স্যাম কারেনের ভূমিকা বদলে ফেলার সময় কি চলে এসেছে ইংল্যান্ডের

অনুশীলনে স্যাম কারেন, বাংলাদেশ সফরেশামসুল হক

বছরখানেক আগেই মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে স্যাম কারেন ছিলেন সাফল্যে ভাস্বর। পাকিস্তানের বিপক্ষে ফাইনালে ম্যাচসেরা হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন টুর্নামেন্টসেরা—যেটি ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন আকৃতির মাঠের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া এবং ইনিংসের তিনটি ভিন্ন পর্যায়ে বোলিং করার স্কিলের পুরস্কার। ডাউন আন্ডারে কঠিন ও চাপের মুহূর্ত থেকে বেরিয়ে আসার সামর্থ্য, ক্রমাগত উদ্ভাবনী উপায় বের করতে থাকা ইংল্যান্ড দলের পরিচায়কই ছিলেন কারেন।

কারেন এখনো ইংল্যান্ডের সাদা বলের ক্রিকেটের পরিচায়ক, তবে এবার সে ব্যাপারটিই অস্বস্তির। বিশ্বকাপে তিনি মুখ থুবড়ে পড়েছেন। টি-টোয়েন্টিতে প্রচুর অলরাউন্ডার ব্যবহার করার দারুণ যে কৌশল, সেটির পুনরাবৃত্তি করতে ইংল্যান্ড ব্যর্থ হয়েছে। ক্যারিবীয়তে একটু স্বস্তি পেতে এসে কারেন মাঠে গড়বড় করে ফেলেছেন। (ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে) ৯.৫ ওভারে তিনি দিয়েছেন ৯৮ রান, ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের যেটি সবচেয়ে খরুচে বোলিং।

কারেন কীভাবে এ দলে খাপ খান, ইংল্যান্ডের ওয়ানডে দলের পুনর্গঠনে বাড়তি অনিশ্চয়তা হয়ে এসেছে সেটি। ২৫ বছর বয়সী ক্রিকেটের তিন বিভাগেই অবদান রাখতে পারেন, তার ওপর বাঁহাতি, আইপিএলের ইতিহাসে সবচেয়ে দামি বিদেশি ক্রিকেটার। ইংল্যান্ডের ৫০ ওভারের পরিকল্পনার কেন্দ্রেই থাকা উচিত কারেনের।

কিন্তু ইংল্যান্ড দলের মতোই তাঁর ফলও তাঁর মানের সঙ্গে একেবারেই মানানসই নয়। গত সেপ্টেম্বর থেকে ৭টি ওয়ানডেতে তাঁর ব্যাটিং গড় ১৯.৭। বোলিং গড় তো আরও উৎকণ্ঠার—৮০.৫। ওভারপ্রতি দিয়েছেন ৭.৯৫ রান। ৩০ ওয়ানডের পর তাঁর ক্যারিয়ারের মূল সংখ্যাগুলোও কার্যত দুর্ভাগ্যজনক—ব্যাটিংয়ে গড় ২২.৮, বোলিংয়ে ৪২.৩, ওভারপ্রতি খরচ করেছেন ৬.২৮ রান।

কারেনের গতি কমে এসেছে, এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। তবে ইয়র্কারের ওপর বেশি নির্ভর করে ভুগছেন তিনি, যেগুলো প্রায়ই ফুল টস হয়ে যাচ্ছে।
রয়টার্স

১৯ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক অভিষেকের পর থেকেই কারেনকে নিয়ে মূল আকর্ষণের ব্যাপার ছিল তিনি কী, সেটি নয়; বরং তিনি কী হতে পারেন। অন্য অনেক রোমাঞ্চকর তরুণ খেলোয়াড়ের মতোই তিনি বিভিন্ন ভূমিকায় খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। তবে এরপরও ইংল্যান্ডের সাদা বলের দলে তিনি এখন একজন সিনিয়র ক্রিকেটার। গত রোববার অ্যান্টিগায় ইংল্যান্ডের অন্য তিন শীর্ষস্থানীয় বোলারের মোট ম্যাচের চেয়ে বেশি খেলেছেন তিনি, পুরো দলে একমাত্র অধিনায়ক জস বাটলারই তাঁর চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা ইংলিশ ক্রিকেটার ছিলেন।

কিন্তু এখনো ইংল্যান্ড কারেনের সেরা ভূমিকাটা খুঁজে ফিরছে। তিনজনের পেস বোলিং আক্রমণে রাখা এবং পুরো ১০ ওভার তাঁকে দিয়ে বোলিং করানোর ঝুঁকিটা টের পাওয়া গেছে অ্যান্টিগায়। নতুন বলে তাঁর সুইং প্রতিপক্ষের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু সে ম্যাচে উইকেটশূন্য প্রথম স্পেলে ৪ ওভারে ৩০ রান দেওয়ার মাধ্যমে বোলিং ওপেন করতে এসে তিনি আরেকবার ভুগেছেন। এরপর শেই হোপের কবলে পড়ে শেষ ১৭ বলে তিনি দিয়েছেন ৫৩ রান। ফলে ডেথ ওভারে বোলিং করতে গিয়ে আরেকবার হিমশিম খেতে হয়েছে তাঁকে।

অবশ্য কারেনের গতি কমে এসেছে, এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। তবে ইয়র্কারের ওপর বেশি নির্ভর করে ভুগছেন তিনি, যেগুলো প্রায়ই ফুল টস হয়ে যাচ্ছে। টি-টোয়েন্টিতে মাঝের ওভারে তাঁর কাটারগুলো কার্যকর হলেও ওয়ানডেতে হচ্ছে না। কারণ, ওয়ানডেতে বৃত্তের বাইরে এ সময়ে একজন কম ফিল্ডার থাকেন। টি-টোয়েন্টিতে কার্যকর হতে গেলে বৈচিত্র্য দরকার, অন্যদিকে বিশ্বকাপই আরেকবার প্রমাণ করেছে—ওয়ানডেতে দরকার লাইন ও লেংথ। কারেনের স্টক বল তেমন নির্ভরযোগ্য নয়, ফলে ব্যাটসম্যানরা তাঁর বৈচিত্র্যের জন্য তৈরি থাকছেন।

প্রথম ওয়ানডেতে ৩৮ রানের ঝোড়ো ই নিংস খেলেন কারেন
এএফপি

অবশ্য প্রথম ওয়ানডেতে কারেনের মানের ইঙ্গিতই পাওয়া গেছে। ৩৮ রানের ঝোড়ো ইনিংসে যেমন পেসার ও লেগ স্পিনারদের বিপক্ষে সোজা মারা ছক্কা ছিল, তেমনি সেটি দেখিয়েছে তাঁর টাইমিং ও শক্তি। এর কারণেই সারেতে কারেনের কোচেরা সব সময়ই বিশ্বাস করে এসেছেন, একসময় কারেনের বোলিংকে ছাপিয়ে যাবে তাঁর ব্যাটিং।

কারেনকে ওয়ানডে ক্রিকেটে আরেকটু ভালোভাবে ব্যবহার করার একটা ইঙ্গিতও আছে এতে। চারজন মূল বোলারের একজন হিসেবে বিবেচনা না করে ৭ নম্বরে ব্যাটিং করালেই হয়তো তিনি আরও উপযুক্ত হয়ে উঠবেন। ২০২২ সালে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে ৬ নম্বরে বিশেষায়িত ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলে তাঁর গড় ছিল ৭৫.৭, ফলে এটির সঙ্গে তিনি সহজেই মানিয়ে নিতে পারবেন। আইপিএলে তিনটি অর্ধশতকও করেছিলেন, ভারতের মাটিতে ওয়ানডেতে খেলেছিলেন ৯৫ রানের ইনিংস।

আরও পড়ুন

কারেনকে ওপরে পাঠানোর আরেকটি ইতিবাচক দিকও আছে। ইংল্যান্ড আরেকজন বিশেষায়িত বোলার খেলাতে পারবে তাতে করে। পঞ্চম বোলার হিসেবে পুরো ১০ ওভার বোলিং করার চাপও থাকবে না কারেনের ওপর। এমনিতেও এ পজিশনে খেলা লিয়াম লিভিংস্টোন হয় ছয়ে উঠে যাচ্ছেন, না হলে দলের বাইরেই চলে যাচ্ছেন। এরপরও ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপ লম্বাই থাকবে। ১০ ও ১১ নম্বর থেকে রেহান আহমেদ (প্রথম শ্রেণিতে গড় ৩২) ও গাস অ্যাটকিনসনকে (২৮) সহজেই ওপরে পাঠানো যায়।
হয়তো কঠিন একটা বিশ্বকাপের পর কারেনের বিরতিই দরকার। তবে কারেনকে যদি এ দলের কেন্দ্রবিন্দুতেই রাখতে হয়, তাহলে তাঁকে নতুন একটি ভূমিকা দিতে হবে—এমন ধারণা আরও পোক্ত হচ্ছে। সেটি পরের ওয়ানডেতে হোক, বা যখনই তিনি ফেরেন না কেন।

কারেনকে বিশেষায়িত পেসার হিসেবে খেলানোর ঝুঁকিটা যদি অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি স্পষ্ট হয়ে না–ও ওঠে, তাঁর এমন অলরাউন্ড মেধা আছে, যা সচরাচর মেলে না। ব্যাটিং অর্ডারে উন্নতি, ৭ নম্বরে অলরাউন্ডার হিসেবে নতুন ভূমিকা হয়তো সেটিই দেখানোর একটা সুযোগ করে দেবে তাঁকে।