নতুন বাংলাদেশে ক্রিকেটের নতুন সূর্যোদয়
হাতকড়া পরিয়ে ও দড়ি বেঁধে ঢাকার সিএমএম আদালতে ২৭ জুলাই হাজির করা হয়েছিল হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজকে। সেদিন আদালতে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয় ১৬ বছর ১০ মাস বয়সী কিশোরের। গণমাধ্যমে ফাইয়াজের ছবি ও ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পর দেশজুড়ে শুরু হয় তোলপাড়। ফাইয়াজের বিহ্বল ও ভয়ার্ত মুখচ্ছবি চলমান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেও দিয়েছিল নতুন মাত্রা। পরে তুমুল প্রতিবাদের মুখে অন্যায়ভাবে দেওয়া রিমান্ড আদেশ বাতিল করে তাঁকে টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
সে সময় ফাইয়াজের ভাইরাল হওয়া ছবি ও ভিডিওটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আরও একটি কারণে। এ ঘটনা যখন ঘটেছিল, তখন তাঁর পরনে ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ফুলহাতা একটি জার্সি। যেটির পেছনে লেখা ছিল তাঁর নামের প্রথম অংশ ‘হাসনাত’ এবং জার্সি নম্বর ছিল ৩৬। ক্রিকেট বরাবরই বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। ক্রিকেটপ্রেমী এক কিশোরের এমন বেদনাহত মুখ সেদিন কোটি মানুষের বুকে বিঁধেছিল।
ফাইয়াজের সেই ঘটনার আগে-পরে ঘটে গেছে আরও অনেক কিছু। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে নতুন এক যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশ। পুরোনোকে ঝেড়ে ফেলা তারুণ্যদীপ্ত এই বাংলাদেশে অবশ্য কয়েক দিন ধরে খুব একটা আলোচনায় ছিল না ক্রিকেট। থাকার অবশ্য কথাও নয়। নতুন করে গঠিত হতে যাওয়া একটি দেশের নানামুখী চ্যালেঞ্জ তো আছেই, এর সঙ্গে যোগ হয়েছেন স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা।
এসবের মধ্যে ক্রিকেট দল কখন পাকিস্তান সফরে গেল, তাঁর খোঁজ হয়তো অনেকেই রাখেননি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাফল্যের পর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণসহ নানা ধরনের সেবামূলক কাজে দেখা গেছে তরুণদের। আর এখন ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে বন্যাদুর্গত জনপদের সেবায়। ত্রাণ ও অনুদান সংগ্রহ করে সেসব বন্যাকবলিত মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তরুণ ছাত্র-জনতা।
এমন পরিস্থিতিতে নিতান্তই ক্রিকেট-পোকা ছাড়া অন্য কেউ রাওয়ালপিন্ডিতে চলমান টেস্টের খবর রেখেছেন কি না, বলা মুশকিল। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘেঁটেও শনিবার বিকেলের আগ পর্যন্ত ম্যাচ নিয়ে তেমন কোনো পোস্টই দেখা যায়নি। এ সময়ে ক্রিকেট নিয়ে যেসব পোস্ট, সেসবও ছিল রাজনৈতিক। যেমন নতুন উপদেষ্টা হিসেবে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার আগমন, বিসিবির সভাপতির পদ থেকে নাজমুল হোসেনের পদত্যাগ কিংবা নতুন সভাপতি হিসেবে ফারুক আহমেদের নিয়োগ নিয়েই ছিল সব আলোচনা।
এই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে মূলত শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে। মুশফিকের ডাবল সেঞ্চুরি না পাওয়ার হতাশা ও পাকিস্তানের বিপক্ষে পেতে যাওয়া সম্ভাব্য জয় নিয়ে পোস্ট দিতে দেখা যায় দু-একজনকে। তবে এসব পোস্ট ছাপিয়ে বিশেষভাবে আলোচনায় ছিলেন সাকিব আল হাসান। যদিও সাকিবের আলোচনায় থাকা পুরোপুরিই রাজনৈতিক। তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া হত্যা মামলার পক্ষে-বিপক্ষে ছিল সেসব পোস্ট। এমন অবস্থা দেখে কেউ চাইলে বলতেই পারেন, শেষ কবে এমন উত্তাপহীন ম্যাচ খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ?
উত্তাপহীন সেই ম্যাচ ভোল পাল্টাতে শুরু করে আজ সকাল থেকে। পঞ্চম দিনে ৯৪ রানে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তান যখন একের পর এক উইকেট হারাতে থাকে, উজ্জ্বল হতে থাকে বাংলাদেশের ইতিহাস গড়ার স্বপ্ন। সাদমান-মুশফিক-সাকিব-মিরাজদের হাত ধরে সেই স্বপ্ন অবশেষে পূরণও করেছে বাংলাদেশ। এই জয় বাংলাদেশের ক্রিকেটে নিয়ে এসেছে নতুন এক সূর্যোদয়ও। নতুন বাংলাদেশ ফিরে পাওয়ার পর মতো পাকিস্তানের বিপক্ষে এ জয়টাও যেন ক্রিকেটের নবযাত্রার সূচনামুখ। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মতোই এ জয় যেন পুনরুদ্ধার করেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। ঐতিহাসিক এই জয়ের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও আজ হয়ে উঠেছে ক্রিকেটময়। একের পর অভিনন্দন বার্তায় ভরে যাচ্ছে নিউজফিড।
এই জয় আমাদের ফিরিয়ে নিচ্ছে ১৯৯৯ বিশ্বকাপেও। নর্দাম্পটনে সেদিন পাকিস্তানকে হারিয়ে নতুন এক যুগে প্রবেশ করেছিল বাংলাদেশ। আর এবার স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর বাংলাদেশ যখন সবকিছু গোড়া থেকে শুরুর অপেক্ষায়, তখনই টেস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে আসল প্রথম জয়টি। যে জয় মনে করিয়ে দিচ্ছে আজ থেকে প্রায় ২১ বছর আগের সেই মুলতান–দুঃখকেও। জিততে জিততে যে টেস্টে ১ উইকেটে হেরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। মুলতানের সেই দুঃখেরও যেন কবর রচনা হলো পিন্ডিতে।
লেখাটা শুরু হয়েছিল ফাইয়াজকে দিয়ে। শেষটাতেও মনে পড়ছে সেই ফাইয়াজকে। আমরা জানি না, হাতকড়া ও বাংলাদেশের জার্সি পরা ফাইয়াজ বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়টা দেখেছেন কি না! দেখে থাকলে নতুন বাংলাদেশ ও দেশের নতুন ক্রিকেট যাত্রা নিয়ে নিশ্চয় গর্বিত বোধ করবে এই কিশোর। গায়ে লেগে থাকা বাংলাদেশের জার্সি দিয়ে সেদিন আন্দোলনে ক্রিকেটের রং লাগিয়ে দিয়েছিলেন ফাইয়াজ। এখন ফাইয়াজের মতো কিশোরদের হাত ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের আরেকটি নতুন জয়যাত্রা শুরু হয় কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।