লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়ের দিনভর ব্যাটিং, এবং বিমূঢ় অস্ট্রেলিয়া

মহাকাব্যিক এক জুটি গড়েন দ্রাবিড় ও লক্ষ্মণএএফপি
২০০১, ইডেন গার্ডেন, কলকাতা। মুখোমুখি ভারত-অস্ট্রেলিয়া। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সেরা প্রত্যাবর্তনের গল্পটা লেখা হয়েছিল ওই ম্যাচে। প্রথম ইনিংসে ২৭৪ রানে পিছিয়ে পড়া ভারত ফলো অন করতে নেমে চতুর্থ উইকেট হারিয়েছিল ২৩২ রানে। সেই ম্যাচও পরে ভিভিএস লক্ষ্মণ ও রাহুল দ্রাবিড়ের অবিশ্বাস্য এক জুটিতে অকল্পনীয়ভাবে জিতে গিয়েছিল ভারত। ১৪ মার্চ ২০০১ ছিল সেই বিখ্যাত টেস্টের চতুর্থ দিন। লক্ষ্মণ ও দ্রাবিড় সারা দিন ব্যাট করে ম্যাচের রং পাল্টে দিয়েছিলেন এই দিনে। সর্বকালের অন্যতম সেরা সেই টেস্টটা কাভার করেছিলেন উৎপল শুভ্র। ইডেন থেকে লেখা প্রথম আলোয় প্রকাশিত তাঁর সেদিনের প্রতিবেদন পাঠকদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে দুই যুগ আগে….

দিনের শুরুটা খুব ভালো হয়নি ভেংকট লক্ষ্মণের। সকালে পত্রিকা হাতে নিয়েই দেখলেন শিরোনাম দখলের লড়াইয়ে পরাজিত তিনি আরেক লক্ষ্মণের কাছে। ভারতের হতাশ করা পারফরম্যান্সের পরও টেস্টের প্রথম তিন দিন স্থানীয় পত্রিকাগুলোর শিরোনাম হয়েছে খেলাই।

আগের দিনের লক্ষ্মণের ওই পারফরম্যান্সের পর গতকালও তা হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। অথচ সকালে পত্রিকা হাতে নিয়ে লক্ষ্মণ দেখলেন, সবগুলো পত্রিকায় আট কলাম ব্যানার হেডলাইন দখল করে নিয়েছেন আরেক লক্ষ্মণ-শুধু যার নামের আগে ভেংকটের পরিবর্তে বঙ্গারু!

ক্ষমতাসীন বিজেপির সভাপতি বঙ্গারু লক্ষ্মণ প্রতিরক্ষা চুক্তির ব্যাপারে টাকা নিয়েছেন। গোপনে ভিডিও করে গত পরশুই তা বাজারে ছেড়েছে ভারতীয় ওয়েব সাইট তেহেলকা ডট কম। নামটি পরিচিত মনে হচ্ছে? মনোজ প্রভাকরের বহুল আলোচিত ভিডিওটিও ছিল তাদেরই করা। সেই ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পর বঙ্গারু লক্ষ্মণের বিজেপি সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ আর বিজেপি সরকারের টলোমলো অবস্থার খবর পত্রিকার নিচের দিকে ঠেলে দিয়েছিল ভেংকট লক্ষ্মণের ব্যাটিং-বীরত্বকে।

সারা দিন মাঠে যা হলো, সেটি যদি তার সে সময়কার প্রতিজ্ঞার রূপায়ণ হয়, তাহলে তিনি শতকরা দুশো ভাগ সফল! ভারতীয় পত্রিকাগুলো আজ ভেংকট লক্ষ্মণ-বন্দনার জন্য প্রথম পাতার আসল জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য।

আরও পড়ুন

টেস্টের চতুর্থ দিনে অবিশ্বাস্য যা হলো, চাইলে তা এক কথাতেই সেরে ফেলা যায়, আবার তা নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কাব্য রচনাও করা যায়। টেস্ট ক্রিকেটে একদিনে একটি উইকেটও না পড়া একেবারে বিরল কিছু নয়।

কিন্তু প্রথম ইনিংসে ১৭১ রানে অলআউট হয়ে ফলোঅন করতে নামা কোনো দলের এই রেকর্ড আছে কি না, ইডেন প্রেসবক্সের সবজান্তা স্কোরার রহমানও তা বলতে পারলেন না। এর সঙ্গে প্রতিপক্ষ দলটির কথা একটু বিবেচনায় নিন।

১৯২১ সালের ওয়ারউইক আর্মস্ট্রংয়ের অস্ট্রেলিয়া, ১৯৪৮ সালের স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়া, আশির দশকের ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে যারা সর্বকালের সেরার দৌড়ে নামতে বাধ্য করেছে, টানা ১৬টি জয়ের বিশ্ব রেকর্ড গড়া সেই স্টিভ ওয়াহর দলের বিপক্ষে এই পারফরম্যান্স! ইডেন গার্ডেন সত্যিকার বীরত্ব কাকে বলে, তা দেখল এদিন।

আরও পড়ুন

দেখালেন ভাঙিপুরাপ্পু ভেংকট সাই লক্ষ্মণ এবং রাহুল দ্রাবিড়। সকালে লড়াই শুরু করেছিলেন তারা, দিন শেষেও সেই লড়াইয়ে অপরাজিত। রেকর্ডের পর রেকর্ড পায়ে লুটিয়ে পড়েছেই, তার চেয়েও বড় কথা অ-নেক অ-নেক দিন ক্রিকেট বিশ্বকে একটা দৃশ্য উপহার দিয়েছে তা। গত বছর দেড়েকের মধ্যে এই প্রথম অস্ট্রেলীয় কোচ বুকানন প্রতিপক্ষকে চালকের আসনে বসে পড়ার স্বীকৃতি দিচ্ছেন। আর ক্যারিয়ারে এই প্রথম অ্যাডাম গিলক্রিস্ট টেস্ট ক্রিকেটে জয় ছাড়া অন্য অনুভূতির সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা বিমূঢ়। স্টিভ ওয়াহর দল এবার সত্যিকার পরীক্ষার সামনে!

চতুর্থ দিন শেষে মাঠ ছাড়ছেন দ্রাবিড় ও লক্ষ্মণ
এএফপি

ভারত তৃতীয় দিন শেষ করেছিল ৪ উইকেটে ২৫৪ রানে, চতুর্থ দিন শেষে রান ৫৮৯, ওই ৪ উইকেটেই। প্রথম ইনিংসে ২৭৪ রানের ঘাটতি কাটিয়ে ভারত এগিয়ে এখন ৩১৫ রানে। ম্যাচটা এখন পুরোপুরিই তাদের হাতে। চাইলে আজ সকালে অস্ট্রেলিয়াকে তারা একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে, চাইলে আরো যতক্ষণ সম্ভব ব্যাট করে ড্র নিশ্চিত করতে পারে। অনেক দিন পরে এই প্রথম স্টিভ ওয়াহ পার্শ্বচরিত্র, ম্যাচের রাশ তার হাতে নেই!

আরও পড়ুন

এতটা অসহায়ও আর তাকে লাগেনি কখনো। ম্যাকগ্রা-গিলেস্পি-ক্যাসপ্রোভিচ-ওয়ার্নদের ব্যর্থতার পর পন্টিং-হেইডেন-স্ল্যাটার-ল্যাঙ্গার কাকে দিয়ে চেষ্টা করতে বাকি রেখেছেন! এত কিছু করার পরপ লক্ষ্মণ আর দ্রাবিড় তাদের আউট করার একটি সুযোগ পর্যন্ত দেননি। এমন অসাধারণ সেই ব্যাটিং প্রদর্শনী যে, দিনের খেলা শেষে অস্ট্রেলীয় খেলোয়াড়েরা পর্যন্ত দুই ব্যাটসম্যান ড্রেসিংরুমে না ঢোকা পর্যন্ত হাতহালি দিয়ে গেল।

এই ছবিটাই যেন অস্ট্রেলিয়ানদের প্রতীকি ছবি
এএফপি

ইডেনে ভারতীয় কোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ স্কোর দিয়ে শুরু করে একে একে টেস্ট ক্রিকেটেই ভারতের পক্ষে সর্বোচ্চ স্কোর, ভারতের মাটিতে সর্বোচ্চ টেস্ট স্কোর-সব রেকর্ডই ভেঙে দিয়েছেন লক্ষ্মণ। রাহুল দ্রাবিড় কোনো ব্যক্তিগত রেকর্ড গড়েননি, তবে পঞ্চম উইকেট জুটিতে নতুন ভারতীয় পার্টনারশিপের উজ্জ্বল অংশীদার তিনি, টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের পক্ষে তিন শতাধিক রানের মাত্র চতুর্থ পার্টনারশিপও এটি।

অপরাজিত ১৫৫ রানের ইনিংসটির অবশ্য রেকর্ডের চেয়েও বেশি তাৎপর্য তার কাছে। ক্রমাগত ব্যর্থতায় সমালোচনা হচ্ছিল অনেক দিন ধরেই, শেষ পর্যন্ত এই টেস্টে নামিয়ে দেওয়া হলো ৬ নম্বরেই। রাহুল দ্রাবিড়ের তাই কিছু জবাব দেওয়ার ছিল। ব্যাট দিয়ে তো দিয়েছেনই, দিয়েছেন সেঞ্চুরির পর উদযাপনের সময়ও। তাকে ৮ টেস্টে ৭ বার আউট করা শেন ওয়ার্নের বলে বাউন্ডারি মেরে সেঞ্চুরিতে পৌঁছানোটা হয়তো আরো তাতিয়ে দিয়েছে তাকে।

২৮১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন লক্ষ্মণ
এএফপি

ওয়ার্ন অবশ্য সেঞ্চুরির পর হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন দ্রাবিড়কে। তা যে দিতে পেরেছেন, সে জন্য ওয়ার্নের প্রশংসাই করতে হয়। তিন বছর আগে এই মাঠে ১৪৭ রান দিয়ে উইকেটশূন্য ছিলেন ওয়ার্ন। গতকাল চতুর্থ দিন শেষে ১৫২ রানে তার ১ উইকেট। ১০ বছর আগে ভারতের বিপক্ষে অভিষেকের পর টেস্ট ক্রিকেটে এমন ধোলাই খাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি তার!

আরও পড়ুন