‘কে এই হাসান’কে থামিয়ে অশ্বিন-জাদেজা ঝড়
ভারত ১ম ইনিংস: ৮০ ওভারে ৩৩৯/৬
মাঠে বাংলাদেশ দল ইদানীং যা করছে সেটাই বিশেষ কিছু হয়ে যাচ্ছে। এই যেমন আজ চেন্নাই টেস্টে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন টসে জিতে ভারতকে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়ে ৪২ বছর আগের স্মৃতি ফেরালেন। এম এ চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে এর আগে সর্বশেষ কোনো দল টস জিতে আগে ফিল্ডিং নিয়েছে ১৯৮২ সালে, ভারতের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক কিথ ফ্লেচার। মূল কথা, চিপকে টস জয় মানেই আগে ব্যাটিং করে চতুর্থ ইনিংসে প্রতিপক্ষকে স্পিন জালে আটকানোর চেষ্টা।
কিন্তু বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল করলেন উল্টোটা। প্রেসবক্সে ভারতীয় সাংবাদিকেরা শুরুতে তাঁর ফিল্ডিং নেওয়ার সিদ্ধান্তটাকে অযৌক্তিকই মনে করছিলেন। একজন তো ব্যঙ্গ করে দিন শেষের স্কোরটাই বলে দিতে চাইলেন, ‘নাজমুল টসে জিতল আর ভারত দিন শেষে ২ উইকেটে ৩৫০ রান করল।’
তবে চেন্নাই টেস্টের প্রথম দিনটা ভারতের জন্য এত সহজ যায়নি। গরমের জন্য চেন্নাইয়ের দুর্নাম আছে, অথচ আজ এই শহরেই সূর্যের দেখা মিলল বিকেল ৪টায়! চেন্নাইয়ের মেঘলা আকাশের নিচে লাল মাটির উইকেটে ২২ গজে আগুন ঝরাল বাংলাদেশ দলের পেস আক্রমণ। ৩৪ রানে ৩ উইকেট তুলে নেওয়া পর ১৪৪ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে বসে ভারত। যার মধ্যে হাসান মাহমুদের একারই শিকার ৪ উইকেট। কিন্তু এরপর বল পুরোনো হলে রবিচন্দ্রন অশ্বিন আর রবীন্দ্র জাদেজার সৌজন্যে ঘুরে দাঁড়ায় ভারত। দুজনের ওয়ানডে মেজাজের ব্যাটিংয়ে ২২৭ বলে আসে ১৯৫ রান। আর তাতে ভারত দিন শেষে ৮০ ওভারে ৬ উইকেট হারিয়ে করেছে ৩৩৯।
রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানকে কাঁপিয়ে আসা হাসান আজ পরীক্ষা নিলেন রোহিত-কোহলিদেরও। চিপকের উইকেটের জন্য আদর্শ লেংথ থেকে দুই দিকের সুইং ও সিম মুভমেন্টে ব্যাটসম্যানদের মনে দ্বিধার সৃষ্টি করেছেন, ভুল শট খেলায় প্রলুব্ধ করেছেন।
ষষ্ঠ ওভারে ভারতের অধিনায়ক রোহিত সে ফাঁদে পা দিয়েই কট বিহাইন্ড। শুভমান গিল তো কট বিহাইন্ড হলেন লেগ স্টাম্পের বাইরের বল খেলতে গিয়ে। আর বিরাট কোহলি? অফ স্টাম্পের বাইরের বলে আলগা ড্রাইভ করার সেই পুরোনো অভ্যাসেই কাটা পড়লেন। প্রথম স্পেলে ৭ ওভার বোলিং করে মাত্র ১৪ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেন হাসান। যার মধ্যে দুজন যদি হন রোহিত আর কোহলি, এটাকে স্বপ্নের মতো শুরু বললে কারও নিশ্চয়ই আপত্তি থাকার কথা নয়।
৩৪ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ঘোর বিপদেই পড়েছিল স্বাগতিকেরা। ক্রিজে তখন ওপেনার যশস্বী জয়সওয়াল ও ঋষভ পন্ত। দুজনই বাঁহাতি এবং আক্রমণাত্মক। তাসকিন আহমেদ ও নাহিদ রানার আলগা বলগুলো বাউন্ডারিতে পাঠাচ্ছিলেন স্বাচ্ছন্দ্যে। দুজন মিলে ৯৯ বলে ৬২ রান যোগ করে ফেলায় দুশ্চিন্তাও বাড়ছিল বাংলাদেশের। দ্বিতীয় স্পেলে এসে পন্তকে ফিরিয়ে সে দুশ্চিন্তা দূর করেন হাসান।
প্রত্যাবর্তন টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৩৯ রানে থামে পন্তের ইনিংস। জয়সওয়াল অবশ্য ফিফটি করে এগোচ্ছিলেন আরও একটি বড় ইনিংসের দিকে। পাঁচে নামা কেএল রাহুলের সঙ্গে জুটি গড়ে ৪৮ রান যোগ করেন তিনি।
অধিনায়ক নাজমুলের জুটি ভাঙার অন্যতম হাতিয়ার নাহিদও হতাশ করেননি। দ্বিতীয় স্পেলে বোলিংয়ে এসে জয়সওয়ালকে বাড়তি বাউন্স ও গতিতে ঘাবড়ে দিয়ে স্লিপে সাদমান ইসলামের তালুবন্দি করেন নাহিদ। ১১৮ বলে জয়সওয়াল করেছেন ৫৬ রান।
কে এই হাসান? কে তাঁর কোচ? কীভাবে টেস্ট ক্রিকেটে এল এই তরুণ? কীভাবে বাংলাদেশ পেল এমন পেস বোলিং আক্রমণ?
পরের উইকেটটির জন্যও বাংলাদেশকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। ঠিক পরের ওভারেই (৪৩তম) রাহুলকে (১৬) শর্ট লেগে থাকা জাকির হাসানের তালুবন্দি করেন মেহেদী হাসান মিরাজ।
ভারতের রান তখন ৬ উইকেটে ১৪৪। এদিকে প্রেসবক্সে ভারতের সাংবাদিকদের তুমুল কৌতূহল- কে এই হাসান? কে তাঁর কোচ? কীভাবে টেস্ট ক্রিকেটে এল এই তরুণ? কীভাবে বাংলাদেশ পেল এমন পেস বোলিং আক্রমণ?
সিরিজ কাভার করতে চেন্নাইয়ে আসা বাংলাদেশের সাংবাদিকদের এসব প্রশ্নের উত্তরই দিতে হচ্ছিল। তখনো কেউ খেয়ালই করেননি, ইনিংসের ৫০টি ওভার চলে গেলেও বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ বোলার সাকিব আল হাসান তখন পর্যন্ত বল করেননি একটি ওভারও। অশ্বিন-জাদেজার জুটি জমতে শুরু করার পরই অনেকে খেয়াল করলেন বিষয়টি।
শেষ পর্যন্ত সাকিব বোলিংয়ে আসেন ৫৩তম ওভারে। ততক্ষণে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন চেন্নাইয়ের ঘরের ছেলে অশ্বিন। আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংসে খেলেন বলে চেন্নাইয়ের ঘরের ছেলে বলা যায় জাদেজাকেও। দুজন মিলে ১৯৫ রানের ম্যারাথন জুটি গড়ে টেস্টের প্রথম দিনের গল্পটাই দিলেন পাল্টে। সকালে ওরকম একটা শুরুর পরও এখন আর বলার উপায় নেই-দিনটা ছিল বাংলাদেশের।
নরম হয়ে আসা এসজি বলের সুবিধা নিয়ে দিনের শেষটা নিজেদের করে নেয় ভারত। অশ্বিন ১০৭ বলে করলেন টেস্ট ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ সেঞ্চুরি। দিন শেষে তিনি অপরাজিত ১১২ বলে ১০২ রানে, জাদেজা খেলছেন ১১৭ বলে ৮৬ রানে। ১৮ ওভারে ৫৮ রানে ৪ উইকেট নেওয়া হাসানই ছিলেন দিনের সেরা বোলার।