ইনজামামকে মনে করানো শাকিলের বিশ্বকাপ দলেই থাকার কথা ছিল না
তারকা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সবচেয়ে বড় মঞ্চ বিশ্বকাপ। আর বিশ্বকাপের তারকা মানে তো ইতিহাসেরও তারকা। ৩১ বছর আগে তেমনই এক বিশ্বকাপ দিয়ে বিশ্বমঞ্চে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছিলেন ইনজামাম-উল-হক। ১৯৯২ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলেছিলেন দুর্দান্ত এক ইনিংস। সেদিন মাত্র ৩১ বলে ফিফটি করেছিলেন ইনজামাম, যা কিনা এখনো বিশ্বকাপে পাকিস্তানের হয়ে দ্রুততম ফিফটি। গত পরশু সেই রেকর্ড ভাঙতে না পারলেও কাছাকাছি গিয়ে ঠিকই ইনজামামকে মনে করিয়েছেন সৌদ শাকিল। শাকিল ফিফটি করেছেন ৩২ বলে, যা বিশ্বকাপে পাকিস্তানের হয়ে দ্বিতীয় দ্রুততম ফিফটি।
শুধু ফিফটিতেই নয়, আরও একটি দিক থেকে ইনজামামকে মনে করিয়েছেন শাকিল। ’৯২ বিশ্বকাপের আগে ক্রিকেট দুনিয়ায় ইনজামাম ছিল অপরিচিত একটি নাম। নেটে ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে দলে নেন অধিনায়ক ইমরান খান। ১৯৯১ সালে অভিষেকের পর পরের বছর সুযোগ পান বিশ্বকাপেও। আর বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ইনিংসটি দিয়ে নিজের জায়গা খোদাই করে নেন ইনজি।
একইভাবে তিন মাস আগেও পাকিস্তানের সম্ভাব্য বিশ্বকাপ দলের আশপাশেও ছিল না শাকিলের নাম। ২০২১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ওডিআই অভিষেক হলেও তাঁকে মূলত বিবেচনা করা হচ্ছিল টেস্ট স্পেশালিস্ট হিসেবে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরির পর সেই ধারণা আরও পোক্ত হয়। আগস্টে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে সুযোগ পেলেও মাত্র এক ম্যাচ খেলার সুযোগ পান এই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান।
এরপর অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে এশিয়া কাপ দলে জায়গা হয় তাঁর। কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে, এখানেও রয়েছে ইনজামাম-সংযোগ। মূলত টিম অ্যানালিস্ট হাসান চিমা এবং ম্যানেজার রেহান-উল-হক তাঁকে দলে রাখার ব্যাপারে রাজি করান প্রধান নির্বাচক ইনজামামকে। দলে জায়গা পেলেও সর্বশেষ এশিয়া কাপে একটি ম্যাচও খেলার সুযোগ হয়নি তাঁর। তবে এশিয়া কাপে না খেলাটাই মূলত দুয়ার খুলে দেয় তাঁর জন্য। অলরাউন্ডার ফাহিম আশরাফের জায়গায় ১৫ সদস্যের বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পান শাকিল।
শাকিলের দলে সুযোগ পাওয়া নিয়ে সাবেক অলরাউন্ডার মোহাম্মদ হাফিজ বলেছেন, ‘দুই মাসেও টিম ম্যানেজমেন্টের পরিকল্পনায় সে ছিল না। আমি তার সঙ্গে ড্রেসিংরুমে কিছু সময় কাটিয়েছি, আমি জানি, এই খেলা নিয়ে তাঁর প্যাশন কেমন। আর সে এখন সবাইকে ভুল প্রমাণ করেছে।’
বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁকে বাজিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয় টিম ম্যানেজমেন্ট। সেটিই সৌদের জন্য গেম চেঞ্জিং মোমেন্ট ছিল। সেই ম্যাচে ৫৩ বলে ৭৫ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন সৌদ। সেই ইনিংসটি মূলত তাঁকে বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সুযোগ করে দেয়। আর এই ম্যাচে দল যখন ৩৮ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে কাঁপছিল, তখনই দারুণ এক ইনিংস খেলেন সৌদ। রিজওয়ানের সঙ্গে মিলে চতুর্থ ইনিংসে গড়েন ১১৪ বলে ১২০ রানের জুটি। আর দলীয় ১৫৮ রানে ফেরার আগে তাঁর ব্যাট থেকে আসে ৫২ বলে ৬৮ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস, যা পাকিস্তানকে শেষ পর্যন্ত ২৮৬ রানের চ্যালেঞ্জিং সংগ্রহ গড়ার ভিত গড়ে দেয়।
কেউ চাইলে বলতে পারেন, নেদারল্যান্ডসের মতো দলের বিপক্ষে ৬৮ রানের ইনিংসে উচ্ছ্বসিত হওয়ার সুযোগ কোথায়? তবে যে পরিস্থিতি ও যে প্রক্রিয়ায় সৌদ ইনিংসটি খেলেছেন, তা আক্ষরিক অর্থেই প্রশংসা করার মতো। উইকেটের চারপাশে শট খেলেছেন সাবলীলভাবে। দ্রুত উইকেট হারানোর পরও মন্থর ব্যাটিংয়ে দলের ওপর চাপ বাড়াননি। বরং রানের চাকা সচল রেখেছেন দারুণভাবে। ১৩০.৭৬ স্ট্রাইক রেটে রান করলেও স্ট্রাইক রোটেশনেও ছিল দেখার মতো। যেখানে ৬৮ রানের মধ্যে ২৪ রানই এসেছে সিঙ্গেল থেকে।
ম্যাচ শেষে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সৌদ অবশ্য ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের চেয়ে দলের জয়কেই গুরুত্ব দিলেন বেশি, ‘আমি দলের জয়ে সাহায্য করতে পেরে আনন্দিত। আমি নিজের মৌলিক কাজগুলো ঠিকভাবে করার চেষ্টা করেছি এবং শুরুতে চাপে পড়ার পরও দলের জন্য ইতিবাচক থাকার চেষ্টা করেছি। আমি সৌভাগ্যবান যে শুরুতেই বাউন্ডারি পেয়েছি। আমি সে সময় রিজওয়ানের সঙ্গে আলাপ করে কৌশল ঠিক করেছি যে যদি রান আসতে থাকে, তবে চাপ ওদের ওপর গিয়ে পড়বে, যা হয়েছেও।’ তবে দারুণ এই ইনিংসের পর ম্যাচ সেরার পুরস্কারটা তিনি উৎসর্গ করেছেন কোচ হানিফ মালিককে, ‘কোচিং স্টাফরা আমাকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। আমি আমার কোচ হানিফ মালিককে ধন্যবাদ দিতে চাই। এটা তাঁর জন্য।’
পরশুর ইনিংসের পর দারুণভাবে প্রশংসিত হচ্ছেন সৌদ। তবে গত বছরের ডিসেম্বরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেকের আগেই তাঁকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সাবেক অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ। সরফরাজ বলেছিলেন, ‘শাকিলের সফল তারকা হওয়ার মতো সামর্থ্য এবং টেম্পারামেন্ট আছে। আমার কথা লিখে রাখুন, শাকিল পাকিস্তানের পরবর্তী বড় তারকা হতে যাচ্ছে।’ আর নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ইনিংসের পর তাঁকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন সাবেক ক্রিকেটাররা।
হাফিজ বলেছেন, ‘পাকিস্তান যখন উইকেট হারিয়ে কাঁপছিল, তখন সৌদ শাকিলের ইনিংসটি দলকে উদ্ধার করে। তাঁর টেকনিক খুবই ভালো। যেভাবে সে চাপ সামলেছ, তার কৃতিত্ব তাঁকে দিতেই হবে।’
ম্যাচ-পরবর্তী আলোচনায় সৌদের প্রশংসা করেছেন সাবেক অধিনায়ক রমিজ রাজাও। নিজের ইউটিউব চ্যানেলে রমিজ বলেছেন, ‘সৌদ শাকিলকে খেলানো ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। আর যেভাবে সে খেলেছে, সেটাও দারুণ ব্যাপার ছিল। তার ম্যাচ পরিকল্পনাও দারুণ ছিল। আর আমি আগেও বলেছি, সে শিগগির স্পিনে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন হবে। কারণ, তার টেকনিক ভালো এবং টেম্পারামেন্টও দারুণ। বড় শটও সে মারতে পারে। সে পাকিস্তানের অনেক বড় প্রতিভা। সৌদ এখন পাকিস্তানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়।’