তিন, দুই, এক এবং ইতিহাস
সিলেট স্টেডিয়ামটা শহর থেকে একটু দূরে। আশপাশে চা–বাগান থাকায় শহর থেকে স্টেডিয়াম এলাকায় ঠান্ডা একটু বেশি। ঠিকমতো রোদ না ওঠা পর্যন্ত ঠান্ডা ঠান্ডা ভাবটা থাকেই। আজ সকালেও বাংলাদেশ দলকে খুঁজে পাওয়া গেল এমন আবহে। ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে মাঠে আসা অনেকেরই আড়ষ্টতা তখনো কাটেনি। খেলতে নামার আগে সবারই গা গরম করতে হতো। বোলাররা তা করলেন কিছুক্ষণ বোলিং করে। বাকিরা নিজেদের মধ্যে ভাগ হয়ে ফুটবল নিয়ে শুরু করলেন অদ্ভুত এক খেলা।
খেলার মাঝেই হইচই, চিৎকার চেঁচামেচিতে কিছুক্ষণ আগের আড়ষ্টতা কাটিয়ে চাঙা হয়ে ওঠেন প্রত্যেকে। কিন্তু দেখে মনে হবে না, এই দলটিই দাঁড়িয়ে ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে। আর ৩টি উইকেট, মাত্র ৩টি উইকেটই নাজমুলদের এনে দেবে নিউজিল্যান্ডের সোনালি প্রজন্মের বিপক্ষে আরেকটি স্মরণীয় টেস্ট জয়। উল্টো মনে হচ্ছে, আসন্ন জয়ের আমেজে বাংলাদেশ দল তো আগেই ঢুকে পড়েছে!
আজকের দিনটা শুধু আনুষ্ঠানিকতা, ৩ উইকেট শিকারের আনুষ্ঠানিকতা। যা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তা–ই। বাংলাদেশের ৩৩২ রানের পেছনে ছুটতে থাকা নিউজিল্যান্ডকে আজ সকালে অলআউট করতে সময় লেগেছে মাত্র দেড় ঘণ্টা (১ ঘণ্টা ২৬ মিনিট)। বাংলাদেশের ১৫০ রানের জয়টা ধরা দেয় দিনের প্রথম সেশনেই। আর বাংলাদেশ দলের মতো জয়ের সুবাস পেয়ে সকাল সকালই মাঠে হাজির অনেকেই।
বাংলাদেশ দলকে আজ মাঠে নামতে দেখেই ক্লাব হাউস থেকে এক দর্শক চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘জিতব জিতব।’ আরেক গ্যালারি থেকে শোনা যায় চেনা স্লোগান, ‘সাবাস বাংলাদেশ, সাবাস!’ মাঠে আসা এক দর্শক আরেকজনকে সিলেটি ভাষায় ম্যাচের হিসাবটা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, ‘নিউজিল্যান্ডের ২১৯ রান লাগে। ওদের জেতার কোনো উপায় নেই।’
তখন বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের জটলা থেকে সবার আগে বেরিয়ে বাউন্ডারির সীমানায় ঢুকলেন উইকেটকিপার নুরুল হাসান। তাঁকে দেখে আরেক দর্শক হাত নেড়ে ইশারায় বললেন, ‘এ ভাই, তাড়াতাড়ি খেলা শেষ করেন। অনেক দিন বাসায় যাই না।’ কথাটা নুরুলই বলছিলেন ২০২১ সালের অস্ট্রেলিয়া সিরিজে। স্টাম্প মাইকে ধরা পড়া নুরুলের এ কথাটা সেই দর্শক আজ আবার মনে করিয়ে দিলেন, ‘৫ ওভার, ৫ ওভারের মধ্যে শেষ হবে।’
ওই দর্শকের প্রত্যাশা অবশ্য পূরণ হয়নি। খেলা দিনের প্রথম ওভারে শেষ হয়নি। তবে নিউজিল্যান্ডের উইকেট পতনের কাউন্ট ডাউন থামেনি। দুজন দর্শক জোড়া গলায় চিৎকার করছিলেন, ‘নাম্বার এইট কামিং বয়েজ, নাম্বার এইট!’ তড়িঘড়ি ছিল মাঠের ভেতরেও। মুশফিকুর রহিম মিড অনে দাঁড়িয়ে বোলিং করতে থাকা নাঈম হাসানকে বলছিলেন, ‘কাম বয়েজ, ফিনিশ ইট।’
নাঈমের শেষ ওভারে ড্যারিল মিচেলের বিপক্ষে দুবার আবেদন হলো। কিন্তু মিচেলের ইনিংস ‘ফিনিশ’ হয়নি অল্পের জন্য। তিনি স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রতি–আক্রমণের পথ বেছে নেন। বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক নাজমুলের তাতে কোনো হেলদোল নেই। তিনি উইকেটের আশপাশে ফিল্ডারের ভিড় কমালেন না। জাকির হাসান, শাহাদাত হোসেন, মাহমুদুল হাসানরা একটি ভুলের অপেক্ষায় ওত পেতে ছিলেন। তাঁরা অপেক্ষায়, ৪ উইকেট নিয়ে এর মধ্যেই নিউজিল্যান্ডের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া তাইজুল আরও একটি জাদুকরি বল করবেন।
অপেক্ষায় ছিলেন দর্শকেরাও। একদম তাইজুলকে নতুন ওভার শুরু করতে দেখে বলছিলেন, ‘ম্যাজিক বল তাইজুল ভাই, ম্যাজিক বল।’ সকালের নিরিবিলি আবহে চেঁচিয়ে বলা কথাটা পরিষ্কার শোনা গেল। নিশ্চয়ই তা তাইজুলের কানেও পৌঁছেছে। ওভারের প্রথম বলটা করার পরই লেগের দিকে ফিল্ডিং করা মুশফিকের পরামর্শ, ‘হ্যাঁ, এটাই কর। জায়গা ছাড়বি না, একদম জায়গা ছাড়বি না।’
পরামর্শ দিচ্ছিলেন দর্শকেরাও। বোলিং শেষ করে বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করতে আসতে দেখে নাঈমকে এক দর্শক বলছিলেন, ‘নাঈম একটু ফ্লাইট দিয়ো।’ কথাটা শুনে নাঈমও হেসে দিলেন। হাত তুললেন। ওদিকে আরেক তাইজুল ভক্তের চিৎকার, ‘তাইজুল ভাই ফাইফার কামিং, অ্যাডভান্স কংগ্রাচুলেশন!’
তাইজুলের ৫ উইকেটের জন্য সেই দর্শককে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। কারণ, ৫৯ ওভারে নাঈমের বলে সুইপ করতে গিয়ে ক্যাচ তোলেন পঞ্চাশ পেরিয়ে এগোতে থাকা মিচেল (৫৮)।
সিলেট স্টেডিয়ামে তখন নতুন কাউন্ট ডাউন শুরু, ‘টু মোর টু গো, আর দুইটা লাগে ভাই আর দুইটা। জলদি করেন, বাসায় জামু (হাসি)।’ স্টেডিয়ামের নিরাপত্তাকর্মীরাও দর্শকদের কথা শুনে হাসছিলেন। কিছুক্ষণ পর নাঈমের বলেই আউট হতে হতে বেঁচে যান ইশ সোধি। রিভিউ নেওয়ায় রক্ষা। তবে পানি পান বিরতির পর তাইজুলের বলে রক্ষা পাননি টিম সাউদি। পুল শট খেলতে গিয়ে শর্ট মিড উইকেটে জাকিরের হাতে ক্যাচ তোলেন তিনি। উইকেটের মাঝে দাঁড়িয়ে আরও একটি ৫ উইকেট উদ্যাপনে উদ্বাহু হন তাইজুল। তাঁর সঙ্গে মাঠের দর্শকেরাও যে যার সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ান।
তখন থেকে শুরু ‘এক’–এর অপেক্ষা। আর মাত্র একটি উইকেট, টেস্ট ক্রিকেটের সমুদ্র পেরিয়ে কিনারায় পৌঁছাতে আর বেশি সময় বাকি নেই। ইশ সোধি আর এজাজ প্যাটেল আর কতক্ষণই! নিরাপত্তাকর্মীদের একজন তা-ই বললেন, ‘শেষ দুই ব্যাটসম্যান না? ওরা যত ভালোই হোক, দিন শেষে ওরা শেষ দুই ব্যাটসম্যানই।’
তিন ওভারের মধ্যেই তাঁর কথাটাই যেন সত্যি হলো। এবারও তাইজুল, এবারও জাকির, আর ব্যাটসম্যান সোধি। সিলি মিড অফে দাঁড়িয়ে সহজ ক্যাচ লুফে নিতেই উল্লাস শুরু জাকিরের। সঙ্গে যোগ দেন শাহাদাত, মাহমুদুলরা। একটু দূর থেকে মুখে চওড়া হাসি নিয়ে হেঁটে এলেন মুশফিক। ভিড়ের মধ্যে তাইজুলকে খুঁজে নিয়ে বুকে টেনে নিলেন। বাকিরা প্রথমে একজন আরেকজনের সঙ্গে, পরে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে করমর্দন করেই ড্রেসিংরুমের পথ ধরলেন।
সেখানে অভিনন্দন জানানোর জন্য সারিবদ্ধ হলেন অনেকেই। নির্বাচক হাবিবুল বাশারও ছিলেন সেখানে। ওই অভিনন্দনের ভেলায় চড়েই খেলোয়াড়েরা ড্রেসিংরুমে ঢুকলেন। দর্শকদের কাউন্ট ডাউন তখন থেমেছে। যে জয় দেখতে তাঁদের মাঠে আসা, তা পূরণ হয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট তো বটেই, বাংলাদেশের মানুষও যা চায় সবাই তা পায় না। আমাদের প্রত্যাশাগুলো হোঁচট খায় প্রতিনিয়ত। তবু কিছু কিছু ইতিবাচকতা কালেভদ্রে পূর্ণতার উপলব্ধি এনে দেয়। বাংলাদেশে টেস্ট ক্রিকেটও ঠিক এমনই। আজ সে রকমই এক মন ভরিয়ে দেওয়া অনুভূতির জন্ম দিল সিলেট টেস্ট।