সকালে দক্ষিণ আফ্রিকার এক বোলার একটা মাইলফলক ছুঁলেন। বিকেলে বাংলাদেশের এক বোলার। দুটিই দারুণ দর্শনীয়ভাবে।
কোনো ফাস্ট বোলারের কাছে যদি তাঁর স্বপ্নের দৃশ্যের কথা জানতে চান, একটা উত্তরই পাবেন। ডিগবাজি খেয়ে স্টাম্পের বাতাসে উড়তে দেখা। সকালে সেটাই উড়ল। তা–ও আবার একটি নয়, দু–দুটি। ৯৩ টেস্টের ক্যারিয়ারে এর আগে ৩৫ বার বোল্ড হয়েছেন মুশফিকুর রহিম। এমন অসহায়ভাবে কখনো হয়েছেন কি না, সন্দেহ!
বাইরে যাবে ভেবে বল ছেড়ে দিয়ে ব্যাটসম্যান বোল্ড হচ্ছেন, এই দৃশ্যও একজন বোলারের জন্য কম আনন্দের নয়। বিকেলে বাংলাদেশের বাঁহাতি স্পিনারের মাইলফলক ছোঁয়ার আনন্দে যা আরেকটু রং লাগাল। ম্যাথু ব্রিটজকে যে এর আগে টেস্টে কখনো এভাবে বোল্ড হননি, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। টেস্টে ব্যাট করতে নামলেনই তো এই প্রথমবারের মতো।
বেহুলা–লখিন্দরের গল্পের মতো কোনো ফুটো দিয়ে যেন ‘কালসাপ’ ঢুকে পড়তে না পারে, তা নিশ্চিত করতে টিকিট বা অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড ছাড়া কেউ স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তাতেই পা রাখতে পারলেন না।
দক্ষিণ আফ্রিকান ফাস্ট বোলার কাগিসো রাবাদার ওয়ানডে অভিষেক এই মিরপুরেই। হ্যাটট্রিকসহ ৬ উইকেট নিয়ে যেটিকে স্মরণীয় করে রেখেছিলেন। সেই মাঠেই টেস্টের ৩০০তম উইকেট, যাতে একটা রেকর্ডও করে ফেললেন। যে রেকর্ডের কথা তাঁর জানাই ছিল না। রাবাদার চেয়ে কম টেস্ট খেলে ৩০০ উইকেট নিয়েছেন নয়জন বোলার। তবে তাঁর চেয়ে কম বল করে কেউই নন।
বাংলাদেশের বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলামের ২০০তম উইকেটেও একটা রেকর্ড আছে। তবে তা দেশীয়। সবচেয়ে কম টেস্ট খেলে বাংলাদেশের কোনো বোলারের ২০০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড। তার আগে অবশ্য ২০০ উইকেট নিয়েছেনই বাংলাদেশের একজন বোলার। তিনিও বাঁহাতি স্পিনার এবং এই টেস্টটা তাঁরই বিদায়ের রঙেই রঙিন হওয়ার কথা ছিল। নামটা বোধ হয় না বললেও চলে।
দেশে আসার অনুমতি না পেয়ে দুবাই থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়া সাকিব আল হাসান অবশ্য না থেকেও থাকলেন মিরপুরে। তাইজুলের সংবাদ সম্মেলনে ঘুরেফিরে এল তাঁর নাম। মিরপুর টেস্টের প্রথম দিনের আবহও বারবার যাঁর কথা মনে করিয়ে দিল। নানা সময়ে নানা পরিস্থিতিতে বাড়তি নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা পড়েছে মিরপুর স্টেডিয়াম। তবে এবারের মতো সম্ভবত কখনোই নয়। পুলিশ আর সেনাবাহিনীর সতর্ক পাহারায় আজ মিরপুর স্টেডিয়াম যেন লখিন্দরের বাসরঘর। বেহুলা–লখিন্দরের গল্পের মতো কোনো ফুটো দিয়ে যেন ‘কালসাপ’ ঢুকে পড়তে না পারে, তা নিশ্চিত করতে টিকিট বা অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড ছাড়া কেউ স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তাতেই পা রাখতে পারলেন না। দুই দল স্টেডিয়াম ছেড়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত সুনসান রাস্তা ভুতুড়ে একটা অনুভূতি জাগিয়ে গেল। বাড়তি সাবধানতার কারণ তো অনুমেয়ই। আগের দিনই সাকিবের পক্ষ–বিপক্ষ দুই দলের মধ্যে মারামারি হয়েছে। টিকিট ছাড়া কিছু শিক্ষার্থীর গ্যালারিতে ঢোকার দাবি জানানো ছাড়া এদিন অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি।
স্টেডিয়ামের ভেতরে ‘অপ্রীতিকর’ যা কিছু হয়েছে, তার ভুক্তভোগী শুধুই ব্যাটসম্যানরা। টসজয়ী বাংলাদেশকে ১০৬ রানেই অলআউট করে দেওয়ার পর ৬ উইকেট পড়েছে দক্ষিণ আফ্রিকারও। আলোর স্বল্পতায় ৬ ওভার খেলা কম হয়েছে, তারপরও এক দিনেই ১৬ উইকেট! বোলারদের মৃগয়া তো বটেই, তবে মিরপুরের প্রথাগত টার্নিং উইকেট বলার উপায় নেই। প্রথম দিনেই তাইজুলের ৫ উইকেট তেমনই ভাবতে বলবে। দক্ষিণ আফ্রিকার দুই পেসার রাবাদা ও মুল্ডারের তিন–তিন ৬ উইকেট আবার বলবে অন্য কথা। দুই ধরনের বোলারের প্রতিই উইকেটের এমন স্নেহধন্য আচরণ দেখে কাগিসো রাবাদা রীতিমতো অবাক। স্পিনিং উইকেট ভেবে বল করতে শুরু করে দেখলেন, তেমন সুইং না পেলেও বল উইকেটে পড়ার পর ভালোই এদিক–ওদিক করছে। বাংলাদেশের বোলিং লাইনআপে একমাত্র পেসার হাসান মাহমুদের বোলিংয়ের সময়ও দেখা মিলেছে যে সিম মুভমেন্টের।
সাম্প্রতিক সময়ে পেসাররা নতুন রূপে দেখা দেওয়ার পরও বাংলাদেশের মাত্র এক পেসার নিয়ে খেলতে নামা অবশ্যই অবাক হওয়ার মতো। প্রশ্নজাগানিয়াও বটে। সাকিব আল হাসান আসছেন এখানেও। সাকিবকে ছাড়া আগেও এর আগে খুব কম টেস্ট খেলেনি বাংলাদেশ। সেই সময় যে সমস্যায় পড়েছে, এবারও তা–ই। সাকিব মানে তো টু–ইন–ওয়ান—বাড়তি একজন ব্যাটসম্যান, বাড়তি একজন বোলার। বাংলাদেশ দল সেটির সমাধান খুঁজল কিনা আট নম্বরে আরেকজন ব্যাটসম্যান নিয়ে! তাঁর আবার টেস্ট অভিষেক। তা অভিষেকে কী করলেন জাকের আলী? কেশব মহারাজের বলে স্টাম্পড হওয়ার আগে ২ রান।
তরুণ দোকানি মাথা নাড়তে নাড়তে বলছেন, ‘বাংলাদেশ নাকি ১০৬ রানে অলআউট! এর চেয়ে দুঃখের কিছু হয় নাকি!’ একটু বয়সী পাশের দোকানি তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন, ‘আরে, বাংলাদেশ ১০৬ করেছে তো কী, ইন্ডিয়া তো সেদিন ৪৬ করেছে।’
বাকিদের অবস্থাও অবশ্য তথৈবচ। চার টেস্ট পর দলে ফেরা ওপেনার মাহমুদুল হাসানই যা একটু ব্যতিক্রম। ৩০ রানের বেশি করতে পারেননি, তবে টিকে থাকার প্রতিজ্ঞাটা অন্তত বিচ্ছুরিত হয়েছে তাঁর ২ ঘণ্টা ৮ মিনিট উইকেট আঁকড়ে থাকায়। খেলেছেন ৯৭ বল, বাকি ১০ ব্যাটসম্যান মিলে যেখানে ১৪৯! বোলিং–বীরত্বের আগে তাইজুল ব্যাটিংয়েও খারাপ করেননি। হোক না মাত্র ১৬ রান, কিন্তু সেটিই তো বাংলাদেশের ইনিংসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
দিনের খেলা শেষে মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে আসার সময় ৪ নম্বর গেটের সামনের ফুটপাতে দুই কাপড়ের দোকানির কথোপকথন কানে এল। তরুণ দোকানি মাথা নাড়তে নাড়তে বলছেন, ‘বাংলাদেশ নাকি ১০৬ রানে অলআউট! এর চেয়ে দুঃখের কিছু হয় নাকি!’ একটু বয়সী পাশের দোকানি তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন, ‘আরে, বাংলাদেশ ১০৬ করেছে তো কী, ইন্ডিয়া তো সেদিন ৪৬ করেছে।’
কথা সত্যি। তবে ৪৬–এর পর দ্বিতীয় ইনিংসে ভারত প্রবল বিক্রমে ফিরেও এসেছে। এই টেস্ট জিততে বাংলাদেশকেও এমন কিছু করতে হবে। এর আগে অবশ্য আরেকটি ‘ছোট্ট’ কাজ আছে। এরই মধ্যে ৩৪ রানে এগিয়ে যাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকাকে যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে দেওয়া।
তা হবে কি হবে না, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনই কীভাবে দেবেন! তবে যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, তা হলো বৃষ্টি বাগড়া না দিলে এই টেস্ট স্বল্পায়ু হতে বাধ্য।