়ানডে সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে হাথুরুসিংহের অধীনেই বাংলাদেশ ওঠে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে। তাঁর সময়ে টেস্টে বাংলাদেশ জয় পেয়েছিল ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।
কিন্তু এসব সাফল্যের কৃতিত্ব একা হাথুরুসিংহেকে দিলে অন্যদের প্রতি অন্যায়ই করা হবে। মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহর মতো ক্রিকেটাররা সোনালি সময় কাটিয়েছেন তখন। কোচ হিসেবে পর্দার আড়ালে হাথুরুসিংহের একটা ভূমিকা তো অবশ্যই ছিল, কিন্তু মাঠে আসল কাজটা করতে হয়েছে ক্রিকেটারদেরই।
সেই সময়ের কথা মনে করে জাতীয় দলের সঙ্গে তখন ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা এক সাবেক ক্রিকেটার গতকাল বরং উল্টোটাই বললেন, ‘হাথুরুসিংহের সময় অবশ্যই আমরা সাফল্য পেয়েছি। কিন্তু সেই সাফল্যে নির্বাচক, ক্রিকেটারদেরও অবদান ছিল। কিন্তু হাথুরুসিংহে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কিছু ক্ষতিও তখন করেছেন, যেটার দায় শুধু তাঁকেই নিতে হবে। তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণেই সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমানের মতো ক্রিকেটাররা জাতীয় দলে জায়গা পাকা করতে পারেনি।’
ক্রিকেটার, নির্বাচক, ক্রিকেট বোর্ড—বাংলাদেশের কোচ হিসেবে প্রথম দফায় হাথুরুসিংহের বোঝাপড়া ভালো ছিল না কারও সঙ্গেই। দলের অন্দরমহলে কান পাতলেই আসত বিরোধ-অসন্তোষের খবর। সেবার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম আলোকে দেওয়া প্রথম সাক্ষাৎকারে হাথুরুসিংহে বলেছিলেন, সাকিব আল হাসানও তাঁর কাছে অন্যদের মতোই একজন খেলোয়াড়। কথাটা বলে সব খেলোয়াড়কে একই চোখে দেখার বার্তাই আসলে তিনি দিতে চেয়েছিলেন। কোচের জায়গা থেকে সে রকম মনোভাবের দরকারও ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, কোনো ক্রিকেটারের প্রতি তাঁর বিশেষ কোনো দুর্বলতা প্রকাশ না পেলেও কাউকে কাউকে যেন একটু অপছন্দই করতেন।
মুমিনুল হককে হাথুরুসিংহেই বানিয়ে দিয়েছিলেন শুধু টেস্ট ক্রিকেটার। হাথুরুর সময়টা স্বস্তিকর ছিল না মাহমুদউল্লাহর জন্যও। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বোয় বাংলাদেশের শততম টেস্টের দল থেকে বাদ দেওয়া হয় মাহমুদউল্লাহকে। রাখতে চাননি ওয়ানডে সিরিজের দলেও। পরে অধিনায়ক মাশরাফির হস্তক্ষেপে মাহমুদউল্লাহ ওয়ানডে দলে থেকে যান। আবার উল্টোটাও মনে রাখতে হবে। মাহমুদউল্লাহই পরে একসময় বলেছেন, তাঁর ব্যাটিংয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রেখেছিলেন হাথুরুসিংহে।
হাথুরুসিংহের সঙ্গে নির্বাচকদের কাজের সম্পর্কও খুব একটা স্বস্তিকর ছিল বলে শোনা যায়নি। বরং নির্বাচকদের কাছ থেকে এমন অভিযোগই শোনা যেত যে দল নির্বাচন প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে পড়া হাথুরুসিংহের কারণেই দল গঠনে বিসিবির হস্তক্ষেপের সুযোগ বেড়েছিল তখন। হয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেটের রসায়নটা বেশ ভালো বুঝে গিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কান এই কোচ। সে কারণেই যোগাযোগ রক্ষা করতেন সরাসরি ওপর মহলে।
সে সুবাদেই হয়তো গত ৫ বছর ৪ মাস কোচ হিসেবে কোথাও ভালো কিছু না করেও হাথুরুসিংহে আবারও ‘পুনর্বাসিত’ হচ্ছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে। বিসিবির কেউ কেউ যদিও বলছেন, বাংলাদেশ দলের অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররাই হাথুরুকে কোচ হিসেবে চেয়েছেন; সে রকম খুব একটা আঁচ কিন্তু পাওয়া যায়নি ক্রিকেটারদের কথাতে।