সাকিব আল হাসান বলতে গেলে সারাটা দিনই কাটালেন হোটেলের লবিতে। ম্যারাথন আড্ডা মেরে। কলকাতায় দুই ম্যাচ দেখতে ঢাকা থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বেশ কয়েকজন পরিচালক এসেছেন। মূলত তাঁদের সঙ্গেই। টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ, বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার রাবীদ ইমামও থাকলেন কখনো কখনো। আড্ডার টেবিল বদলাল, কখনোবা উপস্থিতিও। সারা দুপুর এমন চলার পর বিকেলের দিকে সাকিবের আড্ডা একটু আন্তর্জাতিক রূপ নিল। আড্ডার সঙ্গী তখন কলকাতার পূর্বপরিচিত কয়েকজন।
আড্ডায় মুখ কালো করে সাকিব চুপচাপ বসে ছিলেন ভেবে থাকলে ভুল করবেন। আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে তাঁর। সাকিবকে দেখে বোঝারই উপায় নেই, আগের রাতে কী ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটে গেছে। নেদারল্যান্ডসের কাছে হেরে যাওয়াটা বাংলাদেশের জন্য ভয়ংকর ঘটনা নয় তো কী! বোর্ড পরিচালকদের কথায় ঘুরেফিরেই এই ম্যাচের প্রসঙ্গ আসছিল। কীভাবে বাংলাদেশের সব ব্যাটসম্যান একই সঙ্গে ফর্ম হারিয়ে ফেললেন, তা নিয়ে বিস্ময়ও!
বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান তখন ওপরে খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলছেন। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচের আগের দিন মিনিট দশেকের জন্য পুরো দলের সঙ্গে বসেছিলেন। এদিন চার–পাঁচজনের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে কথা বলেছেন। অধিনায়ক সাকিব আল হাসান, লিটন দাস, মেহেদী হাসান মিরাজ, মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহর কাছে জানতে চেয়েছেন, সমস্যাটা কী। শেষ দুজনের সঙ্গে অবশ্য কথা বলেছেন একসঙ্গেই। ব্যাটিংটাই বাংলাদেশকে বেশি ভোগাচ্ছে বলেই ব্যাটসম্যানদের সঙ্গেই সবার আগে কথা বলা।
তা কী বললেন তাঁরা? মূলত একটা সমস্যার কথাই। কেউ রান করতে পারছেন না। এটা তো সবাই দেখছেনই। এর কারণটা বললে না লাভ হতো। কিন্তু সেটি তাঁরা জানলে না বলবেন। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ২২৯ রান তাড়া করতে নেমে অমন মুখ থুবড়ে পড়ার ব্যাখ্যা তাঁদের কাছেও নেই। লবিতে সাকিবের সঙ্গে কথা বলতে চাওয়ায় তিনি দুষ্টুমির হাসি দিয়ে বলেছেন, 'আমার বলার কিছু নাই।'
তবে বোর্ড সভাপতিকে অনেক কিছুই বলেছেন। 'অনেক কিছু', তবে ঘুরেফিরে যাতে এসেছে ওই ব্যাটিং ব্যর্থতাই। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে উইকেট ছিল অনেকটা মিরপুরের মতো। এই উইকেটে এভাবে সবাই ব্যর্থ হওয়ায় সাকিব আরও বেশি অবাক হয়েছেন। এর আগের ম্যাচগুলোয় সব উইকেটই ছিল ব্যাটিংয়ের জন্য দারুণ। তারপরও ব্যাটসম্যানরা কেন পারছে না, এই প্রশ্নের উত্তর অধিনায়কের কাছেও নেই।
তিনি নিজেও তো পারছেন না। বোর্ড সভাপতির কাছে সেই অসহায়ত্বও প্রকাশ করেছেন, 'এতগুলো ম্যাচে টানা রান না করার ঘটনা আমার জীবনেই কখনো হয়নি। বুঝতে পারছি না, কেন এমন হচ্ছে।' অধিনায়ক সাকিবের কর্মপদ্ধতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নিজে পারফর্ম করে অন্যদের পথ দেখানো। এখানে সেটাই হচ্ছে না বলে পড়েছেন একজন অধিনায়কের জন্য কঠিনতম সমস্যায়। বোর্ড সভাপতিকে তা বলেছেনও, 'আমি নিজেই তো কিছু করতে পারছি না। অন্যদের তাহলে কী বলব?'
কোচিং স্টাফের সঙ্গেও বসেছিলেন নাজমুল হাসান। নাজমুলের সঙ্গে কথা বলেই লবিতে নেমে এলেন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। আগের রাতে নেদারল্যান্ডসের কাছে হেরে যাওয়ায় রীতিমতো বিপর্যস্ত। কথায়ও সেটির প্রকাশ, 'খুবই হতাশাজনক। এটা মেনে নেওয়া কঠিন। হোটেলে ফিরে ঘুমাতেই পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত রাত সাড়ে তিনটার দিকে একটু ঘুমিয়েছি।'
এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের এমন হতশ্রী দশার কারণ চিহ্নিত করতে হাথুরুসিংহেও ব্যর্থ। প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানকে হারানোর পর টানা পাঁচ ম্যাচে পরাজয়। আগের চারটির একেকটার হয়তো একেক ব্যাখ্যা। তবে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে 'চাপ'-টাই কি কাল হলো? এই ম্যাচ জিততেই হবে, না জিতলেই সর্বনাশ! সত্যি সত্যি 'সর্বনাশ' হয়ে যাওয়ার পর কী মনে হচ্ছে, যত না নেদারল্যান্ডসের কাছে, তার চেয়ে বেশি এই চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে বাংলাদেশ?
হাথুরুসিংহে সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দিচ্ছেন না, 'হতে পারে। এটাও হয়ে থাকতে পারে।' আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসব চাপ-টাপ তো থাকবেই। সময়ভেদে সেটি শুধু রূপ বদলায়, এই যা! টানা সপ্তম বিশ্বকাপ খেলতে আসা একটা দল তাতে এভাবে ভেঙে পড়বে, এটা কি মেনে নেওয়া যায়? হাথুরুসিংহে আর কী বলবেন! তিনি তাই উচিত-অনুচিতের লাইনে চলে গেলেন, 'এমন হওয়া উচিত নয়।'
উচিত নয়, এমন অনেক কিছুই তো হচ্ছে এই বিশ্বকাপে। বাংলাদেশ দলের কথা বললে বিশ্বকাপেরও আগে থেকে। নাজমুল হাসান স্বভাববিরুদ্ধভাবে অনেক দিন চুপচাপ আছেন। তামিম ইকবালের সরে যাওয়া, সাকিবের ওই বিধ্বংসী সাক্ষাৎকার—এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও তাঁর সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে চলাটাকে একটা রেকর্ডই বলতে হবে।
অবশেষে সেই নীরবতা ভেঙে আবার তিনি সাংবাদিকদের সামনে। সাকিব-হাথুরুদের সঙ্গে বসার পর টিম হোটেলের বাইরে জমায়েত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললেন নাজমুল। প্রথাগত কোনো সংবাদ সম্মেলন নয়। কোনো প্রশ্নোত্তর পর্বই তো ছিল না। কেন টিম হোটেলে এসেছিলেন, ক্রিকেটারদের সঙ্গে কী কথা হয়েছে, বাকি তিন ম্যাচে দলের কাছে কী প্রত্যাশা ইত্যাদি বিষয়ে প্রায় ১১ মিনিট নিজেই শুধু কথা বললেন।
তা শেষ করে যখন আবার হোটেল লবিতে ঢুকলেন, সাকিবের আড্ডা তখনো চলছে।