সকাল থেকেই স্টেডিয়ামমুখী জনস্রোত। বিশ্বকাপ ফাইনালের শহরে তো এমনই হয়। তা সেটি ক্রিকেটের বিশ্বকাপ হোক, বা অন্য যেকোনো খেলার। আহমেদাবাদ অবশ্য এগিয়েই থাকছে। এর আগে কবে আর কোন খেলার বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন স্টেডিয়ামের দিকে ছুটে গেছে ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ!
১৯৫০ বিশ্বকাপ ফুটবলের শেষ ম্যাচে মারাকানায় নাকি দর্শক ছিলেন প্রায় পৌনে দুই লাখ। যদিও সেটি ফাইনাল ছিল না। ফুটবলে ওই একটিই বিশ্বকাপ, যেটিতে ফাইনাল বলে কিছু নেই। শেষ ম্যাচের সমীকরণ ছিল—ড্র হলেই ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন, উরুগুয়েকে জিততে হবে। উরুগুয়ের জয় মারাকানায় সেদিন নামিয়ে এনেছিল শ্মশানের নিস্তব্ধতা। ব্রাজিল পরিণত হয়েছিল শোকের দেশে। একাধিক আত্মহত্যার ঘটনাও নাকি ঘটেছিল।
শিরোপা নির্ধারণী বলে মারাকানার সেই ম্যাচ ফাইনাল না হয়েও ‘ফাইনাল’। আর এখানে তো সত্যি সত্যিই ফাইনাল। সেই ফাইনাল দেখতে স্টেডিয়ামমুখী জনস্রোতের রং নীল। যে নীল সমুদ্রে ভেসে ভেসে আজ দুপুর হয় হয় সকালে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে এলাম। আনন্দমুখর এই জনতার সঙ্গে হাঁটতেও মজা। একটু পর পর আওয়াজ উঠছে: জিতেগা ভাই জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা।
‘জিতেগা-জিতেগা’ সেই কোরাসে আশা নেই, আছে বিশ্বাস। যেন ভারত বিশ্বকাপ জিতেই গেছে। ফাইনালটা শুধুই আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, যদি ভারত হেরে যায়, তাহলে কী হবে! মোতেরার এই স্টেডিয়ামও তো তখন মারাকানা হয়ে যাবে।
স্টেডিয়ামমুখী জনস্রোতের কথা ভেবে রাস্তার দুই পাশে নানা আয়োজন সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। ফাইনালের আগের দিন মধ্যরাতে স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়েও দেখেছি গেটের বাইরে কয়েক হাজার মানুষ। ভারতের জার্সি বিক্রি হচ্ছে দেদার। টিকিট হবে, একটা টিকিট...বলতে বলতে ছুটে বেড়াচ্ছেন অনেকে। এদিন জার্সি বিক্রির আয়োজন বরং কম দেখলাম। যাঁরা কেনার, তাঁরা তো আগেই কিনে ফেলেছেন। এমন একজনকেও পেলাম না, যাঁর গায়ে ভারতের জার্সি নেই।
মুম্বাইয়ে ভারতের সেমিফাইনালে ওয়াংখেড়ের বাইরে বেশ কয়েকজন নিউজিল্যান্ডারের দেখা পেয়েছিলাম। এদিন এক মাইলের বেশি হাঁটাপথে একজনকেও পেলাম না, যাঁর পরনে অস্ট্রেলিয়ার হলুদ জার্সি। এটা কি হতে পারে নাকি! ফাইনাল দেখতে কোনো অস্ট্রেলিয়ানই আসেনি, এটা তো হতেই পারে না। তাঁরা কোথায়? স্টেডিয়ামের বাইরে দেখা না পেলে তো আর তাঁদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। গ্যালারির ওই নীল সমুদ্রে ছিটেফোঁটা হলুদ তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। মাথায় ক্রমেই ছোট হতে থাকা কয়েকটা কলস নিয়ে দুটি বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা দড়ির ওপর নাচছেন এক তরুণী। আগু-পিছু করছেন, ঘুরেও যাচ্ছেন কখনো কখনো। কীভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে এমন করা সম্ভব, তা ভেবে রীতিমতো বিস্মিত। দাঁড়িয়ে যে কিছুক্ষণ দেখব, তার উপায় নেই। পেছনের মানুষজনের ধাক্কা লাগছে গায়ে। এমন জনস্রোত যে হাঁটতে হয় না। না চাইলেও ধাক্কা দিয়ে তা এগিয়ে দেয়।
এত বড় স্টেডিয়াম, সেটিকে ঘিরে রাস্তায় হাঁটার সময়ও তা দেখাই যাচ্ছে না। এক সময় যা দেখা দিল। সেই দেখা দেওয়া অবশ্য চাঁদের মতো। দেখা যায়, কিন্তু তা অনেক দূরে। ম্যাচ শুরু হওয়ার বেশ আগেই গ্যালারি প্রায় পরিপূর্ণ। দুই অধিনায়ক টস করতে বেরোতেই এমন চিৎকার যে কানে তালা লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। প্যাট কামিন্স টসে জিততেই অবশ্য নেমে এলো নীরবতা। কামিন্স প্রথমে ফিল্ডিং করার কথা বলতেই আবারও চিৎকার। ব্যাটিংপ্রিয় ভারতীয়রা প্রথমেই ভারতের ব্যাটিং দেখার সুযোগ পেয়ে বড়ই আনন্দিত। শুধু ব্যাটিং দেখাই তো আর একমাত্র কারণ নয়। টসে হেরেও প্রথমে ব্যাটিং করার সুযোগ পাওয়াকে যে ম্যাচ জয়ের নিশ্চয়তা বলে ধরে নিয়েছেন সবাই। প্রথমে ব্যাটিং করে ভারত সাড়ে তিন শ-টিন শ করে ফেলবে। এরপর অস্ট্রেলিয়ার সাধ্য কি ভারতের দুর্দান্ত বোলিংয়ের বিপক্ষে এই রান তাড়া করে!
রোহিত শর্মা আর বিরাট কোহলির জুটির সময় সাড়ে তিন শর আশা আরও বেশি উজ্জ্বল। গ্যালারি নাচছে, গাইছে। দুলছে তেরঙ্গা পতাকা। রোহিত শর্মার আউটে আবার যেটি নীরব। এরপর শ্রেয়াস আইয়ার আর বিরাট কোহলিও ফিরে যাওয়ার পর পুরোই স্তব্ধ। আগের দিন প্যাট কামিন্স বলেছিলেন, একপেশে দর্শকের গ্যালারিকে নীরব বানিয়ে ফেলার মতো তৃপ্তি আর নেই। সেই চাওয়া তো পূরণ হয়েই গেল।
নীরব সেই গ্যালারি দেখে আবারও মনে হলো, ফাইনালে ভারত হেরে গেলে কী হবে!