হৃদয়ের কপালে নেই বিপিএল-ঘি, ঠকঠকালে হবে কী
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে থার্ডম্যানে ক্যাচ দিয়ে তাওহিদ হৃদয় যখন ফিরছিলেন, তখনো সম্ভবত দুশ্চিন্তাটা তাঁর মাথায় আসেনি। স্কোরবোর্ডে রান ৩.২ ওভারে ২ উইকেটে ৩০। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসে বারুদে ব্যাটিংয়ের অভাব নেই।
আন্দ্রে রাসেলের মতো ‘পারমাণবিক বোমা’ নামেন আটে! হৃদয় স্বাভাবিকভাবেই নিশ্চিত ছিলেন, কুমিল্লা বড় সংগ্রহই গড়বে এবং তাতে তৃতীয় দফায় তাঁর কপালটাও ফিরবে। আগের দুই দফায় তো আটকপালে মানে হতভাগ্য।
হৃদয়কে বলা হয় বিপিএলের আবিষ্কার। কিন্তু ২০২২ বিপিএলে সেভাবে আলো ছড়াতে পারেননি। সেটাই তাঁর প্রথম বিপিএল। খেলেছিলেন ফরচুন বরিশালের হয়ে। উঠেছিলেন ফাইনালেও। সেখানে অর্থাৎ ফাইনালে হৃদয়ের ব্যাটিং পজিশন ছিল গতকাল রাতের ফাইনালে রাসেলের ব্যাটিং পজিশন যেখানে—আট নম্বর। ৯ বলে ৯ রান করে আউট হয়েছিলেন। জিততে পারেনি তাঁর দলও। জয়ের জন্য শেষ বলে ৩ রানের সমীকরণ মেলাতে পারেননি হৃদয়। রানআউট হয়েছিলেন, কুমিল্লা জিতেছিল ১ রানে। হৃদয়ের হৃদয় ভাঙারও সেই শুরু।
কিন্তু ভাগ্য পাল্টাতে হয় নিজেকেই। অন্তত ব্যক্তিগত জায়গা থেকে হৃদয় তাতে সফলও। গত বছর বিপিএল স্মরণ করুন। হৃদয় সেবার দল পাল্টিয়েছিলেন। খেলেছিলেন সিলেট স্ট্রাইকার্সে। ১২ ইনিংসে ৫ ফিফটিসহ ১৪০.৪১ স্ট্রাইক রেটে ৪০৩ রান করেছিলেন হৃদয়—বিপিএলে সেবারের সংস্করণে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। বাংলাদেশ দলও পেয়ে গিয়েছিল তরুণ এক ‘হার্ড হিটার’কে। আর বিপিএল? এই টুর্নামেন্টের ইতিহাসে ১৪০-এর বেশি স্ট্রাইক রেটে ৪০০-এর বেশি রান করা একমাত্র বাংলাদেশি হৃদয়। কিন্তু তিনি নিজে কি পেয়েছিলেন? ০!
সেবারও ফাইনালে প্রতিপক্ষ কুমিল্লা। টুর্নামেন্টজুড়ে দারুণ খেলা হৃদয় ‘প্রমোশন’ পেয়েছিলেন—আগেরবারের ফাইনালে ব্যাটিং পজিশনে আট নম্বর থেকে সেবার একেবারে ওপেনার। কিন্তু ফাইনালের সঙ্গে হৃদয়ের কিসের যেন আড়ি! সেই ফাইনালে মাত্র ২ বল খেলেই তানভীর ইসলামের বলে বোল্ড। কোনো রান করতে পারেননি। আর সিলেটও হেরেছিল ৪ উইকেটে।
দানে দানে তিন দান বলে একটা কথা আছে। হৃদয়কে এবার এই কথায় বিশ্বাস রাখতেই হতো। বিশ্বাস ছিল তাঁর নিজের প্রতিও। আর সেই আত্মবিশ্বাসটা একেকটি মৌসুমে আরও বেড়েছে। ক্যারিয়ারের প্রথম বিপিএলে (২০২২) সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় ২৯তম স্থান (১০ ইনিংসে ১৩৬ রান) থেকে পরের বিপিএলে উঠে এসেছিলেন শীর্ষ তিনে। নাজমুল হোসেন ও রনি তালুকদারের পরই সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় তৃতীয়। আর এবার আরও এক ধাপ উঁচুতে—১৪ ইনিংসে ১ সেঞ্চুরি, ২ ফিফটিসহ ১৪৯.৫১ স্ট্রাইক রেটে ৪৬২ রান করা হৃদয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় দ্বিতীয়। কিন্তু তাঁর আটকপালে ভাগ্যের কি কোনো পরিবর্তন হলো? উত্তরটা এক কথায় দেওয়া যায়—না।
কেউ কেউ রসিকতা করে বলতে পারেন, বিপিএলে আগের দুবার ফাইনালে ভিন্ন দুই দলে খেলেও হৃদয় হাতে শিরোপা তুলতে পারেননি। দুবারই হারতে হয় কুমিল্লার কাছে। ভাগ্য পাল্টাতে হৃদয় তাই সম্ভবত এবার শুধু নিজের ব্যাটের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি। যোগ দিয়েছিলেন কুমিল্লায়। তাতে যদি ভাগ্য পাল্টায়! কিন্তু ফলটা এতক্ষণে আপনি নিশ্চয়ই জানেন।
শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে গতকাল রাতে বিপিএলের ফাইনালে কুমিল্লার হয়ে নিজের সাবেক ফ্র্যাঞ্চাইজি দল ফরচুন বরিশালের মুখোমুখি হয়েছিলেন হৃদয়। টুর্নামেন্টজুড়ে দারুণ ব্যাটিং করা হৃদয় এবার আরও পরিণত তাই কুমিল্লার ব্যাটিং অর্ডারেও পেয়েছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পজিশনটি—তিন। কিন্তু এবার ১০ বলে ১৫ রানে আউট। সেটাও জেমস ফুলারের বাইরের ওভারপিচড ডেলিভারিতে—যেটা অন্য কোনো সময় হয়তো মাটি কামড়ে কিংবা উড়িয়ে বাউন্ডারিতে পাঠাতেন, কিন্তু ম্যাচটা ফাইনাল ছিল বলেই সম্ভবত হৃদয়ের ভাগ্যে অন্য কিছু লেখা ছিল। থার্ডম্যানে ক্যাচ দিয়ে আউট।
তাতেও হৃদয় নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতেন যদি তাঁর ফাইনাল-ভাগ্যটা পাল্টাত। ফাইনালটা বরিশাল ৬ উইকেটে জেতায় সেটিও হলো না আর তাতে হৃদয়ের বিপিএল-ভাগ্যের ছবিটাও ধরা দিল গ্রিক ট্র্যাজেডির মতোই মর্মান্তিক ক্যানভাসে। তিনটি আলাদা দলের হয়ে বিপিএলে টানা তিন ফাইনাল খেলেও হৃদয় শিরোপাটা ছুঁয়ে দেখতে পারলেন না!
আসলে হৃদয়ের কী দোষ? নিজে তো চেষ্টা কম করেননি। কথায় আছে না, ‘কপালে না থাকলে ঘি, ঠকঠকালে হবে কী!’