কথা ছিল ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাবেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। কয়েকটা দিন সেখানে পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে ঢাকায় ফিরবেন ২২ বা ২৩ নভেম্বর। তারপর দল নিয়ে নামবেন ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ড সিরিজের প্রস্তুতিতে। ২৮ নভেম্বর সিলেটে শুরু হবে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড প্রথম টেস্ট।
পরে হঠাৎ করেই হাথুরুসিংহের মনে হলো, টেস্ট সিরিজের আগে ১৮ নভেম্বর শুরু জাতীয় লিগের শেষ পর্বটা তাঁর দেখা দরকার। বিশ্বকাপের মধ্যেই তিনি বলেছেন, তাঁর আসল কাজ শুরু হবে বিশ্বকাপের পর। বিশ্বকাপ এখন শেষ। কাজেই হাথুরুসিংহে তাঁর আসল কাজটা শুরু করতে যাচ্ছেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুই টেস্টের হোম সিরিজ দিয়ে। এমন উপলক্ষের সঙ্গে যত আগে থেকে সম্পৃক্ত হওয়া যায়, ততই তো ভালো!
কিন্তু হাথুরুসিংহে চাইলেও বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থাকতে পারবেন কি না, বা থাকলেও ভারত বিশ্বকাপে দলে যে রকম সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ছিলেন, সেভাবেই থাকবেন কি না; সে প্রশ্ন বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) অন্দরমহলেই।
বিসিবির অধিকাংশ পরিচালক মনে করেন, ক্রিকেটারদের সামর্থ্য অনুযায়ী খেলতে না পারার পাশাপাশি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব প্রধান কোচ হাথুরুসিংহেরও কম নয়। দলের ভেতর থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্যই তাঁদের মধ্যে এমন ধারণার জন্ম দিচ্ছে। দলে তৃতীয় ওপেনার না রাখা এবং বিশ্বকাপের মধ্যে বারবার ব্যাটিং অর্ডারে বদল আনার সিদ্ধান্ত কোচ এককভাবে নিয়েছেন বলে মনে করে বোর্ড। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দলের অন্য কোচদের কাজে হস্তক্ষেপ এবং তরুণ ক্রিকেটারদের সঙ্গে রূঢ় আচরণের অভিযোগও।
বিশ্বকাপের দল থেকে তামিম ইকবালকে বাদ দেওয়ার পর থেকেই তৃতীয় ওপেনার নিয়ে সংকটের শুরু। তামিমের বিকল্প হিসেবে নেওয়া হয়নি আর কোনো ওপেনার। একটি সূত্র অবশ্য জানিয়েছে, হাথুরুসিংহের দিক থেকে পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলা হয়েছে, বিকল্প হতে পারেন এমন কোনো ভালো টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের নাম তাঁকে বলেনইনি নির্বাচকেরা। যাঁদের নাম বলা হয়েছে, তাঁদের ঠিক যোগ্য বিকল্প মনে হয়নি তাঁর কাছে। তবে জাকির হাসান বা মাহমুদুল হাসানও যে বিকল্প হতে পারতেন, সেটি নাকি জানানো হয়নি হাথুরুসিংহেকে।
বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং অর্ডারে বারবার রদবদল এই বিশ্বকাপেরই আলোচিত ঘটনা। স্বীকৃত ব্যাটসম্যানদের মধ্যে লিটন দাস ও তানজিদ হাসান ছাড়া সবাইকেই খেলতে হয়েছে একাধিক পজিশনে। বিসিবি সূত্র জানিয়েছে, ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা কোচের একক সিদ্ধান্তে হয়েছে। দলের অন্য খেলোয়াড়েরাও ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অসন্তুষ্ট ছিলেন।
কোচিং স্টাফ সদস্যদের সঙ্গেও হাথুরুসিংহের দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল দলের ভেতর। টিম হোটেল থেকে শুরু করে সেই দূরত্ব ছিল মাঠেও। উদাহরণ দিতে গিয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের আগের দিন ইডেন গার্ডেনের অনুশীলনের কথা বলেছেন একজন। সেদিন অনুশীলনের সময় দলের অন্য কোচরা নাকি ইচ্ছা করেই খেলোয়াড়দের নিয়ে মাঠের একপাশে সরে যান, নেটে একা ছিলেন হাথুরুসিংহে। দল সূত্রে জানা গেছে, এটি অন্য কোচদের পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত ছিল যে মাঠে তাঁরা সেদিন প্রধান কোচের কাছে থাকবেন না। তাঁদের চোখে বিশ্বকাপে হাথুরুসিংহের আচরণ ছিল ‘স্বেচ্ছাচারী’।
দলের সঙ্গে কোচদের মধ্যে কাল শুধু হাথুরুসিংহে ঢাকায় ফিরলেও নিউজিল্যান্ড সিরিজের আগেই চলে আসার কথা সহকারী কোচ নিক পোথাস ও ট্রেনার নিক লির। পুরোনো কোচদের মধ্যে হাথুরুসিংহেসহ বিশ্বকাপের পর এখন পর্যন্ত এই তিনজনই বহাল আছেন বিসিবির চাকরিতে। পরামর্শক শ্রীধরন শ্রীরামকে নেওয়া হয়েছিল শুধু বিশ্বকাপের জন্যই। পেস বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ড, স্পিন কোচ রঙ্গনা হেরাথ, ফিল্ডিং কোচ শেন ম্যাকডরমট ও কম্পিউটার বিশ্লেষক শ্রীনিবাস চন্দ্রশেখরনের চুক্তি এই বিশ্বকাপেই শেষ। হেরাথ, ডোনাল্ড ও শ্রীধরন নতুন করে চুক্তি নবায়নে আগ্রহ দেখাননি। আর ম্যাকডরমটের চুক্তি বিসিবিই বাড়াচ্ছে না।
কোচিং স্টাফের কোনো কোনো সদস্য বিসিবিকে জানিয়েছেন, বিশ্বকাপে সহকর্মীদের কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেছেন হাথুরুসিংহে। অন্যদের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন না, কাজ করতে দিতেন না স্বাধীনভাবে, এমনকি খেলোয়াড়দের সঙ্গে তাঁদের ঠিকভাবে কথাও বলতে দিতেন না।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচের আগের দিন দলের অন্য কোচদের সঙ্গে কথোপকথনে হাথুরুসিংহে নাকি বলেছেন, এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের ব্যর্থতার দায় তাঁর নয়। প্রধান কোচের এমন মন্তব্য ভালোভাবে নেননি অন্য কোচরা। তাঁদের একজনের মন্তব্য, ‘সে (হাথুরুসিংহে) অনেক আগেই দল ও কোচিং স্টাফের আস্থা হারিয়েছে। এই কথা বলে সে আগুনে ঘি ঢেলেছে। অন্যদের প্রতি তার কোনো শ্রদ্ধা নেই।’
দলের ভেতর থেকে আসা এসব অভিযোগের ব্যাপারে হাথুরুসিংহের ব্যাখ্যা জানতে চাইবে বিসিবি এবং সেই ব্যাখ্যার ওপরই নির্ভর করবে বাংলাদেশ দলের কোচ হিসেবে তাঁর ভবিষ্যৎ। তবে কোচ সংকটের এই সময়ে কাউকে হুট করে বিদায় করার সিদ্ধান্ত বুমেরাং হতে পারে বলে মনে করেন বোর্ডের কেউ কেউ। সে ক্ষেত্রে হাথুরুসিংহে থেকে গেলেও তাঁর ক্ষমতার বলয় কমিয়ে আনা হবে অনেকটাই।
এর আগে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কোচ থাকার সময়ও হাথুরুসিংহের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তারপরও কোচ হিসেবে একজন ‘কড়া হেডমাস্টার’ পাওয়ার আশায় গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে আবার বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব দিয়ে ফিরিয়ে আনে বিসিবি। অবশ্য গত এশিয়া কাপের সময় হাথুরুসিংহেই জানিয়েছিলেন, আগেরবার বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব ছাড়ার পর বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। দ্বিতীয় দফায় হাথুরুসিংহেকে কোচ হিসেবে আনা এবং তাঁকে অগাধ কর্তৃত্ব দেওয়াও একপ্রকার বিসিবি সভাপতির ইচ্ছায়ই।
এখন সেই বিসিবিই বিশ্বকাপে ব্যর্থতার মূল দায় দিচ্ছে হাথুরুসিংহেকে। বিসিবির কোনো পরিচালকই অবশ্য বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছেন না। বাংলাদেশ দলের সঙ্গে হাথুরুসিংহের ভবিষ্যতের দিকে তাই কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়েই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে।
তবে একটা জায়গায় যে বিশ্বকাপ-ব্যর্থতার ধাক্কা জোরালোভাবেই লাগতে যাচ্ছে, তা মোটামুটি নিশ্চিত। আগামী ডিসেম্বরে চলতি মেয়াদ শেষ হতে চলা মিনহাজুল আবেদীনের নির্বাচক কমিটিতে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত বিসিবি মোটামুটি নিয়েই ফেলেছে। যদিও নতুন নির্বাচক কমিটি করার মতো উপযুক্ত লোক এখন পর্যন্ত তারাই খুঁজে পাচ্ছে না।