কোহলির ১৫ বছর: রেকর্ডের বাইরে আরও ১৫ রেকর্ড
২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট ডাম্বুলায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়েছিল বিরাট কোহলির। ওপেনিংয়ে নেমে ২২ বলে করেছিলেন ১২ রান। সে ইনিংস কি কোনো আভাস দিয়েছিল? ১৫ বছর পর কোহলি কোথায় দাঁড়িয়ে থাকবেন, সেটি তখন অনুমান করা প্রায় অসম্ভবই ছিল। এখন তিন সংস্করণ মিলিয়ে ২৫ হাজারের ওপরে রান, ৫০-এর ওপরে গড়, ৭৬টি সেঞ্চুরি, ১৩১টি ফিফটি—কোহলি কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন। তবে এসবের বাইরেও কোহলির ক্যারিয়ারে আছে অদ্ভুত সব সংখ্যা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোহলির ১৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে তেমন ১৫টি সংখ্যা বের করেছে ইএসপিএনক্রিকইনফো—
বাউন্ডারির বাইরে যে সব শটে দৌড়ে রান নিয়েছেন কোহলি, তার সম্মিলিত দূরত্ব প্রায় ২৭৭ কিলোমিটার। তবে এ সময়ে ব্যাটিং সঙ্গীদের রানের জন্যও দৌড়াতে হয়েছে কোহলিকে, যেটি প্রায় ২৩৩ কিলোমিটারের মতো। মানে সব মিলিয়ে রানিং বিটুইন দ্য উইকেটেই প্রায় ৫১০ কিলোমিটার অতিক্রম করেছেন কোহলি। ক্যারিয়ারে অবশ্য একবারই দৌড়ে চার রান নিয়েছেন—২০১৩ সালে হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।
রান তাড়ায় কোহলির আলাদা একটা সুখ্যাতি আছেই। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও তাঁর প্রিয় টুর্নামেন্ট, সেটি বলাই যায়। ২০১৪ ও ২০১৬ সালের টুর্নামেন্ট–সেরা তিনি। আর বিশ্বকাপে রান তাড়ায় তিনি দুর্দান্ত। কোহলি ব্যাটিং করেছেন, এমন ১০টি রান তাড়া করা ম্যাচের মধ্যে ৯টিতেই জিতেছে ভারত, ৮টিতেই অপরাজিত ছিলেন কোহলি। রান তাড়া করা এসব ম্যাচে কোহলির গড় ২৭০.৫। কমপক্ষে ৫ ইনিংস ব্যাটিং করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে টি-টোয়েন্টির দ্বিতীয় ইনিংসে কোহলির পর সর্বোচ্চ গড় অস্ট্রেলিয়ার মার্কাস স্টয়নিসের। সেটিও প্রায় কোহলির গড়ের অর্ধেক—১৪৬।
তবে যেসব ম্যাচে রান তাড়া করে ভারত জিতেছে, সেসব ম্যাচে কোহলির গড়টা আরও অবিশ্বাস্য—৫১৮! এ ক্ষেত্রে (কমপক্ষে ৫ ইনিংস ব্যাটিং) দুইয়ে থাকা ক্যামেরন হোয়াইটের গড় কোহলির প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ—১০৪।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত ৮৩টি ভেন্যুতে খেলেছেন কোহলি। এর মধ্যে সেঞ্চুরি করেছেন ৪৬টি মাঠে। সবচেয়ে বেশি মাঠে সেঞ্চুরি করার ক্ষেত্রে কোহলির চেয়ে এগিয়ে আছেন শুধু শচীন টেন্ডুলকার। ৫৩টি ভিন্ন মাঠে সেঞ্চুরি আছে তাঁর। কোহলির ৭৬টি সেঞ্চুরির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫টি এসেছে অ্যাডিলেড ওভালে।
২০১১ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ অভিষেকেই বাংলাদেশের বিপক্ষে মিরপুরে অপরাজিত সেঞ্চুরি করেছিলেন কোহলি। এক বছর পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অভিষেকে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ফিফটি করেন তিনি। ওয়ানডে বিশ্বকাপ অভিষেকে সেঞ্চুরি ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অভিষেকে ফিফটি, এমন ‘ডাবল’ করার ক্ষেত্রে কোহলিই প্রথম। পরে এ কীর্তি ছুঁয়েছেন অ্যারন ফিঞ্চ। ২০১৪ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অভিষেকে ফিফটির পর ২০১৫ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক।
যে নয়টি দেশে ওয়ানডে খেলেছেন, সব কটিতেই সেঞ্চুরি আছে কোহলির। আটটি দেশে টেস্ট খেলেছেন, এক বাংলাদেশ ছাড়া সেঞ্চুরি পেয়েছেন সব কটিতেই। ছয়টি দেশে টেস্ট ও ওয়ানডে দুই সংস্করণেই সেঞ্চুরি আছে তাঁর—অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রতিপক্ষের দেশে টেস্ট ও ওয়ানডে সেঞ্চুরি কোহলির চেয়ে বেশি আছে দুজনের—শচীন টেন্ডুলকার ও কুমার সাঙ্গাকারা। দুজনই সাতটি আলাদা দেশের বিপক্ষে তাদের মাটিতে সেঞ্চুরি করেছেন।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে ১০টি ওয়ানডে ইনিংসেই প্রায় ১ হাজার রান (৯৯৫) করেন কোহলি। সে সময় করেন ৫টি সেঞ্চুরি ও ৩টি ফিফটি, ওই ১০ ইনিংসে গড় ছিল ১৪২.১৪। আর কোনো ব্যাটসম্যানেরই এমন ১০ ইনিংসের রানের ফোয়ারা নেই। ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের জুনে ডেভিড ওয়ার্নার ১০ ইনিংসে করেছিলেন ৮৫৭ রান। কোহলি ভাঙেন সে রেকর্ড।
এ বছর থিরুভানান্থাপুরামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৬৬ রানে অপরাজিত ছিলেন কোহলি। ৩৯১ রানের লক্ষ্যে শ্রীলঙ্কা গুটিয়ে যায় ৭৩ রানেই। সে দিক থেকে কোহলির কাছেই ৯৩ রানে হেরেছিল শ্রীলঙ্কা। ওয়ানডেতে একজনের ব্যক্তিগত স্কোর ও প্রতিপক্ষের দলীয় স্কোরের এমন পার্থক্য আর নেই। এর আগের রেকর্ডটি অবশ্য ছিল এক শ্রীলঙ্কানেরই। ২০০০ সালে ৫৪ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল ভারত, যা ছিল সনাৎ জয়াসুরিয়ার ১৮৯ রানের চেয়ে ১৩৫ রান কম।
২০১৬ সালের আগপর্যন্ত ৪১টি টেস্টে ১১টি সেঞ্চুরি ছিল কোহলির। তবে সে সময় ১৫০ পেরিয়েছিলেন মাত্র একবার, ১২০ রানের নিচেই থেমেছিলেন সাতবার। কিন্তু ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ১৫টি সেঞ্চুরির সাতটিকেই ডাবল সেঞ্চুরিতে রূপ দেন কোহলি, যেটি ভারতের রেকর্ড। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টানা চারটি সিরিজে ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ডও গড়েন তিনি—২০১৬-১৭ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও বাংলাদেশের বিপক্ষে।
২০১৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়পুরে ভারতের দ্রুততম সেঞ্চুরি করেছিলেন কোহলি, ৫২ বলে। সে ইনিংসে তিনি ব্যাটিং করতে এসেছিলেন ২৭তম ওভারে। সে সিরিজেই নাগপুরে ৬১ বলের আরেকটি সেঞ্চুরি করেন, যেটি ভারতের তৃতীয় দ্রুততম। সেবার ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন ৩০তম ওভারে। ওয়ানডেতে ২৫ বা এর বেশি ওভার (যেসব ম্যাচের তথ্য আছে) হয়ে যাওয়ার পর ব্যাটিংয়ে নেমে একাধিক সেঞ্চুরি আছে শুধু কোহলিরই। একটি করে সেঞ্চুরি আছে কেভিন পিটারসেন, আব্দুল রাজ্জাক, জ্যাকব ওরাম ও জস বাটলারের।
২০১৩ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে প্রথমবারের মতো ভারতকে নেতৃত্ব দেন কোহলি। ভারত জেতে ৫-০ ব্যবধানে। ২০১৪ সালে মহেন্দ্র সিং ধোনির অনুপস্থিতিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নেতৃত্ব দিয়েও একই ফল আনেন। ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কাকে আবার কোহলির অধিনায়কত্বে ৫-০-তে হারায় ভারত। পুরুষ ওয়ানডেতে চার বা এর বেশি ম্যাচের সিরিজে প্রতিপক্ষকে তিনবার ধবলধোলাই করা একমাত্র অধিনায়ক কোহলিই।
শচীন টেন্ডুলকারের রেকর্ড ৪৯টি ওয়ানডে সেঞ্চুরি থেকে এখনো তিনটি দূরে কোহলি। তবে রান তাড়ায় টেন্ডুলকারের (১৭) চেয়ে বেশ এগিয়ে তিনি (২৬)। এর মধ্যে ৯টি সেঞ্চুরিই এসেছে, যখন লক্ষ্য ছিল ৩০০ রানের বেশি। ৩০০ বা এর বেশি রান তাড়ায় সেঞ্চুরিসংখ্যায় তাঁর পরে আছেন জেসন রয়, ইংলিশ ব্যাটসম্যানের এ ক্ষেত্রে সেঞ্চুরি ৫টি।
২০০৮ সালে অভিষেকের সময় কোহলির বয়স ছিল ১৯ বছর ২৮৭ দিন। শুরুতেই বলা হয়েছে, সে ম্যাচে ওপেন করেছিলেন তিনি। একটা রেকর্ডও সেদিন হয়েছিল তাঁর। ভারতের হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে অভিষেকেই ওপেন করতে নামা ব্যাটসম্যান হয়ে গিয়েছিলেন কোহলি, যে রেকর্ড টিকে আছে এখনো। সব মিলিয়ে কোহলির চেয়ে কম বয়সে ভারতের হয়ে ইনিংস ওপেন করেছেন তিনজন—পার্থিব প্যাটেল, যুবরাজ সিং ও বিনোদ কাম্বলি। অবশ্য অভিষেকে ওপেন করলেও ১৫ বছরের ক্যারিয়ারে ইনিংসের শুরুতে ব্যাটিংয়ে নেমেছেন কোহলি আর মাত্র দুবার।
২০১১ সালে টি-টোয়েন্টিতে প্রথমবার বোলিংয়ে এসেই কেভিন পিটারসেনের উইকেট স্টাম্পিংয়ে নিয়েছিলেন কোহলি। এ সংস্করণে তাঁর ৪ উইকেটের প্রথম ছিল সেটি। তবে কোহলি সে উইকেট নিয়েছিলেন ওয়াইড বলে, তার আগে কোনো বৈধ বলই করেননি তিনি। এখন পর্যন্ত ক্যারিয়ারে বৈধ বলের আগেই উইকেট নেওয়া একমাত্র বোলার হয়ে আছেন তিনি।
ইনিংসে কোনো বৈধ বলের আগে উইকেট নেওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টতে আছে তিনটি। ২০১০ সালে শোয়েব মালিককে গ্রায়েম সোয়ান, ২০১২ সালে মার্টিন গাপটিলকে সুনীল নারাইন ও ২০১৪ সালে লেন্ডল সিমন্সকে ওয়াইড বলে স্টাম্পিং করেছিলেন সাকিব আল হাসান।
এখন পর্যন্ত রেকর্ড ১৩টি ২০০ বা এর বেশি রানের ওয়ানডে জুটির অংশ কোহলি। এর মধ্যে পাঁচটিতে তাঁর সঙ্গী ছিলেন রোহিত শর্মা। বাকি আটটিতে তাঁর সঙ্গী ছিলেন ছয়জন—গৌতম গম্ভীর (তিন), বীরেন্দর শেবাগ, শিখর ধাওয়ান, অজিঙ্কা রাহানে, কেদার যাদব ও ঈশান কিষান।
ওয়ানডেতে কোহলি-রোহিতের জুটিই সবচেয়ে এগিয়ে। ডাবল সেঞ্চুরি জুটিতে কোহলির পর সবচেয়ে বেশি অংশ থাকার রেকর্ডও রোহিতের—১০টি।
২০১১ সালে জ্যামাইকায় টেস্ট অভিষেক হয় কোহলির। আট বছর পর সে ভেন্যুতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাঁর নেতৃত্বে ২৫৭ রানে হারিয়েছিল ভারত, যেটি ছিল কোহলির অধিনায়ক হিসেবে ২৮তম জয়। সে জয় দিয়ে ধোনির ২৭ জয়ের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন কোহলি। অধিনায়কত্ব ছাড়ার আগে তাঁর জয়ের সংখ্যাকে ৪০-এ নিয়ে যান তিনি, ইতিহাসে যেটি চতুর্থ সর্বোচ্চ।