বাংলাদেশ দলকেও কটাক্ষ করেছেন ভারতীয় অধিনায়ক
মেয়েদের খেলায় পুরস্কার বিতরণের মঞ্চে খুব একটা ভিড় থাকে না সাধারণত। দুই দলের ক্রিকেটার আর দু-একজন অতিথি, যাঁদের কাজ পুরস্কার তুলে দেওয়া। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের পুরস্কার বিতরণের মঞ্চের সঙ্গে এর খুব একটা অমিল নেই।
তবে আজ মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-ভারত নারী দলের ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচের পর পুরস্কার বিতরণের মঞ্চটা সে রকম ছিল না। ম্যাচটা টাই হয়েছে, তাতে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজও শেষ হয়েছে ১-১ সমতায়। এসব হলো পুরস্কার বিতরণের মঞ্চে ভিড় বাড়ার ক্রিকেটীয় কারণ। অক্রিকেটীয় কিছু কারণও আছে। যে কারণে মিরপুর স্টেডিয়ামের আজকের বিকেলটা উপস্থিত সবার মনে কাঁটার মতো বিঁধে থাকবে।
ক্রিকেটের দারুণ এক রোমাঞ্চকর দিনটাকে নিজের অক্রিকেটীয় আচরণ দিয়ে অস্বস্তিকর করে তুলেছেন আসলে ভারতীয় অধিনায়ক হারমানপ্রীত কৌর। আউট হয়ে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে অসন্তোষ জানিয়েছেন ব্যাট দিয়ে স্টাম্প ভেঙে। আম্পায়ারদের আগুনে দৃষ্টিতে ভস্ম করে দিতে চেয়েছেন, পরে মাঠ ছাড়ার সময় দর্শকদের দিকেও আঙুল তুলে কিছু একটা বলেছেন।
এসব কারণেই হয়তো খেলা শেষ হওয়ার পর থেকেই ক্যামেরার চোখ ছিল ভারতীয় অধিনায়ক হারমানপ্রীতের দিকে। পুরস্কার বিতরণী মঞ্চের ডানে দাঁড়িয়েও রাগে অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করতে দেখা যাচ্ছিল তাঁকে। গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডভর্তি দর্শকদেরও যেন তাঁর সহ্য হচ্ছিল না। তিনি যে মেজাজ হারিয়েছেন, তা বোঝাই যাচ্ছিল।
এমন অবস্থায় সঞ্চালকের সঙ্গে হারমানপ্রীতের প্রশ্ন-উত্তর পর্বটা কেমন হয়, সেদিকে ছিল সবার আগ্রহ। একজন বিসিবি কর্মকর্তা ফিসফিস করছিলেন, ‘বেফাঁস কিছু বলে ফেলবে না তো? ক্যাপ্টেন তো খুব রেগে আছে।’ বিসিবি কর্মকর্তার সে শঙ্কাই সত্যি হলো। বাংলাদেশের বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচের আম্পায়ারিং নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিলেন তিনি। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে খেলতে এলে ‘প্যাথেটিক আম্পায়ারিং’–এর মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই আসবেন, বলেছেন এমন কথাও।
কথাগুলো শুনছিলেন পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে দাঁড়ানো বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান জালাল ইউনুস। বিসিবির নারী বিভাগের প্রধান শফিউল আলম চৌধুরীর চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি নিজের কানকেই বিশ্বাস করছেন না! বাংলাদেশ নারী দলের ক্রিকেটাররা এতক্ষণ নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করছিলেন। হারমানপ্রীতের কথা শুনে তাঁরা স্তব্ধ হয়ে যান। মঞ্চের আশপাশে থাকা লোকজনের সবার চোখমুখেই বিস্ময়। কোনো অধিনায়ক এভাবে কথা বলতে পারেন, এটাই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না কারও।
এক বিসিবি কর্মকর্তা তো সঙ্গে সঙ্গে বলে বসলেন, ‘এটা তো লেভেল-৪ অফেন্স। এভাবে কখনো কাউকে কোনো পর্যায়ের ক্রিকেটে মন্তব্য করতে দেখিনি। ক্রিকেট ম্যাচ তো পরে। এটা তো একটা দেশকে অপমান করা হলো।’ বাংলাদেশ নারী দলের কোচিং স্টাফের এক সদস্য তো বললেনই, ‘আমি আমার ক্রিকেটীয় অভিজ্ঞতায় এমন ঘটনা কখনো দেখিনি। এসব কি আসলেই হয়ে গেল? বিশ্বাস হচ্ছে না। ভারতের এই দলটা আসলেই ব্যাড লুজার। হারতে জানাও কিন্তু ক্রিকেটের একটা শিক্ষা। সেটা মনে হয় ওরা শেখেনি।’
হারমানপ্রীতের কথাগুলোর রেশ কাটতে না কাটতেই ঘটল আরেক দৃষ্টিকটু ঘটনা। সিরিজ সমতায় শেষ হওয়ার পর দুই দলের একই সঙ্গে ট্রফি নিয়ে ছবি তোলার রীতিটা নতুন নয়। আজ হারমানপ্রীত ও নিগার সুলতানার হাতে ট্রফি তুলে দেওয়ার পর দুই দলকে একসঙ্গে ছবি তোলার অনুরোধ করা হয়। দুই দল কয়েক মুহূর্তের জন্য এক হয়ে ছবি তোলার পর্ব শেষ করতেই হারমানপ্রীতকে নিগারের দিকে হাত নেড়ে কিছু কথা বলতে শোনা যায়। উপস্থিত যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিগারকে নাকি হারমানপ্রীত আম্পায়ারদের সঙ্গে ছবি তুলতে বলেছেন। কারণ, এই ট্রফি নাকি বাংলাদেশ দলকে আম্পায়াররা জিতিয়েছেন।
হারমানপ্রীতের এই কটাক্ষের পর নিগার নিজ দলের সঙ্গে ট্রফি নিয়ে আর কোনো ছবি তোলেননি। সোজা পুরো দল নিয়ে ড্রেসিংরুমে ঢুকে যান। পরে সংবাদ সম্মেলনেও এ নিয়ে নিগারকে প্রশ্ন করা হয়। প্রথমে এ নিয়ে কোনো মন্তব্যই করতে চাননি বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক। পরে শুধু বলেছেন, ‘ও (হারমানপ্রীত) যেটা করেছে, সেটা ওরই। সেটা আমাদের কোনো কিছু নয়। তবে আমি বলব, ক্রিকেটার হিসেবে সে আরেকটু ভালোভাবে কথা বলতে পারত। তবে ও করেছে, ওর ব্যাপার। আমার কোনো মন্তব্য করা উচিত হবে না।’
হারমানপ্রীত তাঁকে কী এমন বলেছেন যে তাঁর দল নিয়ে ড্রেসিংরুমে চলে যেতে হলো? নিগার এ নিয়েও খুব বেশি কিছু বলতে চাননি, ‘কিছু কথা…সব সময় তো সবকিছু বলা যায় না। যা হয়েছে, আমার কাছে মনে হয়নি যে আমার দল নিয়ে ওখানে থাকব। তো আমি চলে এসেছি। কিছু কথা ছিল যে আমার মনে হয়নি ওখানে থাকা উচিত হবে দল নিয়ে। কারণ, ক্রিকেট খুবই সম্মানজনক একটি জায়গা। শৃঙ্খলার জায়গা। জেন্টলমেনস গেম। আমার কাছে মনে হয়েছে, ওই পরিবেশ ছিল না। তাই দল নিয়ে চলে এসেছি।’
ভারতীয় দলের প্রতিনিধি হিসেবে সংবাদ সম্মেলনে আসা সহ-অধিনায়ক স্মৃতি মান্ধানাকেও এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। ফটোসেশনের সময় দুই অধিনায়কের কী কথা হয়েছিল, এ প্রশ্নে তাঁর উত্তর ছিল এমন, ‘আমার মনে হয় না হারমান বাংলাদেশ দলের অধিনায়ককে কিছু বলেছে। সে হয়তো আম্পায়ারদের নিয়ে কিছু বলেছে।’ পুরস্কার বিতরণের সময় হারমানপ্রীতের ক্ষোভ প্রকাশের বিষয়টিও মান্ধানা এড়িয়ে গেছেন, ‘পোস্ট ম্যাচে কী হয়েছে, তা নিশ্চয়ই রেকর্ড করা হয়নি। ক্যামেরায় যা নেই, তা নিয়ে আমি কথা বলতে পারব না।’
তবে আম্পায়ারিং নিয়ে মান্ধানাও প্রশ্ন তুলেছেন। আম্পায়রিং নিয়ে প্রশ্ন করা হলে উত্তরে সাংবাদিককেই প্রশ্ন ছুড়ে দেন মান্ধানা, ‘আপনি কী মনে করেন আম্পায়ারিং নিয়ে?’ পরে উত্তরে বলেছেন, ‘যখন ডিআরএস থাকবে না, তখন কিছু সিদ্ধান্ত থাকবেই, যাতে আপনি খুশি হবেন না। আমরা আরেকটু ভালো মানের আম্পায়ারিং প্রত্যাশা করেছিলাম। আমরা যখন ব্যাটিং করছিলাম, প্যাডে লাগার পর দ্বিতীয়বার চিন্তা না করেই আম্পায়ার আঙুল তুলেছে। তবে এসব খেলারই অংশ।’ নিরপেক্ষ আম্পায়ারের প্রসঙ্গও তুলেছেন মান্ধানা, ‘আমার মনে হয় বিসিবি, বিসিসিআই ও আইসিসি এ নিয়ে আরও আলোচনা করবে। আমরা হয়তো নিরপেক্ষ আম্পায়ার প্রত্যাশা করতে পারি পরেরবার থেকে। যেমনটা ছেলেদের ক্রিকেটে দেখা যায়।’
বিসিবিও নাকি এ নিয়ে আইসিসি ও বিসিসিআইয়ের সঙ্গে কথা বলবে। ভারতীয়দের আচরণের সূত্র ধরে শফিউল আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের এ কথাই জানালেন, ‘যেভাবে বলেছে কথাগুলো, সেটা নিয়ে আমাদের বোর্ড টু বোর্ড কথা হবে। আমাদের সিইও আইসিসির সঙ্গেও কথা বলবেন। নিশ্চয়ই ম্যাচ রেফারিও তাঁর রিপোর্টে নিয়ে আসবেন বিষয়গুলো, তখন আমরা দেখব।’