চেন্নাই থেকে চেন্নাইয়ের কথাই লেখা উচিত। সমস্যা করছে ধর্মশালা টু দিল্লি ফ্লাইটের বর্ণনাতেই কালকের কড়চা শেষ হয়ে যাওয়ার পর দেওয়া প্রতিশ্রুতিটা। হোয়াটসঅ্যাপ আর মেসেঞ্জারে তা আবার মনেও করিয়ে দিয়েছেন প্রথম আলোর একাধিক পাঠক। এর আগে কবে কোন কড়চায় বাকি গল্প পরদিন বলব বলে আর বলিনি, একজন তো এটাও। প্রমাণ হিসেবে একটা ফেসবুক লিংকও পাঠিয়ে দিয়েছেন।
একটু চমৎকৃতই হলাম। বাপরে বাপ, সেই কবেকার কথা। আমার নিজেরই ঠিকমতো মনে নেই, আর এই পাঠক কিনা ঠিকই মনে রেখেছেন! বার্তাটা পরিষ্কার—এবার আর তা করা যাবে না। ঠিক আছে, তাহলে দিল্লি টু চেন্নাই এক দিনের পুরোনো গল্পটাই না হয় বলি। চেন্নাইয়ের গল্প পরেও করা যাবে। আছি তো আরও দুদিন।
দিল্লি এয়ারপোর্ট থেকেই তাহলে শুরু হোক। কনভেয়র বেল্টে লাগেজ নিতে গিয়ে দেখি, ট্রলি নিয়ে দাঁড়িয়ে লিসা স্টালেকার। এই বিশ্বকাপে আপনারা তাঁর কমেন্ট্রি শুনছেন, এর আগেও শুনেছেন হয়তো। কমেন্ট্রিই এখন তাঁর পেশা। এর বাইরে পেশাদার ক্রিকেটারদের সংগঠন ফিকার নেতৃস্থানীয় পদেও আছেন। আমার কাছে অবশ্য লিসা স্টালেকারের আসল পরিচয় অন্য। অস্ট্রেলিয়া নারী ক্রিকেট দলের সাবেক ব্যাটার।
সেই পরিচয়ে তাঁকে প্রথম আবিষ্কারের গল্পটা কেমন চমক হয়ে এসেছিল, তা এখনো স্পষ্ট মনে করতে পারি। ২০০৫ সালে আইসিসি সুপার সিরিজ কাভার করতে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছি। র্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর দলের সঙ্গে অবশিষ্ট বিশ্বের সিরিজ। যেটি নিয়মিত আয়োজনের ঘোষণা দিয়েও পরে সরে আসে আইসিসি। এটা অন্য গল্প। সিডনিতে অস্ট্রেলিয়া-অবশিষ্ট বিশ্ব ছয় দিনের টেস্ট ম্যাচের আগের দিন এসসিজির প্রেসবক্স থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখি, নেটে কে যেন ব্যাটিং করছেন। খুব সুন্দর গোছানো ব্যাটিং। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি, সঙ্গে সেই ট্যুরেই পরিচয় হওয়ার পর দারুণ বন্ধুতে পরিণত মুম্বাইয়ের মিড ডে পত্রিকার সাংবাদিক সঞ্জীব সাম্যাল। পরদিনের টেস্ট ম্যাচের কেউ বলে তো মনে হচ্ছে না, তাহলে কে? আরও ভালো করে দেখতে কাছে গিয়ে দেখি, ব্যাটিং করছে একটা মেয়ে!
সেই মেয়েটাই যে লিসা স্টালেকার, এতক্ষণে এটা আপনার বুঝে ফেলার কথা। এ নিয়ে নাটকীয়তা করার তাই কোনো অর্থ হয় না। পরে লিসা স্টালেকারের সঙ্গে কথা বলে আমি আর সঞ্জীব দুজনই স্টোরি করি। কথা বলার পর অবশ্য স্টোরি না করে উপায় ছিল না। গল্পটা কী দারুণ! ভারতীয় বাবা-মায়ের সন্তান, এক মার্কিন দম্পতি পুনের অনাথ আশ্রম থেকে তাঁকে দত্তক নিয়েছিলেন। পরে তাঁরা মিশিগান থেকে সিডনিতে এসে বসত গড়েন। নিছক কৌতূহল থেকে খোঁজ নিতে গিয়ে সঞ্জীবের জন্য এ তো রীতিমতো রত্নভান্ডার পেয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার। ভারতীয় পাঠকের জন্য এর চেয়ে দারুণ গল্প আর কী হয়!
এরপর লিসা স্টালেকারের সঙ্গে আমার এই প্রথম দেখা। এসসিজিতে প্রথম দেখার চমকের কথা বললাম। নিউ সাউথ ওয়েলস ক্রিকেটের অফিসে (তখন সেখানে পার্টটাইম চাকরি করতেন) গিয়ে আমরা দুজন যে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম, সেটাও। অবাক করে দিয়ে লিসা স্টালেকার বললেন, তাঁর নাকি এটা মনে আছে। ১৮ বছর আগের কথা কীভাবে মনে থাকে? লিসা একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘পরে তো আরও কত ইন্টারভিউই দিয়েছি। কিন্তু তখন তো বেশি মানুষ চেনে না। দুজন বিদেশি সাংবাদিক আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছে দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। এ কারণেই তা এখনো মনে আছে। তবে আপনার চেহারা মনে ছিল না।’
না থাকারই কথা। আগের সেই চেহারা কি আর আছে!
দিল্লি টু চেন্নাই ইন্ডিগোর ফ্লাইটে জানালার পাশে আমার সিট। একটু পর মাঝের সিটে এসে যিনি বসলেন, তাঁর মাথায় টুপি, মুখে লম্বা দাড়ি। বসার পর থেকেই কেমন যেন উসখুস করছেন। একটু অবাক হয়ে দেখছেন চারপাশ। আমার ওপর দিয়ে জানালায় উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছেন বারবার। তৃতীয়বারে আমি একটু বিরক্ত হয়ে তাকাতেই মুখে সরল একটা হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘এ মেরা পেহলা প্লেন জার্নি।’
শুনেই আমার মনটা একটু আর্দ্র হয়ে গেল। প্রায় ৩০ বছর আগে নিজের প্রথম প্লেন জার্নির সেই রোমাঞ্চ যে ফিরে এসেছে মনে। যত্ন করে সিটবেল্ট বেঁধে দিলাম। প্লেন টেক-অফ করার সময় কানে ব্যথা করবে কি না, এ নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছেন। কানে তুলাও গুঁজেছেন দেখছি। ব্যথা করবে না বলে আমি তাঁকে আশ্বস্ত করলাম। কানে তালা লাগলে ঢোঁক গেলার টোটকাও। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। নানা কিছু নিয়ে তাঁর কৌতূহলের উত্তর পুরো ফ্লাইটজুড়েই দিয়ে যেতে হলো।
পরিচয়পর্ব তো আগেই সারা হয়ে গেছে। নাম ওমর ফারুক। দিল্লির দারুল উলুম বিশ্ববিদ্যালয়ে আলিমে পড়ছেন। পরিবার থাকে চেন্নাইয়ে। এর আগে সব সময় ট্রেনেই যাতায়াত করেছেন। এবার বাধ্য হয়ে প্লেনে আসছেন, কারণ শরীর খুব খারাপ। টাইফয়েড হয়েছে। শুনে আমি যত্ন-আত্তি আরও বাড়িয়ে দিলাম। চূড়ান্ত স্যাক্রিফাইসটা করলাম চেন্নাইয়ে প্লেন নামার আগে জানালার পাশে আমার সিটটা তাঁকে ছেড়ে দিয়ে। ল্যান্ডিংয়ের সময় বিস্ময়াভূত আনন্দে ওমর ফারুকের ঝলমলে চোখমুখ দেখেই মন ভালো হয়ে গিয়েছিল। চেন্নাইয়ে নেমে ছবি তুললেন আমার সঙ্গে। চলে যেতে যেতেও ফিরে এসে জড়িয়ে ধরে যখন বললেন, ‘আপনাকে কোনো দিন ভুলব না’; আমার চোখ দুটি কেন যেন জ্বালা করতে লাগল।