ম্যাক্সওয়েল ২০১*: এটাই কি ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা ইনিংস
অবিশ্বাস্য, অভূতপূর্ব, অভাবনীয়, অকল্পনীয়, অতুলনীয়, অতিমানবীয়—গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অপরাজিত ২০১ রানের ইনিংসটিকে আর কোন বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়?
ওয়ানডে ইতিহাসে দ্বিশতক ছোঁয়া ইনিংস এর আগেও ১০ বার দেখেছে ক্রিকেট–বিশ্ব। এক রোহিত শর্মাই করেছেন তিনবার। তবে রোহিতসহ বাকিরা দ্বিশতক করেছিলেন আগে ব্যাটিংয়ে নেমে। ব্যতিক্রম শুধু ম্যাক্সওয়েল। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে আরব সাগরতীরের বাতাস যখন অস্ট্রেলিয়ার প্রতিকূলে বইছিল, তখনই ক্রিকেটের ‘বিগ শো’র ২২ গজে আগমন। ৮.২ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে ৪৯ রান; আফগানিস্তানের দুই পেসার নাভিন উল হক ও আজমতউল্লাহ ওমরজাইয়ের দাপুটে বোলিংয়ে অস্ট্রেলিয়া তখন রীতিমতো ধুঁকছে।
এরপর মারনাস লাবুশেনের রানআউট আর রশিদ খানের ছোবলে যখন ৪ উইকেটে ৪৯ রান থেকে ৭ উইকেটে ৯১ রান হয়ে গেল, তখন কেউ যদি বলতেন, ‘তবু অস্ট্রেলিয়া ২৯২ রান তাড়া করে জিতবে’, তাহলে সেটা বিশ্বাস করার লোক খুব বেশি পাওয়া যাওয়ার কথা নয়! কিন্তু বিষম চাপের মধ্যেই এক পায়ে ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে সবাইকে ভুল প্রমাণিত করে ছাড়লেন ম্যাক্সওয়েল। নেপথ্যের নায়ক হয়ে তাঁকে সঙ্গ দিয়ে গেলেন অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। আর কোনো উইকেট না হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছে গেল কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে, উঠে গেল বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে। যে রান তাড়া করে অস্ট্রেলিয়া জিতল, সেটাতে ‘আধা ফিট’ ম্যাক্সওয়েলের একারই অবদান ৬৮.৬০%!
জীবদ্দশায় ম্যাক্সওয়েলের এই ইনিংসকে অনেকেই ওয়ানডেতে সর্বকালের সেরা বলছেন। যাঁর হাত ধরে ক্রিকেট–বিশ্ব ওয়ানডেতে প্রথম দ্বিশতক দেখেছিল, সেই শচীন টেন্ডুলকারের চোখেও এটা তাঁর জীবনের দেখা সেরা ইনিংস। ম্যাক্সওয়েলের বীরত্বগাথার পর খোদ আইসিসি, বিবিসি ও ডেইলি মেইল ওয়ানডে ইতিহাসের বেশ কিছু মহাকাব্যিক ইনিংস বিশ্লেষণ করে সেরা কয়েকটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। বাছাই করা সেই ইনিংসগুলো নিয়েই এই আয়োজন—
বেন স্টোকস, ইংল্যান্ড:
২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল, প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড
৯৮ বলে ৮৪* রান
চার বছর আগে লর্ডসের সেই ‘বেয়ারেস্ট অব অল মার্জিনস’–এর ফাইনালে ৯৮ বলে অপরাজিত ৮৪ রান করেছিলেন। সেই ইনিংসের সুবাদেই ম্যাচ গড়ায় সুপার ওভারে। পরে বেশি বাউন্ডারি মারার নিরিখে প্রথমবার ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতে নেয় ইংল্যান্ড। ক্রিকেটের সর্ববৃহৎ মঞ্চে নিউজিল্যান্ডের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলা ইনিংসটিকে সর্বকালের অন্যতম সেরা বিবেচনা করা হয়।
গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, অস্ট্রেলিয়া:
২০২৩ বিশ্বকাপ প্রথম পর্ব, প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডস
৪৪ বলে ১০৬ রান
মাত্র দুই সপ্তাহ আগে খেলা গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের এই ইনিংসও শীর্ষ ১০–এ জায়গা করে নিয়েছে। এই ইনিংসের আগের সর্বশেষ ১০ ইনিংসে তাঁর কোনো ফিফটি ছিল না। এ নিয়ে বেশ সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল যেন ব্যাটেই সবকিছুর জবাব দিতে চেয়েছিলেন। ইনিংসটি খেলার পথে নেদারল্যান্ডস বোলারদের ‘কচুকাটা’ করে তুলে নেন শতক, যা বিশ্বকাপ ইতিহাসের দ্রুততম।
হার্শেল গিবস, দক্ষিণ আফ্রিকা:
২০০৬ দ্বিপক্ষীয় সিরিজ, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া
১১১ বলে ১৭৫ রান
কোনো দল ওয়ানডেতে ৪০০ রান করে ফেলবে, এমন ভাবনা তখনকার দিনে খুব বেশি কারও মাথায় আসত বলে মনে হয় না। তবে জোহানেসবার্গে সেদিন ইতিহাস গড়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ৫০ ওভারে করেছিল ৪৩৪ রান। এভারেস্টসম সেই লক্ষ্য টপকে ওই দিন অনন্য কীর্তি গড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা; যে কীর্তিগাথার মহানায়ক হার্শেল গিবস। ১১১ বলে ১৭৫ রানের অতিমানবীয় ইনিংস উপহার দেন দক্ষিণ আফ্রিকার এই ব্যাটসম্যান। তাঁর ইনিংসের সুবাদে ম্যাচের সঙ্গে সিরিজও জিতে নেয় প্রোটিয়ারা। ৯ উইকেট হারিয়ে তোলা ৪৩৮ রান ক্রিকেটের ইতিহাসে এখনো সফল রানতাড়ায় সর্বোচ্চ।
এবি ডি ভিলিয়ার্স, দক্ষিণ আফ্রিকা:
২০১৫ দ্বিপক্ষীয় সিরিজ, প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ
৪৪ বলে ১৪৯ রান
আধুনিক যুগের ব্যাটিংয়ের সংজ্ঞা বদলে দেওয়া এবি ডি ভিলিয়ার্স এই ইনিংস দিয়ে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলারদের ওপর মহাপ্রলয় বইয়ে দিয়ে ৩১ বলে পূরণ করেন শতক, যা ওয়ানডে ইতিহাসে দ্রুততম। কীভাবে এমন ইনিংস খেললেন, গল্পটা নিজেই বলেছেন ‘মিস্টার ৩৬০ ডিগ্রি’। ‘সুযোগটা যেন আমাকেই খুঁজছিল। ড্রেসিংরুমে আমি খুব তেতে ছিলাম। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, এভাবেই খেলব। সম্ভবত আগ্রাসী থাকার ব্যাপারটা মূল কারণ ছিল। আমি প্রথম বল থেকেই মেরে খেলতে চেয়েছিলাম’—বলেছেন ডি ভিলিয়ার্স।
কপিল দেব, ভারত:
১৯৮৩ বিশ্বকাপ গ্রুপ পর্ব, প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে
১৩৮ বলে ১৭৫* রান
বিশ্বকাপে টিকে থাকতে হলে জিততেই হবে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এমন ম্যাচে ১৭ রান তুলতেই ৫ উইকেট নেই ভারতের! সেখান থেকে অধিনায়ক কপিল দেব দলকে নিয়ে যান ২৬৬ রানে। এর মধ্যে কপিলের একার রান ১৭৫! গতকাল ম্যাক্সওয়েলের ইনিংসটির আগে ওয়ানডেতে এটাই ছিল ছয়ে বা এরপর নামা কোনো ব্যাটসম্যানের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ। তখনকার দিনে এতটা আধুনিক ব্যাট ছিল না, বাউন্ডারি এখনকার মতো এতটা ছোট ছিল না। এসব বিবেচনায় সেদিনের ১৭৫ নিশ্চয়ই বর্তমানের ২৩৫-এর সমান! ৩৮ বছর আগের সেই দিনে বিশ্বকাপের আরও তিনটি ম্যাচ ছিল। আর সে সময় সব ম্যাচ সম্প্রচার করা হতো না।
টিভিতে না দেখানো সেই ম্যাচগুলোর একটি ছিল এটি। এমনকি কপিলের মহাকাব্যিক সেই ইনিংসের কোনো ভিডিও ফুটেজও পাওয়া যায়নি। তবু ম্যাক্সওয়েলের কালকের ইনিংসটি দেখার আগে তাঁর ইনিংসকেই বেশির ভাগ ক্রিকেট–বোদ্ধা ওয়ানডের সর্বকালের সেরা ইনিংস মনে করে এসেছেন। কপিলকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তাঁর ইনিংসটির ভিডিও না থাকায় কোনো আক্ষেপ আছে কি না। জবাবে কপিল বলেছিলেন, ‘কিছু ঘটনা দেখার চেয়ে শোনাই ভালো।’ তিনি এ–ও বলেছিলেন, ওই ইনিংসের পরেই আত্মবিশ্বাস জন্মায় যে ভারতীয় দল যেকোনো পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে যেকোনো দলকে হারিয়ে দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত কপিলের নেতৃত্বাধীন ভারতই ’৮৩-এর বিশ্বকাপ জিতে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, অস্ট্রেলিয়া:
২০২৩ বিশ্বকাপ প্রথম পর্ব, প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান
১২৮ বলে ২০১* রান
এই ইনিংসের গল্প তো শুরুতেই বলা হয়েছে। আলোচনা হতে পারে শুধু শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পাওয়া নিয়ে। সেখানে ম্যাক্সওয়েলের সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়া নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন। বলতে পারেন—প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান পরাশক্তিদের মতো নয়, মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের বাউন্ডারি খুবই ছোট, ম্যাক্সওয়েল একাধিকবার ‘জীবন’ পেয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ার জন্য ম্যাচটি বাঁচা–মরার ছিল না বা কাল হেরে গেলেও সেমিফাইনালে ওঠার সম্ভাবনা থাকত। কিন্তু মনের মধ্যে যখন ‘আধা ফিট’ ম্যাক্সওয়েলের হার না মানা মানসিকতাকে কল্পনা করবেন, কিংবা ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে মাঠে লুটিয়ে পড়ার পর আবারও উঠে দাঁড়িয়ে দেশের জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মুহূর্তগুলো মনে করবেন, তখন ম্যাক্সওয়েলকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে না রেখে কোনো উপায় আছে!
ভিভ রিচার্ডস, ওয়েস্ট ইন্ডিজ:
১৯৮৪ দ্বিপক্ষীয় সিরিজ, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড
১৭০ বলে ১৮৯* রান
১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এটাই ছিল ওয়ানডেতে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ। ওল্ড ট্রাফোর্ডে এক দিকে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ভিভ রিচার্ডস, অন্যদিকে টপাটপ উইকেট পড়ে যাচ্ছে। সতীর্থদের আসা-যাওয়ার এই মিছিল শেষ পর্যন্ত থেমেছে মাইকেল হোল্ডিংয়ের সঙ্গে গড়া অসাধারণ এক জুটিতে। ১৬৬ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের যখন ৯ উইকেট পড়ে যায়, তখন রিচার্ডস ৯৬ রানে অপরাজিত। সেখান থেকে হোল্ডিংকে সঙ্গে নিয়ে অবিচ্ছিন্ন শেষ উইকেট জুটিতে তোলেন আরও ১০৬ রান। ক্যারিবীয়দের ইনিংস পৌঁছে যায় ৯ উইকেটে ২৭২ রানে। ভিভ ১৮৯ রানে অপরাজিত। লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ভিভের রানটাও করতে পারেনি ইংল্যান্ড। অলআউট হয় ১৬৮ রানে।
অরবিন্দ ডি সিলভা, শ্রীলঙ্কা:
১৯৯৬ বিশ্বকাপ ফাইনাল, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া
১২৪ বলে ১০৭* রান
১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কার বিশ্বজয়ের গল্পটা রূপকথার মতো। যে রূপকথার মহানায়ক অরবিন্দ ডি সিলভা। লাহোরের ফাইনালে ২৪২ রান তাড়া করতে নেমে গ্লেন ম্যাকগ্রা-শেন ওয়ার্নদের অস্ট্রেলিয়ার বোলিং আক্রমণের সামনে ২৩ রানে ২ উইকেট হারায় শ্রীলঙ্কা। আসাঙ্কা গুরুসিংহের সঙ্গে ১২৫ রানের জুটি গড়ে বিপর্যয় সামাল দেন ডি সিলভা। গুরুসিংহে ব্যক্তিগত ৬৫ রানে আউট হলেও অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গাকে নিয়ে ম্যাচটা শেষ করেই মাঠ ছাড়েন তিনি। অপরাজিত থাকেন ১০৭ রানে। ফাইনালে তো ম্যাচসেরা হয়েছেনই, তার আগে সেমিফাইনালের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটাও ডি সিলভার হাতে উঠেছিল। বিশ্বকাপের এক আসরের সেমিফাইনাল ও ফাইনালে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হওয়া দ্বিতীয় খেলোয়াড় তিনি (প্রথমজন ভারতের মহিন্দর অমরনাথ)।