হৃদয়ের বুকে সাহস চান হাথুরুসিংহে
সংবাদমাধ্যমের সামনে আজ যে ক্রিকেটারই আসতেন, তাঁর জন্যই প্রশ্নটা ছিল অবধারিত—কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সঙ্গে তো কাল সব ক্রিকেটারেরই একক আলোচনা হলো। আপনাকে তিনি বিশেষ কী বলেছেন?
টিম হোটেল গ্র্যান্ড সিনামনের সবুজ লনে পড়ন্ত বিকেল। ভারত মহাসাগর থেকে উড়ে আসা মাতাল হাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে এমন ক্রিকেটীয় আলোচনা ঠিক মানাচ্ছিল না। তার ওপর তাওহিদ হৃদয় এলেন মাত্র ভাতঘুম থেকে উঠে, ঘুম ঘুম চোখে। জিমে যাবেন, তারপর রাতে প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে অনুশীলন। তার আগে অমন রোমান্টিক বিকেলে এই তরুণ ব্যাটসম্যানের কাঁধেই দায়িত্ব পড়ল বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে কিছু বলার।
ঘুরেফিরে সেই প্রশ্নটা এল—তাঁকে বিশেষ কী বলেছেন কোচ? এশিয়া কাপের প্রথম তিন ম্যাচে ২০, ০ আর ২ রান করে হৃদয়ের ব্যাটিং যখন একটু একটু করে হাহাকার ছড়াচ্ছিল, তখনই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচে ৮২ রানের ইনিংস। হৃদয় অবশ্য বলেছেন, দলের কাজে লাগেনি বলে নিজের ইনিংসটাকেও তাঁর এখন আর তেমন কাজের মনে হচ্ছে না। যেটা দলের কাজে লাগে না, সেটা নিয়ে বাহাদুরিরই বা কী আছে!
তার চেয়ে কোচের কথা শুনে সামনে এমন কিছু করতে চান, যেটা দলকে ভাসাবে জয়ের আনন্দে। এই ‘সামনে’ বলতে শুধু এশিয়া কাপের ভারত ম্যাচটাই নয়। হৃদয়কে কোচের এই পরামর্শ সব সময়ের জন্য, ‘কোচ আমাকে সব সময় সাহস নিয়ে খেলতে বলেছেন, যেটা আমি খেলি। তিনি বলেছেন, তুমি প্রতিটা ম্যাচে রান করবে না, প্রতিটা ম্যাচে পারফর্ম করবে না। তবু তোমার খেলার যে ধরন, সেটা বদলাবে না।’
প্রশ্নটা যদিও সবার জন্যই ‘কমন’ হতো, আজকের দিনের হিসাবে কথা বলার জন্য উপযুক্ত ক্রিকেটার হৃদয়ই ছিলেন। সাকিব আল হাসান কাল সকালে দুবাই হয়ে কলম্বো পৌঁছে গেলেও স্ত্রী ও নবজাতক সন্তান কিছুটা অসুস্থ বলে ছুটি নিয়ে ঢাকায় যাওয়া আরেক ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম আসেননি। শেষ পর্যন্ত ভারত ম্যাচটা খেলছেন না তিনি। মুশফিকের অনুপস্থিতিতে হৃদয়কেও মিডল অর্ডারে কিছুটা বাড়তি দায়িত্ব নিতে হতে পারে।
তরুণ হৃদয় সবকিছুকেই সহজভাবে নিতে পছন্দ করেন। ‘কঠিন’ বলে শব্দটা না মানাই তারুণ্যের ধর্ম। বয়সে তরুণ, নামে হৃদয় ‘তাওহিদ’ই বা ব্যতিক্রম কেন হবেন? কেউ নেই বলে নিজের কাজ বেড়ে যাচ্ছে, এমন ভাবলেই চাপ। হৃদয় তাই হাঁটতে চান সোজা পথে, ‘কার সঙ্গে খেলা, কার সঙ্গে দায়িত্ব বেড়ে যাচ্ছে...এসব নিয়ে ভাবি না। আমি সব সময় চেষ্টা করি প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকতে। যেই দিনটাতে আমি খেলব, সেই দিনটাতে আমি সব সময় চেষ্টা করি দলের জন্য যেন অবদান রাখতে পারি।’
আগামী শুক্রবার আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার ভারত ম্যাচ নিয়েও তাঁর একই দর্শন, ‘আমার কোনো প্রত্যাশা নেই। আমি বিশেষ কিছু চিন্তা করছি না এই ম্যাচ নিয়ে। যখন মাঠে যাব, চেষ্টা করব দলের জন্য কিছু করতে।’
ব্যাটসম্যান হৃদয়ের মধ্যে এখন পর্যন্ত যে গুণটা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান, সেটা হলো মাঠে গিয়েই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে খেলতে পারেন। উইকেটে থিতু হতে খুব একটা সময় নেন না। ব্যাটিং দেখে মনে হয় যেন এতক্ষণ ড্রেসিংরুমেও ব্যাটিংই করছিলেন!
এ ক্ষেত্রে হৃদয়ের ফর্মুলা খুব সহজ, যেটা তিনি আগেও বলেছেন, ‘আমি সব সময় মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকি। আগেও বলেছি, আমি সব সময় চেষ্টা করি দলের জন্য অবদান রাখতে। আমি প্রতিটা বল খেলি রানের জন্য। এভাবেই আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকি। আমার শরীরও সেভাবে সাড়া দেয়।’
সব সময় সবকিছুর জন্য প্রস্তুত থাকার মানসিকতাটা দলের প্রয়োজনে যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় ব্যাটিং করারও সাহস দেয় হৃদয়কে, ‘আমি যেকোনো জায়গার জন্য প্রস্তুত আছি। দলের যেটা চাহিদা, যদি মনে করে আমাকে ওয়ান ডাউনে খেলাবে, যদি মনে করে মিডল অর্ডারে খেলাবে এবং যদি মনে করে যে আমাকে স্লগে খেলাবে; তা-ও আমি প্রস্তুত থাকব।’
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার হৃদয়। টুর্নামেন্টের চাপ কী জিনিস, সেটা তাঁর অজানা নয়। তবে জাতীয় দলে এসে টুর্নামেন্ট খেলছেন এবারই প্রথম। দ্বিপক্ষীয় সিরিজের সঙ্গে এর কিছু পার্থক্য নিশ্চয়ই খুঁজে পেয়েছেন তিনি।
কিন্তু হৃদয় বললেন অন্য কথা, ‘আমার মনে হয় এখানে অনেক অভিজ্ঞ বোলারকে খেলতে হয়েছে। তবে একজন খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিটা দিন, প্রতিটা ম্যাচ, প্রতিটা বল আমার কাছে একই মনে হয়। বড় টুর্নামেন্ট বা ছোট প্রতিপক্ষ, অন্য দলে কে আছে—আমি এই সব দেখি না। আমি সব সময় চেষ্টা করি যেন বলটা দেখি, বল দেখে খেলারই চেষ্টা করি। সেটা যেকোনো পরিবেশেই...ওয়ার্ল্ড কাপ হতে পারে, এশিয়া কাপ হতে পারে, একটা ছোট দলের সঙ্গে সিরিজও হতে পারে।’
এই অল্প কদিনে হৃদয়ের এই ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ধরতে পেরেছেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহেও। আর সে জন্যই তাঁকে দিয়েছেন ‘লাইসেন্স টু কিল’—সব গুলি লাগবে না। তবু গুলি ছুড়তে থাকো। আর সাহস রাখো বুকে।