সন্ধ্যা ছয়টার দিকে কলকাতার তাজ বেঙ্গল হোটেলের লবিতে একটা আলোড়ন। হোটেলের সামনে একটা বাস এসে থেমেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বাস। ধর্মশালার পর চেন্নাই, পুনে, মুম্বাই হয়ে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ-রথ এখন কলকাতায়। আগামী এক সপ্তাহ তা কলকাতাতেই থাকবে।
মুম্বাই থেকে আজ বেলা দুইটায় উড়ান দিয়ে যেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় চার ঘণ্টা। বাস থেকে সবার আগে নেমে এলেন সহকারী কোচ নিক পোথাস। এরপরই লিটন কুমার দাস। তারপর একে একে সবাই।
টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদকে বরণ করে নেওয়া হলো একটা ফুলের তোড়া দিয়ে। বাকি সবার জন্য একটা করে মালা। তা গলায় পরিয়ে দেওয়াটাই রীতি। তা পরাতেও দিলেন অনেকে। মাহমুদউল্লাহ-মুশফিকের মতো কেউ কেউ মালাটা হাতে নিয়ে নিলেন।
হোটেলের লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ও অনেকের গলায় সেই মালা। অদৃশ্য আরেকটা মালাও বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের গলায় ঝুলছিল। পরাজয়ের মালা। ইংল্যান্ড দিয়ে শুরু করে মাঝখানে নিউজিল্যান্ড আর ভারত হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা—একে একে টানা চার পরাজয়। অবস্থা এমনই যে আফগানিস্তানের বিপক্ষে দারুণ এক জয় দিয়ে বাংলাদেশ এই বিশ্বকাপ শুরু করেছিল, সেটিই এখন ভুলে যাওয়ার দশা। এই বিশ্বকাপে অনেক কিছুই হচ্ছে, শুধু শ্বাসরোধী উত্তেজনার কোনো সমাপ্তি ছাড়া। বাংলাদেশের ওই চার পরাজয়ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনো চিহ্নবিহীন অসহায় আত্মসমর্পণ। একটা দলের আত্মবিশ্বাসকে তলানিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আর কী লাগে!
সেটির প্রতিফলন পয়েন্ট তালিকাতেও। সাকিব আল হাসানের অনুপ্রেরণা খোঁজার শেষ আশ্রয়টাও যাতে শেষ। মুম্বাইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচের আগের দিন হাসতে হাসতে পয়েন্ট তালিকার দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন সাকিব। মাত্র এক ম্যাচ জিতেও বাংলাদেশ তখন ৬ নম্বরে। সবার নিচে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড। যা অবিশ্বাসে চোখ কচলে দেখার মতো! বিশ্বকাপ শুরুর আগে কেউ যদি বলতেন, বিশ্বকাপের ১৯ দিন যাওয়ার পর পয়েন্ট তালিকার সবার নিচে থাকবে ইংল্যান্ড, নির্ঘাত তাঁর মানসিক সুস্থতা নিয়েই প্রশ্ন উঠত।
এখন পর্যন্ত ইংল্যান্ডই এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় বিস্ময়। এর কাছাকাছিই রাখতে হবে প্রথম দুই ম্যাচের অস্ট্রেলিয়াকে। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে হলুদ জার্সির দল বিশ্বকাপের অস্ট্রেলিয়া যেমন হয়, ঠিক তেমন রূপেই দেখা দিয়েছে। ইংল্যান্ডেরও সেই সুযোগ আছে। হয়তো পারবে, হয়তো না। ইংলিশ মিডিয়া অবশ্য সাদা বলে ইংল্যান্ডের রাজত্বের দিন শেষ বলে ঘোষণাই করে দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পরাজয়ের পর ইংল্যান্ড অধিনায়ক জস বাটলারও মেনে নিয়েছেন, এখান থেকে সেমিফাইনাল খেলাটা ‘অবিশ্বাস্য রকম কঠিন’।
মেনে নেওয়ার সুর সাকিব আল হাসানের কথায়ও। দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচের আগের দিনও ছিল আশায় বসতি। সেই ম্যাচে ডি কক-ক্লাসেনের হাতে চূড়ান্ত অপদস্থ হওয়ার পর নতুন লক্ষ্য ঠিক না করে তাঁরও উপায় থাকছে না। সেমিফাইনাল যদি না-ই খেলা হয়, অন্তত পাঁচ-ছয়ে শেষ করতে পারার লক্ষ্য। দুই ম্যাচে আফগান-রূপকথা লেখা হয়ে যাওয়ার পর যেটিকে এখন একটু বেশি চাওয়া বলেই মনে হচ্ছে। সাকিবেরও তা মনে হচ্ছে বলেই কিনা চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে কোয়ালিফাই করার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। সরাসরি যে টুর্নামেন্টে যেতে এই বিশ্বকাপে প্রথম আট দলের মধ্যে থাকতে হবে। ২০২৫ সালে পাকিস্তানে আয়োজন-নির্ধারিত যে টুর্নামেন্টে খেলে আন্তর্জাতিক থেকে বিদায় নেওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়ে এসেছেন বিশ্বকাপে আসার আগে।
মাঠের পারফরম্যান্স যেমনই হোক, মাঠের বাইরে রহস্য সৃষ্টিতে বাংলাদেশ দল এই বিশ্বকাপে রীতিমতো চ্যাম্পিয়ন। সবকিছু নিয়েই লুকোচুরি। বিশ্বকাপের মাঝখানে হঠাৎ করে অধিনায়কের দেশে যাওয়ার খবরটাও যেমন আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। সাংবাদিকেরা সাকিবকে মিরপুরে আবিষ্কার করে যা জানতে পেরেছেন।
ছেলেবেলার কোচ ও বর্তমানে বিকেএসপির ক্রিকেট উপদেষ্টা নাজমূল আবেদীনের কাছে টোটকা নেওয়াই যদি সেই সফরের উদ্দেশ্য হয়, একটা প্রশ্ন কিন্তু উঠছেই। বাংলাদেশ দলে এই যে এত এত কোচ, তাঁদের ওপরও তাহলে ভরসা করতে পারছেন না অধিনায়ক। দলের অন্য খেলোয়াড়ই–বা কী বার্তা পাচ্ছে এতে!
টানা চার ম্যাচে বাংলাদেশ দলের যে করুণ অবস্থা, তাতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ওই দাপুটে জয়টাকেও এখন একটু অবাস্তবই লাগছে। পরাজয়ের অন্ধকারের মধ্যে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে একটু আলো খোঁজার চেষ্টা করে সব দলই। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরি ছাড়া সেটিই বা কই!
দলের বড় পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরও মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরির আনন্দে ভেসে যাওয়া কারও কাছে দৃষ্টিকটু মনে হতেই পারে। তবে যে অবজ্ঞা-উপেক্ষা-অপমান সয়ে মাহমুদউল্লাহর এই বিশ্বকাপে আসা, সেটি মনে রাখলে তাঁর ওই উদ্যাপনের কারণ আপনিও বুঝতে পারবেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের একটা বড় সমস্যাও সামনে চলে আসে এতে। ক্রিকেটারদের নাম ধরে ধরে এত কথা বিশ্বের আর কোনো দেশে হয় না। সমর্থকেরা তো বলবেনই, তাই বলে বোর্ড সভাপতি থেকে শুরু থেকে নির্বাচক-অধিনায়ক, বোর্ড পরিচালকেরাও! বাংলাদেশ দলের করুণ অবস্থা দেখে এবার অবশ্য বিশ্বকাপে তাঁদের খুব একটা দেখা মিলছে না।
বাংলাদেশের জন্য এই বিশ্বকাপ করুণ থেকে করুণতর হবে, নাকি পাওয়া যাবে একটু মুখরক্ষার অবলম্বন—সেটি এই কলকাতা-পর্ব শেষেই মোটামুটি জানা হয়ে যাবে। এখানেই পরের দুটি ম্যাচ। ২৮ অক্টোবর নেদারল্যান্ডস, ৩১ অক্টোবর পাকিস্তান। এরপর বাকি থাকবে শুধু শ্রীলঙ্কা আর অস্ট্রেলিয়া। খেলায় আগে থেকে কিছু বলা যায় না, ক্রিকেটে তো আরও না। তবে এখন এমনই পরিস্থিতি যে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচটাকেও মনে হচ্ছে বাংলাদেশের ‘ফাইনাল’!