খটখটে উইকেটে আমাদের ‘খট খটাখট খট’
খট, খট। খট খটাখট খট! শ্রীলঙ্কার ইনিংসের প্রায় শুরু থেকেই এমন শব্দের শুরু। সাইফুল্লাহ্ বিন আনোয়ার, প্রথম আলোর ক্রীড়া বিভাগের একজন সহকর্মী। বাংলাদেশ ছাড়াও বড় দলগুলোর ম্যাচ বা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের ‘লাইভ’ করেন তিনি।
আজও অনেক আয়োজন করে প্রথম আলোর অনলাইনে এশিয়া কাপের ফাইনালের ‘লাইভ’ করতে বসেছিলেন সাইফুল্লাহ্। তিনি অফিসে ঢুকতেই এক সহকর্মী ‘বিলম্বিত রাত্রি’র জন্য শুভকামনা জানিয়ে রেখেছিলেন। পুরো ম্যাচ কাভার করে বাসায় ফিরতে রাত দুইটা বা তিনটা বাজবে বলেই ধরে নিয়েছিলেন তিনি।
রাতের পালায় কে কে থাকবেন, কীভাবে কাজ করবেন—ম্যাচ শুরুর আগে ছোট্ট একটা মিটিং হয় প্রথম আলোর ক্রীড়া বিভাগে। সেই মিটিংয়ে কত কী পরিকল্পনা সাজানো হলো! পাঠকের জন্য অনলাইনে কী খবর দেওয়া হবে ফাইনাল ঘিরে, ছাপা কাগজেই বা কী যাবে—এসব ভাবা হচ্ছিল।
এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেল শ্রীলঙ্কার ইনিংস। টসে জিতে ব্যাটিং নিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক দাসুন শানাকা। টসে ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা বললেন, উইকেট এমন খটখটে শুষ্ক যে টস জিতলে তিনিও ব্যাটিংই নিতেন।
টসের পর হালকা একটু ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়ে গেল। খেলা শুরু হলো ৪০ মিনিট পর। খেলা শুরু হতেই খটেখটে উইকেটে সাইফুল্লাহ্র খট খটাখট খট! উইকেট পড়ছে, সাইফুল্লাহ্ লিখছেন। আবার উইকেট পড়ছে, আবার ব্যস্ত হয়ে সাইফুল্লাহ্ কি–বোর্ড চাপছেন। আবার উইকেট পড়ছে, আবার সাইফুল্লাহ্ খট খটাখট খট শব্দ তুলছেন।
সাইফুল্লাহ্র মুখ শুষ্ক। সেটা হয়তো বৃষ্টির আগে কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের উইকেটের মতোই। বেচারা যে একটু পানি পান করার সময়ও পাচ্ছিলেন না! এমন সময় প্রথম আলোর অন্য এক বিভাগের এক সহকর্মী এসে সাইফুল্লাহ্কে বললেন, ‘কি ভাই, হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে?’
ঠিক তখনই আরেকটি উইকেটের পতন। ১–১, ২–৮, ৩–৮; এই অবস্থা থেকে শ্রীলঙ্কার স্কোর হয়ে গেল ৮ রানে ৪ উইকেট। এরপর ৪ রানের মধ্যে আর কোনো উইকেট পড়েনি। মনে হচ্ছিল, হয়তো ধসটা আটকাতে পেরেছে শ্রীলঙ্কা। তখনই আবার সাইফুল্লাহ্র খট খটাখট খট।
মানে আরও একটি উইকেটের পতন। এরপর আরও একটি। ১২ রানে নেই ৬ উইকেট। এবার শুভ্রদা সরব! শুভ্রদা মানে প্রথম আলোর প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র। ব্যস্তসমস্ত হয়ে দাদা বললেন, ‘সবাই রেকর্ড ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করো!’
সকালের পালায় যাঁরা কাজে এসেছিলেন, তাঁরা ভাবলেন, এ কী ল্যাঠা হলো! রাতের চাপটা এখন আমাদের নিতে হচ্ছে! রেকর্ড–টেকর্ড ঘেঁটে আনোয়ার হোসেন, শাওন শেখ ও সাহিদ রহমান কিছু বের করে আনলেন। সঙ্গে সঙ্গেই রচিত হলো দুটি তরতাজা খবর! একটা সিরাজের ১ ওভারে ৪ উইকেট নিয়ে ভাসের বাংলাদেশের বিপক্ষে পাওয়া ৪ উইকেট মিলিয়ে, আরেকটি শ্রীলঙ্কার ১২ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে কানাডার পাশে বসা নিয়ে।
সেই খবর অনলাইনের পাঠকদের জন্য পরিবেশন করতে না করতেই আনোয়ার হোসেনকে বললাম, ‘ইনিংস রিপোর্টটা লিখতে শুরু করো, এই বুঝি শ্রীলঙ্কা গেল!’ বলতে দেরি, ঘটনা ঘটতে দেরি নেই। সিরাজের পর হার্দিক পান্ডিয়া আরেকটা ধ্বংসযজ্ঞ চালালেন। ফুৎকারে শেষ হয়ে গেল শ্রীলঙ্কার ইনিংস! ২১ রানে সিরাজ নিয়েছেন ৬ উইকেট, পান্ডিয়া ৩ রানে ৩টি। ১৫.২ ওভারে শ্রীলঙ্কা অলআউট ৫০ রানে।
আনোয়ার ইনিংস রিপোর্ট শুরু করতে না করতেই যখন শ্রীলঙ্কার দফারফা হয়ে গেল, সিনিয়র সহকর্মী কামরুল হাসান খবর দিলেন, এমন একটি ইনিংস, এটা কলম্বো থেকেই উড়ে আসুক। ইনিংস রিপোর্ট পাঠালেন কলম্বোতে টুর্নামেন্ট কাভার করতে যাওয়া তারেক মাহমুদ।
যাক, সাইফুল্লাহ্র খট খটাখট খট তো আপাতত বন্ধ হয়েছে, এটা ভাবতে ভাবতেই তাঁকে বললাম, ‘এটাই কি তোমার জীবনের সংক্ষিপ্ততম লাইভ?’ সাইফুল্লাহ্, মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ।’ সেই সময় সাহিদ রহমান পরিসংখ্যান ঘেঁটে বের করলেন, এটাই ওয়ানডে ইতিহাসের ফাইনালে কোনো দলের সর্বনিম্ন স্কোর। ‘বেশ, পরিসংখ্যানটা যখন দিলেই, পাঠকের জন্য একটা খবর পরিবেশন করে ফেলো!’
সাহিদ রহমান বসে পড়লেন সেই খবর দিতে। শুরু করে দিলেন খট খটাখট খট। এর মধ্যেই আবার শুরু হয়ে গেল সাইফুল্লাহ্র খট খটাখট খট। ভারতের ইনিংস যে শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। তারেক মাহমুদ কলম্বো থেকে জানালেন, ম্যাচ রিপোর্টটা ডেস্ক থেকে করে দিতে হবে। তিনি ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে যাবেন। আনোয়ার হোসেন তাই শুরু করে দিলেন—খট খটাখট খট।
এদিকে আমিও লিখছি—খট খটাখট খট। লিখছেন কামরুল হাসান, লিখছেন মোহাম্মদ সোলায়মান আর মোহাম্মদ জুবাইর। চারদিকে খট খটাখট খট। সে সময় কানে আসছিল রোহিতের কথাগুলো, খটখটে উইকেট! মনে হচ্ছে খটখটে উইকেটে আমরা সবাই মিলে লিখে চলেছি—খট খটাখট খট!
ইশ্, মহা বিলম্বিত রাত (লেট নাইট) নিয়ে যে পরিকল্পনা ছিল, সব ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন সিরাজ–পান্ডিয়ারা। এ সময়ই আবার মনে হলো, তাও ভালো, গভীর রাতের চাপটা সন্ধ্যাবেলায়ই শেষ! এ যেন গভীর রাতে কলাবতী রাগ শুনতে আসা শ্রোতাদের সন্ধ্যারাতে বেহাগ শুনিয়ে চলে গেলেন কোনো শাস্ত্রীয় সংগীতকার।
এতে দ্রুত ঘরে ফেরা হলো ঠিক, কিন্তু মনের মধ্যে একটা হাহাকার রয়েই গেল—ইশ্, ফাইনালের রোমাঞ্চটা যে উপভোগ করা গেল না!