জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে যে কারণে ফিরল পুরোনো বাংলাদেশ
খেলা শেষ হয়েছে প্রায় তিন ঘণ্টা আগে। হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠের ড্রেসিংরুম থেকে তখনো জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দলের হইচইয়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। একটু খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তারাও যোগ দিয়েছেন ক্রিকেটারদের উদ্যাপনে। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বোর্ডের এক কর্মকর্তা তো বললেনই, বোর্ডকর্তা ও ক্রিকেটারদের উদ্যাপনের এমন দৃশ্য জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে শেষ কবে দেখেছেন, তিনি মনে করতে পারছেন না। কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয় তো দূরের কথা, ওয়ানডে ম্যাচ জিততেও যে ভুলতে বসেছিল জিম্বাবুয়ে!
সেই জিম্বাবুয়ের কাছে টানা দুই ম্যাচে হেরেছে বাংলাদেশ। তিন ম্যাচের সিরিজে শেষ ম্যাচ বাকি থাকতেই সিরিজ জয় নিশ্চিত জিম্বাবুয়ের। বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের সাম্প্রতিক রেকর্ড বিচারে যা নতুন এক অভিজ্ঞতাই। ওয়ানডে ক্রিকেটে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দাপট দেখিয়েই অভ্যস্ত বাংলাদেশ। আইসিসি ওয়ানডে সুপার লিগের পয়েন্ট তালিকায়ও দুই নম্বরে বাংলাদেশের অবস্থান। তবু এই সিরিজ হার যেন বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার শুরুর দিকের দুরবস্থা ও জিম্বাবুয়ের আধিপত্যের সময়টা মনে করিয়ে দিয়েছে।
কেনো এমন হলো? গতকাল এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গো প্রথমে কিছুক্ষণ মাথা নাড়লেন। এরপর ছোট্ট করে বললেন, ‘অনেক কিছুর সংমিশ্রণ হলো এই ফল।’ ডমিঙ্গো আলাদা করে উল্লেখ না করলেও ব্যাটিং ও বোলিংয়ের জন্য সমান ভালো উইকেটে বাংলাদেশ দলের সামর্থ্যের বিষয়টি এই সিরিজে সামনে এসেছে।
হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে প্রথম দুই ম্যাচেই আগে ব্যাট করে স্বাগতিকদের ৩০০ রানের আশপাশে লক্ষ্য দিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু দুই ম্যাচেই পরে মনে হয়েছে, এ রানটা যথেষ্ট ছিল না এমন উইকেটে। তাড়া করতে নেমে জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানরাই সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। ব্যাটসম্যানদের ম্যাচের অবস্থা বুঝে খেলার দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। প্রথম ম্যাচে তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম ও দ্বিতীয়টিতে মাহমুদউল্লাহ মন্থর ফিফটি করে সমালোচিত হয়েছেন এ কারণে। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে আরেকটু দ্রুত রান করতে পারলে স্কোরটা বড় হতো বাংলাদেশের।
তবু প্রথম ম্যাচে ৩০৩ রান, দ্বিতীয়টিতে ২৯০—ভালো বোলিং করলে এই রানেও জয় সম্ভব। কিন্তু দুটি ম্যাচেই বাংলাদেশের বোলিং ছিল গড়পড়তা। প্রথম ম্যাচে তো পেসাররা যেন মাঠেই আসেননি! সিকান্দার রাজা ও ইনসেন্ট কাইয়া স্বাচ্ছন্দ্যে খেলে গেছেন কোনো চ্যালেঞ্জ ছাড়াই। শরীর তাক করা বাউন্সার ছিল না, ছিল না কোনো ইয়র্কার। দ্বিতীয় ম্যাচে হাসান মাহমুদকে সে চেষ্টা করতে দেখা গেছে। কিন্তু তাসকিন আহমেদ ও শরীফুল ইসলামের বোলিং ছিল নির্বিষ।
স্পিনাররা না পেরেছেন রান থামাতে, না পেরেছেন উইকেট নিতে। অথচ স্পিন দিয়ে বছরের পর বছর জিম্বাবুয়েকে বধ করে এসেছে বাংলাদেশ। সেই স্পিনই জিম্বাবুয়ে এবার খেলেছে স্বাচ্ছন্দ্যে। ডমিঙ্গো কাল নিজেই বলছিলেন, ‘বড় পার্থক্য ছিল, ওরা আমাদের স্পিনারদের ভালো খেলেছে।’
ভালো উইকেটে বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং-বোলিংয়ের সঙ্গে ফিল্ডিংয়ের বিষয়টি জড়িত। সাদা বলের ক্রিকেটে একটু বল থেমে আসে—এমন উইকেটে বাংলাদেশের সব বোলাররাই অভ্যস্ত। যেখানে শট খেলা কিছুটা কঠিন, সেখানে রান থামিয়ে ব্যাটসম্যানকে ভুল শট খেলতে বাধ্য করা বাংলাদেশ দলের উইকেট নেওয়ার সবচেয়ে পরিচিত কৌশল। সে জন্য উইকেটের সাহায্যটা জরুরি। সেই সাহায্য কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ দলের বোলাররা বারবার সুযোগ সৃষ্টি করতে অভ্যস্ত। বাজে ফিল্ডিং, বাজে ক্যাচিং তিন থেকে চার বছর ধরেই বাংলাদেশ দলের চলমান অসুখ। কিন্তু এ সময় বাজে ফিল্ডিং করেও বাংলাদেশ অনেক ম্যাচ জিতেছে। কারণ, উইকেটের সাহায্য পেয়ে বোলাররা বাংলাদেশকে ম্যাচে রেখেছেন। একটি সুযোগ হাতছাড়া হলেও আরেকটি সুযোগ এসেছে। যাচ্ছেতাই ফিল্ডিং করেও বাংলাদেশ অনেক ম্যাচ জিতেছে এ কারণেই।
হারারেতে এই সিরিজের উইকেট ছিল ব্যাটিং–স্বর্গ। বারবার সুযোগ এই উইকেটে আসবে না। ফিল্ডিংয়ে রান থামিয়ে চাপ সৃষ্টি করা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাচ, রানআউটের সুযোগগুলো অন্তত দুহাতে লুফে নিতে হবে। অথচ বাংলাদেশ সহজ ক্যাচ ছেড়েছে অহরহ। ৩০ গজ হোক কিংবা বাউন্ডারি সীমানা, ফিল্ডারদের হাতে বল রেখে এক-দুই করে নিয়েছে জিম্বাবুয়ে। গতকাল তো মিড অন, মিড অফের হাতে বল ঠেলে হেসেখেলে সিঙ্গেল নিয়েছেন চাকাভা-রাজারা। যেন জিম্বাবুইয়ানদের পূর্ণ আত্মবিশ্বাস ছিল—সরাসরি থ্রোতে স্টাম্প ভাঙতে পারবে না বাংলাদেশের কেউই। শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তা-ই।
ডমিঙ্গো চাপের মুখে দলীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়টিও সামনে এনেছেন। বোলারদের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘যখন যে বলটা করা দরকার, সেটা ওরা করতে পারছে না। ফিল্ডার ওপরে রেখে যে ধরনের বল করা দরকার, সেটা হচ্ছে না। করছে আরেকটা। আবার ফিল্ডার বাইরে রাখলে দেখা যায়, যে বল করা দরকার সেটা না করতে অন্য কিছু করছে। এসব শুধু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সমস্যা। চাপের মুখে পারফর্ম করতে পারছি না।’
এ তো গেল কৌশলগত ভুলের কথা। বাংলাদেশ দলের মূল পেস বোলারদেরও কী যেন হয়েছে। তাসকিনকে জিম্বাবুয়ে সিরিজে ক্লান্ত মনে হয়েছে। শরীফুলেরও একই অবস্থা। দুজনই বাংলাদেশের তিন সংস্করণের পেসার। যে কারণে দুজনকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলানোর উচিত।
ওয়ানডে সিরিজের দল নির্বাচনের কিছু সিদ্ধান্তও ছিল প্রশ্ন তোলার মতো। প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে কোনো বাঁহাতি স্পিনার ছাড়াই খেলেছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ম্যাচে এসে প্রথম ম্যাচের ভুল শুধরে তাইজুল ইসলামকে সুযোগ দেওয়া হয়। অথচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বশেষ সিরিজে ৩ ম্যাচে ৫ উইকেট নেওয়া নাসুমের ইকনোমি ছিল অবিশ্বাস্য (২.৬৭)।
ক্রিকেট চাতুর্যেও জিম্বাবুয়ের কাছে হেরেছে বাংলাদেশ। হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠের একদম কোনার উইকেটে প্রথম দুটি ওয়ানডে ম্যাচ খেলিয়ে ঘরের মাঠের সুবিধার পুরো ফায়দা নিয়েছে জিম্বাবুয়ে। এক পাশে বিশাল বাউন্ডারি, আরেক পাশে ছোট—এমন অদ্ভুত আকৃতির মাঠের সুবিধা দুটি ম্যাচেই বাংলাদেশের চেয়ে ভালোভাবে নিয়েছে জিম্বাবুয়ে। ছোট সীমানার দিকে চার-ছয় মেরেছে, বড় সীমানার দিক থেকে প্রচুর এক-দুই নিয়েছে স্বগতিকেরা। বাংলাদেশ পিছিয়ে গেছে এই জায়গাতেও।