সাকিবদের শরীরী ভাষায় ডালাসের রোদের হাসি

ডালাসের ঝলমলে রোদে সাকিব–মাহমুদউল্লাহদের ব্যাটিং অনুশীলনবিসিবি

ক্ষণগণনা শুরু হয়ে গেছে বেশ আগেই। উত্তেজনায় থরথর কাঁপছে যুক্তরাষ্ট্র। আজ অনেক বড় ম্যাচ।

বড় ম্যাচ? টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আজকের দুই ম্যাচের একটি তো সহযোগী দুই দেশের লড়াই। বার্বাডোজে স্কটল্যান্ড বনাম নামিবিয়া। অন্যটিতে এই ডালাসেই পাকিস্তানের মুখোমুখি হবে স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্র, যে ম্যাচের অন্য কোনো গভীর অর্থ খুঁজে পেলেও পেতে পারেন।

যুক্তরাষ্ট্রের অধিনায়ক মায়াঙ্ক প্যাটেল যেমন এটিকে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের ক্ষুদ্র সংস্করণ ভেবে নিয়ে তাতিয়ে তুলতে পারেন নিজেকে। জন্মভূমির বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ বলে পেসার আলী খানকে একটু আবেগ ছুঁয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র দলে ভারতীয়-পাকিস্তানিদের এমন সমারোহ যে চাইলে এমন দৃশ্যকল্প আরও সাজানো যায়। তাই বলে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বড় ম্যাচ’ নিশ্চয়ই ভুলেও বলবেন না।

ডালাসে আজ পাকিস্তানের মুখোমুখি হবে মোনাক প্যাটেল–আলী খানদের যুক্তরাষ্ট্র
আইসিসি

তাহলে আজ বড় ম্যাচ কোথায়? বড় ম্যাচ বলতে আপনি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বুঝে নিয়েছেন তো! যে ‘বড় ম্যাচ’ নিয়ে আমেরিকানদের এমন উত্তেজনা, তার সঙ্গে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কোনো সম্পর্ক নেই। অভিবাসীরা, আরও নির্দিষ্ট করে বললে দক্ষিণ এশিয়ান অভিবাসীরা ছাড়া ক্রিকেট নিয়ে এখানে কেই-বা মাথা ঘামায়?

এখানে বড় ম্যাচ মানে হয় সুপার বোল, নয়তো এনবিএ ফাইনাল। সেই এনবিএ ফাইনালই শুরু হচ্ছে আজ; যাতে আছে এই ডালাসের এক দলও। ডালাস ম্যাভেরিকস। ফাইনাল না বলে অবশ্য ফাইনালস লেখা উচিত। এনবিএ ফাইনাল তো সাত ম্যাচের সিরিজ, যার প্রথমটি হবে আজ বোস্টন সেল্টিকসের কোর্টে। বাংলাদেশে অবশ্য আগামীকাল সকাল হয়ে যাবে ততক্ষণে।

ডালাসের গ্র্যান্ড প্রেইরির হোটেল লবিতে আমেরিকানদের সঙ্গে দেখা হলেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের খবর জানেন কি না—এ প্রশ্ন এখন আর করি না। করলেই বিপদ! ক্রিকেট খেলাটা কী, বেসবলের সঙ্গে কী পার্থক্য—এসব বোঝাতে জান বেরিয়ে যায়। তা বোঝার আগেই যে কয়েকজনের সঙ্গে এই ‘ভুল’ করে রেখেছি। যাঁদের সঙ্গে দেখা হলেই এনবিএ ফাইনালস নিয়ে উত্তেজনা সঞ্চারিত করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

ডালাসে বৃষ্টি থামার আগে মাসট্যাং ক্রিকেট একাডেমির ইনডোরেই অনুশীলন করতে হয়েছে বাংলাদেশ দলকে
বিসিবি

ক্রিকেট সংস্কৃতি না থাকতে পারে, তবে ক্রিকেটীয় সুযোগ-সুবিধা কিন্তু খারাপ নয়। নিউইয়র্কের উইকেটের কথা বাদ দিন। বলছি শুধু ডালাসের কথা। স্টেডিয়াম ভালো, উইকেটও খারাপ নয়। এর বাইরেও দেখছি আরও অনেক কিছু আছে। মাসট্যাং ক্রিকেট একাডেমির ইনডোরের কথাই ধরুন। গত মঙ্গলবার বিশ্বকাপে ঢুকে যাওয়ার পর যেখানে প্রথম অনুশীলন করেছে বাংলাদেশ দল।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ভেন্যু গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামের মূল মাঠে বৃষ্টি খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। কিন্তু পাশের নেটের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা খুব একটা ভালো নয়। একটু বৃষ্টিতেই বোলারদের রানআপের জায়গাটা কাদা হয়ে যায়। বৃষ্টির কারণে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ দলকে তাই বাধ্য হয়েই ইনডোরের আশ্রয় নিতে হয়েছে।

বুধবারও বিকল্প হিসেবে ইনডোর বুক করে রাখা হয়েছিল। এদিনও ভোর থেকেই ডালাসে বৃষ্টি। তবে দুপুর নাগাদ তা থেমে গিয়ে রোদ উঠেছে। সেই রোদের এমন তেজ যে শরীর পুড়ে যায়। মাঝের কদিন বৃষ্টির কারণে সহনীয় অবস্থা থেকে ভ্যাপসা গরমও ফিরে এসেছে। এতে লাভ বলতে গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামের নেটের ব্যবহার উপযোগী হয়ে ওঠা। একটু আগে সেখানেই বাংলাদেশ দলের নেট সেশন শেষ হয়েছে। বাংলাদেশের সেশন শেষ হওয়ার পর নেমে গেছে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কাও।

আরও পড়ুন

এই ডালাসে বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া বা টর্নেডোয় উড়ে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচের আগে বাংলাদেশের পুরো দল মিলে একদিন প্র্যাকটিস হয়েছিল এই মাঠে। যেভাবে প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছিল, তাতে প্রথম ম্যাচের আগে মাঠে অনুশীলন করা নিয়েই ঘোর সংশয় দেখা দিয়েছিল। সেই সংশয় কেটে যাওয়ায় বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সবাইকে খুব হাসিখুশি দেখাল। তাসকিনের পুরো দমে বোলিং করাটা যেটির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়ে থাকবে। প্রথাগত নেট প্র্যাকটিস যেমন হয়, সেসবই হলো। তবে আগের দিন ইনডোরের অনুশীলনটা ছিল একটু ব্যতিক্রমী।

মাসট্যাং ক্রিকেট একাডেমি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে। ডালাস ক্রিকেট লিগের দলগুলো ভাড়া নেয়। কিশোর-তরুণদের কোচিং একাডেমিও। যেখানে গিয়ে বাংলাদেশের অনেক সাংবাদিকই দেশে কেন এমন ব্যবস্থা নেই—অবধারিত এই প্রশ্ন তুলে ভিডিও বানালেন। যেন বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডের কর্তাব্যক্তিরা দেশের বাইরে ঘুরতে এসে এসব দেখেননি!

ইনডোরে মঙ্গলবার টানা ব্যাটিং অনুশীলন করছেন লিটন দাস
বিসিবি

বাইরে থেকে দেখতে অদ্ভুত। গুদামঘরের মতো দেখতে ইটরঙা সারি সারি ভবন। এরই একটার ভেতরে ওই ইনডোর। ১ জুন নিউইয়র্কে ভারতের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচের পর এই প্রথম ক্রিকেটারদের হাতে ব্যাট-বল। অনুশীলনে তাই তীব্রতা থাকল। একটু মন দিয়ে যা দেখলে ব্যাটসম্যানদের কার কী অবস্থা, তা আপনি সহজেই বুঝে নিতে পারতেন। নেটে কে কতক্ষণ ব্যাটিং করতে পারেন, তার একটা তীব্র একটা প্রতিযোগিতাতেই যেন নেমে গেলেন তিন ব্যাটসম্যান। নামগুলো হয়তো অনুমান করে নিয়েছেন। নাজমুল হোসেন, লিটন দাস…তৃতীয়জন? না, সৌম্য সরকার নন। সাকিব আল হাসান!

টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান ছাপিয়ে এখন সৌম্য সরকারের পরিচয় বোধ হয় অলরাউন্ডার। যে কারণে ব্যাটিংয়ে যাওয়ার আগে অনেকক্ষণ বোলিং করে নিলেন। সাকিবও অলরাউন্ডার, বিশ্বকাপ শুরুর আগে আবার টি-টোয়েন্টি র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে ফেরার সুসংবাদটা তখনো অবশ্য পাননি। অনুশীলনে বোলিং সাকিব কখনোই খুব বেশি করেন না। ইনডোরে তো হাতই ঘোরালেন না। আজ অবশ্য গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামের নেটে ব্যাটিংয়ে নামার আগে অনেকক্ষণ বোলিং করলেন। অন্য স্পিনারদের নানা পরামর্শ দিয়ে স্পিন বোলিং কোচের দায়িত্বটাও যেন ভাগ করে নিলেন মুশতাক আহমেদের সঙ্গে।

অনুশীলনে সাকিব ও লিটন: রানে ফেরার উপায় নিয়েই হয়তো কথা হচ্ছিল দুজনের
বিসিবি

মঙ্গলবার ইনডোরের সাকিব অবশ্য শুধুই ব্যাটসম্যান। গত কিছুদিনের রানখরা কাটাতে বোলিং মেশিনের সামনে টানা ব্যাটিং করে গেলেন। স্টান্স নিয়ে গত কিছুদিন অনেক এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। চোখের সমস্যার কারণেই যা কখনো অদ্ভুতুড়েও হয়েছে। চোখ এখন কেমন—সাকিব এ নিয়ে কথা বলতেই রাজি নন। কিছু ব্যাপার ব্যক্তিগত রাখতেই তিনি ভালোবাসেন। এদিনও স্টান্স আর ব্যাকলিফটের পেছনে অনেক সময় দিলেন। একবার লিটনের সঙ্গে কথা বললেন অনেকক্ষণ। কে যে কাকে পরামর্শ দিলেন, তা অবশ্য সাংবাদিকদের কৌতূহলের বিষয় হয়ে থাকল।

আরও পড়ুন

সাকিবের সঙ্গে ওই কথোপকথনের অংশটুকু বাদ দিলে কখনো পেস বোলিংয়ে, কখনো স্পিনে, কখনো–বা বোলিং মেশিনে পুরোটা সময়ই ব্যাটিং করে গেছেন লিটন। অধিনায়ক নাজমুলও অনেকটা তা-ই। মাঝখানে দুবার কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে ডেকে নিয়ে কথাও বললেন নাজমুল। আলোচনার বিষয় যে ব্যাটিং, তা বুঝতে কোনো সমস্যাই হলো না।

ঢাকা থেকে সেদিন সকালেই ডালাসে নেমেছেন প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন ও বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান জালাল ইউনুস। জেট ল্যাগকে পাত্তা না দিয়ে তাঁরা দুজনও অনেক দূরের ইনডোরে হাজির। যা দেখলেন, তাতে তাঁদের খুশিই হওয়ার কথা।

ডালাসে বৃষ্টি থেমে রোদ ওঠার পর খোলা মাঠে অনুশীলন করেছে বাংলাদেশ দল
বিসিবি

অনুশীলনে খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষা ব্যারোমিটারের কাজ করে। দলের পরিবেশ, মেজাজ—সবকিছুই মূর্ত হয়ে ওঠে তাতে। এদিন সবাই খুবই চনমনে, সিরিয়াস অনুশীলনের ফাঁকে ফাঁকে মজা-খুনসুটিতে যেন সুখী পরিবারের বিজ্ঞাপন। খোলা মাঠে অনুশীলনেও যে রেশটা থাকল।

বিশ্বকাপে মাঠের খেলায় এর প্রতিফলন ঘটলেই হয়!