বৃষ্টি ছাড়া কে ঠেকাবে বাংলাদেশের জয়

ইবাদতের স্যালুট নিয়মিতই পেয়েছে আফগানিস্তান। কাল উইকেট পাওয়ার পরছবি: শামসুল হক

ফলো অন কাকে বলে, জানেন নিশ্চয়ই। তারপরও কি একবার মনে করিয়ে দেব? রাগ করবেন না কথা দিলে বলেই ফেলি। যদি পাঁচ দিনের ম্যাচ হয়, প্রথমে ব্যাটিং করা দল প্রথম ইনিংসে ২০০ বা এর বেশি রানে এগিয়ে থাকলে প্রতিপক্ষ দলকে আবার ব্যাটিং করতে বলতে পারে। এটাকেই বলে ফলো অন, যেটিতে প্রচ্ছন্ন একটা ঔদ্ধত্যও মিশে থাকে। দেখি, তোরা দুবার ব্যাটিং করে আমাদের একবারের সমান রান করতে পারিস কি না।

এটা ফলো অনের শতাব্দীপ্রাচীন সংজ্ঞা। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে এর অন্য একটা রূপ ছিল। তা এ রকম—ফলো অন হলো সেই জিনিস, যা প্রতিপক্ষ করায়, আর বাংলাদেশ করে। ফলো অনের সংজ্ঞাটা বলে দেওয়া যেমন কারও কাছে অকারণ বলে মনে হতে পারে; এটা যে রসিকতা, তা বলে দেওয়াটাও হয়তো তা-ই।

ফলো অনের সংজ্ঞার এই বাংলাদেশীকরণের কারণটা অনুমান করা কঠিন কিছু নয়। একটা সময় বাংলাদেশ যে শুধু ফলো অন করেই যেত, কখনো করানোর সুযোগ পেত না—সেই সুযোগ প্রথম আসে ২০১৮ সালে।

আরও পড়ুন

১৩৮ টেস্টের ইতিহাসে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষকে ফলো অন করানোর ঘটনা একটাই। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ফলো অন করিয়ে ইনিংসে জিতেছিল বাংলাদেশ। সুযোগ কিন্তু আগেই এসেছিল। ঠিক আগের মাসেই। যখন প্রথম ইনিংসে ২১৮ রানের লিড নিয়েও জিম্বাবুয়েকে ফলো অন করায়নি বাংলাদেশ। কাকতালই বলতে হবে, ৬ উইকেটে ২২৪ রানে দ্বিতীয় ইনিংস ছাড়ার পর বাংলাদেশ ওই ২১৮ রানেই জিতেছিল!

আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে লিড আরেকটু বেশি। ২৩৬ রান। এবারও ফলো অন না করিয়ে নিজেরাই আবার ব্যাটিং করতে নেমে গেল বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে আফগানরা যেখানে করেছে মাত্র ১৪৬, অবাক তো হতেই পারেন। যদিও কারণটা সহজে অনুমান করাই যায়। টেস্ট ক্রিকেটে দ্বিতীয় ইনিংসে ঘুরে দাঁড়ানোর অনেক নজির আছে। ফলো অন করতে বাধ্য হওয়া দলই ম্যাচ জিতে গেছে, অবিশ্বাস্য এই ঘটনাও তো চারবার দেখেছে টেস্ট ক্রিকেট। আফগানিস্তানও যদি এমন কিছু করে বসে! এই আফগানিস্তান দলের যে অবস্থা, তাতে সেটি করা আর বাংলাদেশে লোডশেডিং নাই হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় সমান।

দারুণ বোলিংয়ে আফগানিস্তানকে তাদের প্রথম ইনিংসে বেশিদূর এগোতে দেয়নি বাংলাদেশ
ছবি: শামসুল হক

তারপরও অকারণ ঝুঁকি নেওয়ার কী দরকার। ফলো অন করেও আফগানিস্তান জিতে যাবে কি না, সেই আলোচনা তো পরে। কিন্তু প্রথম ইনিংসের ঘাটতিটা মুছে দিলেই তো বাংলাদেশকে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিং করতে হবে। সেই ঝামেলায় কেন যেতে চাইবে বাংলাদেশ, হাতে যেখানে অঢেল সময়। তার চেয়ে এই ভালো, দ্বিতীয় ইনিংসেও ব্যাটিং করে আফগানিস্তানকে অসম্ভব একটা লক্ষ্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া। তারপর ব্যাটসম্যানদের চারপাশে ফিল্ডারের ছাতা বানিয়ে ইচ্ছেমতো আক্রমণ করা যাবে। হঠাৎ একটা জুটি দাঁড়িয়ে গেলেও তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ থাকবে না।

আরও পড়ুন

টেস্টের মাত্র দুই দিন গেছে। এরই মধ্যে সেই উদ্দেশ্য যথেষ্টই সফল। দ্বিতীয় ইনিংসে ১ উইকেটে ১৩৪ রানে দিন শেষ করে বাংলাদেশ এরই মধ্যে ৩৭০ রানে এগিয়ে। বৃষ্টি ছাড়া কার সাধ্য আছে এই টেস্টে বাংলাদেশকে জয়বঞ্চিত করে!

বছর চারেক আগে দুই দলের একমাত্র টেস্টটি বাংলাদেশের ক্রিকেটে দগদগে এক ক্ষত হয়ে আছে। বৃষ্টির প্রবল বাধা উপেক্ষা করেও আফগানিস্তান স্মরণীয় এক জয় পেয়েছিল চট্টগ্রামে। বলতে গেলে বাংলাদেশকে একাই হারিয়ে দিয়েছিলেন সেই টেস্টেই অধিনায়ক হিসেবে অভিষিক্ত লেগ স্পিনার রশিদ খান। সেই রশিদ খান এবার নেই বলে বাংলাদেশ টেস্ট শুরু করেছে অবধারিত ফেবারিট হিসেবে। এখন পর্যন্ত যা পাণ্ডুলিপি মেনেই এগোচ্ছে। তারপরও টেস্ট ম্যাচ বলে কথা! তাতে কি আর একটু নাটকীয়তা থাকবে না। সেই অংশটুকু অভিনীত হলো কাল সকালে।

আফগানিস্তানের কোচ জোনাথন ট্রট
প্রথম আলো

প্রথম দিনের খেলা শেষে বাংলাদেশের স্কোর ৫ উইকেটে ৩৬২, সংবাদ সম্মেলনে এসে আফগানিস্তানের কোচ জোনাথন ট্রট পরদিনের প্রত্যাশা জানতে চাওয়ায় বলেছিলেন, ‘আমরা ১০ রানের মধ্যে বাংলাদেশের বাকি ৫ উইকেট তুলে নেব, এরপর নিজেরা ৫০০ রান করব।’ বলেই হেসে ফেলেছিলেন।

আরও পড়ুন

ট্রটের রসিকতায় সংগত করে হেসেছিলেন সাংবাদিকেরাও। কী আশ্চর্য, ট্রটের চাওয়ার প্রথম অংশ বলতে গেলে পূরণই হয়ে গেল! ১০ রানের জায়গায় ২০ রান হয়েছে, এ-ই যা! ৯ রানে পড়েছে বাংলাদেশের শেষ ৫ উইকেট—এটা মনে রাখলে অবশ্য বলতে হয়, ট্রট যা চেয়েছিলেন, তার চেয়েও বেশি পেয়েছেন।

আগের দিন টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর প্রথম বলেই উইকেট নিয়েছেন নিজাত মাসুদ। পরে উইকেট নিয়েছেন আরও একটি। কাল সকালে বাংলাদেশের ৫ উইকেটের ৩টিই তুলে নিয়ে গড়ে ফেললেন টেস্ট অভিষেকে ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তিও। টেস্টে তাঁর প্রথম বলটি প্রথম দিনের সেরা বলের স্বীকৃতি পাবে। কাল অব্যর্থ নিশানার যে বাউন্সারে মুশফিকুর রহিমকে আউট করলেন, তা সম্ভবত ম্যাচেরই সেরা বল হয়ে থাকবে।

কাল দ্বিতীয় দিন শেষে সংবাদ সম্মেলনে আসেননি নিজাত মাসুদ
ছবি: প্রথম আলো

এত সব কাণ্ড করে ফেলার পর নিজাত মাসুদ তো সংবাদ সম্মেলনে আসবেনই। কিন্তু কোথায় মাসুদ, টানা দ্বিতীয় দিন সংবাদ সম্মেলনে কোচ জোনাথন ট্রট। নিজের আগ্রহে আসার কথা নয়। আফগান খেলোয়াড়দেরই সাংবাদিকদের সামনে আসতে চরম অস্বাচ্ছন্দ্য। কারণ? ভাষার প্রতিবন্ধকতা ছাড়া আর কীই–বা হতে পারে!

আরও পড়ুন

এই টেস্টের আগে পেস-পেস বলে যে রব উঠেছিল, এখন পর্যন্ত সেটির যথার্থ প্রতিফলন ঘটছে ম্যাচে। আফগানিস্তানের সেরা বোলার একজন পেসার। বাংলাদেশেরও তা-ই। চার-চারবার স্যালুট পেল আফগানিস্তান। এর মানে কি বুঝিয়ে বলতে হবে? উইকেট পাওয়ার পর ইবাদত হোসেনের ট্রেডমার্ক উদ্‌যাপন তো এত দিনে সবার পরিচিতই। পঞ্চম স্যালুটটা আর দিতে পারেননি দুই স্পিনার তাইজুল ও মিরাজ শেষ ৩টি উইকেট নিয়ে নেওয়ায়।

কাল যে রূপে দেখা গেল ইবাদতকে, তাতে স্যালুট অবশ্যই আরও পাবে আফগানিস্তান। দ্বিতীয় ইনিংস এখনো বাকি না!