বেশ আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন। বড় মঞ্চ, হাজির ১২ দলের অধিনায়কও। ট্রফি উন্মোচনের এত আয়োজনের ভিড়েও একজন হুট করে বলে উঠলেন, ‘আগের সেই অবস্থা কি আছে!’ মানুষ স্বভাবগতভাবেই অতীতে ডুবে থাকতে পছন্দ করেন। কিন্তু ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে কথাটা তো সত্যিই!
ক্রিকেটীয় কাঠামোতে টেস্ট খেলুড়ে বাকি দেশগুলোতে উল্টো হতে পারে, তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে ঐতিহ্যগতভাবে এই লিস্ট ‘এ’ টুর্নামেন্টটি নিয়ে মাতামাতি অনেক বেশি। তামিম ইকবাল যেমন এটিকে বলছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘মেরুদণ্ড’। এই মেরুদণ্ডের অনেকগুলো হাড়ের একটি হওয়ার কথা ‘দর্শক’, যেকোনো খেলাতেই যা জরুরি—তা অতীত হয়ে গেছে বেশ আগেই। পুরোনো কাগজের লেখা আর ছবিগুলোই এখন প্রিমিয়ার লিগের দর্শক খুঁজে পাওয়ার একমাত্র অবলম্বন। আবাহনী–মোহামেডান ম্যাচে শ পাঁচেক বা বড়জোর হাজারখানেক দর্শকই এখন সংখ্যার দিক থেকে অনেক।
তবুও যে দেশের ক্রিকেটের ‘মেরুদণ্ড’ এত দিন সোজা ছিল; তার একটা কারণ ছিল খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক, বেশির ভাগ ক্রিকেটার প্রিমিয়ার লিগের দিকে তাকিয়ে থাকতেন বছরের খরচটা তুলে নেওয়ার জন্য। অথচ এবার নাকি গত আসরের তুলনায় কারও অর্ধেক, কারও পারিশ্রমিক তার চেয়েও বেশি কমে গেছে।
এসব যে আড়ালে–আবডালের বিষয় হয়ে আছে, তা–ও নয়। একেবারে ট্রফি উন্মোচন মঞ্চে দাঁড়িয়েই পারিশ্রমিক নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল। পরে তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন আরও কয়েকজন।
তা ‘মেরুদণ্ডের’ সবচেয়ে শক্ত হাড় মানে পারিশ্রমিকের হঠাৎ কি একটু বেশি পতন হয়ে গেল? প্রশ্নটা শুনে খেলোয়াড়দের নিয়ে নিজের ক্ষোভ উগরে দিলেন নাম প্রকাশ করতে চান না, এমন এক ক্লাব কর্মকর্তা। তাঁর মতে, এত দিন নাকি খেলোয়াড়েরা বেশি টাকা পেতেন, একেকজন খেলোয়াড় ৭০/৮০ লাখ পর্যন্ত টাকা নিতেন, যা দেশের পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় ‘অনেক বেশি’ বলে মনে করেন তিনি।
পুরো দেশ যে একটা পটপরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তা মনে করিয়ে দেন আরেক ক্লাব কর্তা। বাংলাদেশের ক্লাবগুলো মূলত অনুদান বা চাঁদার ওপর নির্ভরশীল। তাতে এখন তেমন সুবিধা করা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক এ অবস্থায় ব্যবসায় মন্দার কারণে এখন আগের মতো টাকা দিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরাও। এর সঙ্গে আরও একটি কারণও বলা হচ্ছে, খেলোয়াড়দের দেওয়া প্রতিশ্রুত অর্থ না দিয়ে খবরের শিরোনাম হওয়ার ঝুঁকিটা নিতে চাচ্ছে না কেউ।
খেলোয়াড়েরাও অবশ্য নাছোড়বান্দা। লিটন দাস যে গুলশান ক্লাবে খেলবেন, তা ঠিক হয়েছে কালই। পারিশ্রমিক নিয়ে কোনো ক্লাবের সঙ্গে বনিবনা না হওয়াটাই কারণ। এখনো তিনি যে পারিশ্রমিকে খেলছেন, তা–ও নাকি গত আসরের অর্ধেকের কম; একরকম ‘নিরুপায়’ হয়েই খেলতে হচ্ছে তাঁকে। এই ‘ঝুঁকি’ নিতে না চাওয়া পেসার মোস্তাফিজুর রহমান কাল পর্যন্ত কোথাও নাম লেখাননি।
এবারের ১২ দল
আবাহনী, মোহামেডান, প্রাইম ব্যাংক, শাইনপুকুর, ধানমন্ডি ক্লাব, গাজী গ্রুপ, লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, পারটেক্স, রূপগঞ্জ টাইগার্স, গুলশান ক্রিকেট ক্লাব ও অগ্রণী ব্যাংক।
এসব বিষয় প্রকাশ্য হওয়ায় প্রিমিয়ার লিগ তো বটেই, বাংলাদেশ ক্রিকেটেরও একটা ‘ইমেজ’ সংকট হচ্ছে বলে ধারণা অনেকের। বিসিবি পরিচালক ও সিসিডিএমের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন চৌধুরী অবশ্য তা মনে করেন না। কাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা একদমই মনে করি না, প্রিমিয়ার লিগের কোনো দিক থেকে মান কমেছে বা জৌলুশ হারাচ্ছে। বরং গত কয়েক বছরে উন্নতি হয়েছে। পারিশ্রমিক খেলোয়াড়দের সঙ্গে ক্লাবগুলোর চুক্তির বিষয়, এখানে সিসিডিএমের তেমন কিছু করার নেই।’
কিছু ক্ষেত্রে এবারের প্রিমিয়ার লিগ অবশ্য পাচ্ছে নতুনত্বও—তিন ম্যাচের একটি দেখা যাবে টিভিতে, বাকি দুটি দেখানো হবে ইউটিউবে। সম্প্রচার হওয়ায় এবার থাকছে তৃতীয় আম্পায়ার—তাঁর কাছে অবশ্য শুধু মাঠের দুই আম্পায়ারই যেতে পারবেন, খেলোয়াড়েরা নন। এলবিডব্লিউ বা কট বিহাইন্ড দেখার ক্ষমতাও থাকছে না।
আগের মতো ১২ দলের টুর্নামেন্ট—লিগ পর্বে ১১ ও পরে সুপার লিগে ওঠা ছয় দলের আরও পাঁচটি করে ম্যাচ থাকছে। খেলাগুলো হওয়ার কথা বিকেএসপির তিন মাঠ ও মিরপুরের শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে।
আগের মতো ১২ দলের টুর্নামেন্ট—লিগ পর্বে ১১ ও পরে সুপার লিগে ওঠা ছয় দলের আরও পাঁচটি করে ম্যাচ থাকছে। খেলাগুলো হওয়ার কথা বিকেএসপির তিন মাঠ ও মিরপুরের শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। অর্থের হিসাবে একটু বদল এসেছে—চ্যাম্পিয়ন দল প্রাইজমানি হিসেবে ১২ থেকে বেড়ে এখন পাবে ১৫ লাখ, রানার্সআপ ক্লাব পাবে ১৩ লাখ। ম্যাচসেরা ক্রিকেটাররা পাচ্ছেন ১৫ হাজার টাকা, পুরস্কৃত করা হবে সর্বোচ্চ রান ও উইকেট সংগ্রাহককেও।
এত কিছুর পরও তারকা ক্রিকেটারদের সবার সামনে এসে করা সমালোচনা মেনে নিতে পারছেন না বোর্ডসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কাল সিসিডিএমের একজন তা–ই বললেন, ‘ওরা কী দেশের কোনো খোঁজখবর রাখছে না!’ অবস্থাটা ক্রিকেটাররা যত বড় করে দেখাচ্ছেন, ততটাও নাকি নয়। তাহলে তো স্বস্তিরই কথা, মেরুদণ্ডের সব হাড় ক্ষয় হয়ে গেলে তো খোঁড়াতে থাকা ক্রিকেটটা থমকেই যাবে!