গাদ্দাফিতে এবার অন্য ছবি দেখবে বাংলাদেশ
‘ওই যে বড় স্টেডিয়ামটা দেখছেন, ওটা ক্রিকেটের। গাদ্দাফি স্টেডিয়াম। পাশের ছোট মাঠটা সাইক্লিংয়ের জন্য। ওদিকে ন্যাশনাল হকি স্টেডিয়াম। বাঁ দিকে লাল ইটের গোল গ্যালারির মতো যেটা দেখছেন, ওখানে হয় কাবাডি। আর সামনের এটা ন্যাশনাল একাডেমি। পুরো এলাকাটাই খেলার জন্য।’
শেষ বাক্যটা না বললেও পারতেন রুম ক্লিন করতে আসা গ্র্যান্ড পাম হোটেলের হাউস কিপিং কর্মী। আটতলার রুম থেকে জানালার পর্দা সরালেই নিচে মহাসড়কের মতো প্রশস্ত কাসুর রোড, যেটির দুই পাশের লেন বিভাজিত হয়ে গেছে লাহোর মেট্রো বাসের চলাচলের জন্য। এই মেট্রো বাসে নাকি ৪০ রুপিতে পুরো লাহোর ঘোরা যায়!
কাসুর রোডের ঠিক ওপাশেই গাদ্দাফি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম এবং তার আশপাশে অন্যান্য ক্রীড়া স্থাপনা মিলিয়ে রীতিমতো একটা স্পোর্টস কমপ্লেক্সই বলা চলে। পুরো এলাকাটাই যে খেলার জন্য, সেটি তাই আর বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
২০০৮ সালে সর্বশেষ এসে যেমন দেখেছি, পাকিস্তানের ‘গার্ডেন সিটি’ লাহোর এখনো সে রকম সবুজই আছে। কিছু উঁচু দালান উঠেছে, কিন্তু তাতে শহরের সবুজ সৌন্দর্য এতটুকু ঢাকা পড়েনি। গুলবার্গের সেই বিশাল চত্বর এখনো আগের মতোই এলায়িত ভঙ্গিতে পড়ে আছে শহরের মাঝখানে। রাস্তাঘাট প্রশস্ত হওয়ায় লাহোরের সৌন্দর্য বেড়েছে বলেই মনে হলো।
পাকিস্তানের অন্যতম এই সুন্দর শহরের বিশেষণেরও অভাব নেই। ‘দ্য হার্ট অব পাকিস্তান’, ‘প্যারিস অব দ্য ইস্ট’, ‘সিটি অব গার্ডেনস’, ‘সিটি অব লিটারেচার’—কত নামেই না ডাকা হয় লাহোরকে! তবে আপাতত এই শহর ক্রিকেটের শহর, এশিয়া কাপের অন্যতম ভেন্যু।
পরশুর বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ম্যাচটা লাহোরবাসীকে ভালোই দোলা দিয়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে খেলা কাভার করতে এসেছি বললেই মিরাজ-নাজমুলদের দুর্দান্ত কীর্তির জন্য অভিনন্দিত হচ্ছি। দুজনই সেঞ্চুরি করে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের অনার্স বোর্ডে নাম উঠিয়েছেন। আফগানিস্তানকে ৮৯ রানে হারিয়ে বাংলাদেশ যে আজকের শ্রীলঙ্কা-আফগানিস্তান ম্যাচের আগেই সুপার ফোর নিশ্চিত করে ফেলল, সেটা তো তাঁদের ওই কীর্তির সুবাদেই।
পরশু গভীর রাতে দুবাই থেকে লাহোরে পৌঁছে এখন পর্যন্ত এখানে যত মানুষের সঙ্গে খেলা নিয়ে কথা হয়েছে, সবাই রীতিমতো বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে মুগ্ধ। তাঁদের একটা অংশ ঐতিহাসিক কারণেই প্রচণ্ড আফগানবিরোধী। আফগানিস্তানের যেকোনো কষ্টেই সম্ভবত তাঁরা হাসেন। আরেকটা অংশ আবার বাংলাদেশের খেলা খুব পছন্দ করেন। এক পাকিস্তান ছাড়া বাংলাদেশ যে দলের সঙ্গেই খেলুক, তাঁরা বাংলাদেশের সমর্থক। আফগান–সমর্থকদের ভিড় ঠেলে এ রকমই কিছু মানুষ পরশুর ম্যাচে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের জন্য গলা ফাটিয়েছেন।
তবে গাদ্দাফিতে আগামীকাল যে ভিন্ন চিত্রই দেখা যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সুপার ফোরে নিজেদের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। বাংলাদেশকে এই ম্যাচ জিততে বাবর আজমের পাকিস্তান দলের সঙ্গে হারাতে হবে গ্যালারিতে থাকা পাকিস্তানি সমর্থকদের ‘পাকিস্তান, পাকিস্তান’ কোরাসকেও। পরশুর ম্যান অব দ্য ম্যাচ মেহেদী হাসান মিরাজ অবশ্য আগে থেকে এসব ভেবে দমার পাত্র নন। পাকিস্তানের বিপক্ষে জিতেই সুপার ফোর শুরু করতে চান তাঁরা, বাংলাদেশ থেকে আসা দুই সাংবাদিকের সঙ্গে কথোপকথনের সময় কাল এই আত্মবিশ্বাসটাই তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন দলের মধ্যে।
সুপার ফোর নিশ্চিত করা জয়ের পর কাল সারা দিন বিশ্রামে ছিল বাংলাদেশ দল। বিশ্রাম বলতে অবশ্য অনুশীলন থেকে দূরে থাকাই। নইলে দুপুর এবং রাতে দলের জন্য ছিল দুটি নিমন্ত্রণ। প্রথমটি স্থানীয় বাংলাদেশ হাইকমিশনের পক্ষ থেকে মধ্যাহ্নভোজের। নিরাপত্তার বেড়াজাল থাকায় এই আয়োজনটা সারতে হয়েছে টিম হোটেল পার্ল কনটিনেন্টালেই। সন্ধ্যায় গভর্নর্স হাউসে ছিল লাহোরে থাকা এশিয়া কাপের চার দল বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান ও স্বাগতিক পাকিস্তান দলের জন্য পিসিবির সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।
এমনিতে শান্তিপূর্ণ শহর হিসেবে পরিচিত শিল্প-সংস্কৃতির ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ লাহোর। কিন্তু তাদের সেই পরিচয়ে বড় একটা দাগ লেগে যায় ২০০৯ সালে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের খুব কাছে শ্রীলঙ্কা দলের বাসে সন্ত্রাসীদের বন্দুক হামলার ঘটনায়। ওই ঘটনা পাকিস্তান থেকে ছয় বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে। এখন অবশ্য আবার সব দলই পাকিস্তানে আসছে, ক্রিকেট খেলছে। খেলছে না শুধু ভারত।
২০০৯ সালের ঘটনার মতো ভয়াবহ না হলেও বিদেশি দলের উপস্থিতিতে পাকিস্তানের নিরাপত্তার ঝামেলায় পড়ার নজির আরও আছে। সে জন্যই পাকিস্তান সফরের আগে যেকোনো দল এ নিয়েই সর্বোচ্চ সতর্ক থাকে। সফরের এমওইউতেও প্রাধান্য পায় নিরাপত্তাব্যবস্থা।
ছয় দলের এশিয়া কাপকে নিশ্ছিদ্র রাখতেও সব রকম ব্যবস্থাই নিয়েছে পাকিস্তান। দলগুলোর মাঠে আসা-যাওয়ার সময় রাস্তা ফাঁকা করে দেওয়া তো আছেই, টিম হোটেল পার্ল কনটিনেন্টালও ঢেকে ফেলা হয়েছে নিরাপত্তার চাদরে। হোটেলের যেসব ফ্লোরে ক্রিকেটারদের রুম, সেসব ফ্লোরে সাধারণ অতিথিদের প্রবেশাধিকার নেই। আবার ক্রিকেটার বা দলের সদস্যরাও চাইলেই হোটেল থেকে বের হতে পারেন না। এমনকি হোটেলের ভেতরে থাকা রেস্তোরাঁয় খেতে গেলেও নাকি আশপাশে থাকছেন ‘সাদা পোশাকে’র কেউ।
পাকিস্তানের এত চেষ্টার পরও অবশ্য দেশটিতে না এসেই এশিয়া কাপ খেলছে ভারত। মূলত তাদের আপত্তির মুখেই টুর্নামেন্টটা এবার পাকিস্তানের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কায়ও হচ্ছে। এ নিয়ে পাকিস্তানের মানুষের মনে ক্ষোভ আছে। নিরাপত্তাব্যবস্থায় সন্তুষ্ট হয়ে যখন তাঁদের দেশে অন্য সব দলই ক্রিকেট খেলতে আসছে, সেখানে ভারতের ‘অপারগতা’কে তাঁরা দেখছেন পাকিস্তানের ক্রিকেটের অমঙ্গল কামনার নিদর্শন হিসেবে।
টুর্নামেন্টে ভারত সব ম্যাচ খেলবে শ্রীলঙ্কায়, এমনকি সুপার ফোরে তাদের বিপক্ষে ম্যাচটা পাকিস্তানকেও ঘরের মাঠ ফেলে খেলতে হবে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে। ১৭ সেপ্টেম্বর শ্রীলঙ্কায়ই হবে টুর্নামেন্টের ফাইনাল।
এর মধ্যে ভারতকে রেখে দুই প্রান্তের দুই দেশ মিলিয়ে খেলা বলে দলগুলোর ভ্রমণঝক্কি বেড়েছে। বাংলাদেশ দলকেই যেমন পাল্লেকেলেতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ খেলে আফগানিস্তানের সঙ্গে খেলতে ভারত পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে লাহোরে। কাল পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলে সুপার ফোরের বাকি ম্যাচ খেলতে আবার তাদের শ্রীলঙ্কায় চলে যেতে হবে।
শ্রীলঙ্কায় এখন পর্যন্ত সুপার ফোর ও ফাইনাল ম্যাচের ভেন্যু কলম্বোই আছে। তবে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, কলম্বোয় বৃষ্টির প্রবল আশঙ্কা থাকায় শ্রীলঙ্কারই অন্য কোনো শহরে সরিয়ে নেওয়া হতে পারে ম্যাচগুলো। সেটা হতে পারে হাম্বানটোটা, ডাম্বুলা নয়তো ক্যান্ডিতে। অবশ্য এ ব্যাপারে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা নেই।