৫৪৬ রানের বিশাল এক জয়। এর আগে যেখানে টেস্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয় ছিল ২২৬ রানের, সেখানে এক ধাক্কায় ৫৪৬! আনন্দ তো আছেই, সঙ্গে অবিশ্বাসের একটা অনুভূতিও বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আচ্ছন্ন করে রাখার কথা।
কিন্তু এ নিয়ে যদি কারও সঙ্গে মতবিনিময় করতে চান? কোনো উপায় নেই। ৫০০ রানের বেশি ব্যবধানে টেস্ট জিতলে কেমন লাগে, বাংলাদেশের ১১ জন ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কেউ তা জানলে তো! মানে কী, বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দল কি ৫০০ রানে টেস্ট জেতেনি?
জিতেছে, তবে সেসব দলের কেউই যে আর বেঁচে নেই। টেস্ট ক্রিকেট সর্বশেষ এমন ম্যাচের সাক্ষী হয়েছে আজ থেকে ৮৯ বছর আগে। ১৯৩৪ সালে ওভালে যে ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ৫৬২ রানে হারিয়েছিল ডন ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়া। সেই অস্ট্রেলিয়া দলের যে খেলোয়াড় সর্বশেষ পৃথিবী ছেড়েছেন, সেটাও ১৫ বছর আগে। ৯৬ বছর বয়সে চলে গেছেন ব্র্যাডম্যানের ‘দ্য ইনভিন্সিবল’ দলের বিল ব্রাউন।
শুধু রানের হিসাবে টেস্টে সবচেয়ে বড় জয় ৬৭৫ রানের। ব্রিসবেনে ব্র্যাডম্যানের অভিষেক টেস্টে ইংল্যান্ডের সেই জয় আরও ছয় বছর আগে। সেই টেস্টের কেউ বেঁচে আছেন কি না, এই আলোচনা করার তাই কোনো অর্থই হয় না। কালকের আগে ৫০০ বা এর চেয়ে বেশি রানে জয়-পরাজয় দেখেছে আর যে একটিই টেস্ট, তা নিয়ে তো আরও নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার ৫৩০ রানের সেই জয় ১৯১১ সালে।
সংখ্যা আর সংখ্যা! পড়তে গিয়ে একটু কি বিরক্ত হচ্ছেন? কী করব বলেন, উপায় তো নেই। চতুর্থ দিন লাঞ্চের আগেই শেষ হয়ে যাওয়া মিরপুর টেস্টে আরও অনেক কিছুই হয়েছে। এক এক করে যদি বলি, তালিকাটা খুব ছোটও নয়। নাজমুল হোসেনের জোড়া সেঞ্চুরি। এই কীর্তিতে বাংলাদেশের যাঁকে ছুঁয়েছেন, ২৬ মাস পর সেই মুমিনুল হকের সেঞ্চুরির দেখা পাওয়া।
টেস্টে তাঁর প্রথম বলেই তরুণ আফগান পেসারের উইকেট নেওয়ার উল্লাস। সত্যিকার যুগ বদলের ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের পেসারদের ম্যাচ উইনার হয়ে ওঠা। এর প্রতিটিই মনে রাখার মতো। তবে প্রতিটি টেস্ট ম্যাচই যেখানে একেকটা নাটক, এমন সব উপাদান তাতে অবধারিতভাবেই থাকে। কোনোটাতে বেশি, কোনোটাতে একটু কম। কিন্তু এমন টেস্ট ম্যাচ কয়টা হয়, যেখানে বাকি সবকিছু ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে শুধুই একটা সংখ্যা! এখানে যা ‘৫৪৬’। রানের হিসাবে ৮৯ বছরের মধ্যে টেস্ট ক্রিকেটে জয়-পরাজয়ের সবচেয়ে বড় ব্যবধান। এই টেস্ট নিয়ে লেখার শুরুতে সংখ্যা থাকবে না তো কী!
সংখ্যার কচকচানি শেষ করতে গিয়ে মনে হলো, অন্তত আর দুটি সংখ্যা একটু মনোযোগ দাবি করে। সবচেয়ে বড় জয়ের সূত্র ধরে শত বছরের ইতিহাস ঘাঁটতে বাধ্য করছে মিরপুরের এই টেস্ট। তবে যে চারটি জয় নিয়ে এতক্ষণ কথা হলো, তার সবই রানের হিসাবে। ইনিংসে জয়-পরাজয় বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। সেটি বিবেচনায় নিলে রেকর্ডটা ১ ইনিংস ও ৫৭৯ রান।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ইংল্যান্ডের এই জয় ১৯৩৮ সালে ওভালে। ব্র্যাডম্যানের নাম এর মধ্যেই একাধিকবার এসেছে। এখানেও ডনকে না টেনে উপায় নেই। এই টেস্টেও ব্র্যাডম্যানই অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক। ইংল্যান্ডের একমাত্র ইনিংসে বোলিং করতে গিয়ে অ্যাঙ্কেল মচকে যাওয়ায় দুই সতীর্থের কাঁধে ভর দিয়ে যাঁকে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। ম্যাচে আর ব্যাটিংই করতে পারেননি।
মিরপুরে আফগানিস্তানের যে দুঃসহ অভিজ্ঞতা, এতটা না হলেও বাংলাদেশও এর কাছাকাছি যন্ত্রণা অনেকবারই ভোগ করেছে। আফগানিস্তানের কোচ জোনাথন ট্রটও যার প্রত্যক্ষদর্শী। ইংল্যান্ডের পক্ষে তাঁর ৫২ টেস্টের ৪টি বাংলাদেশের বিপক্ষে। একটা ডাবল সেঞ্চুরিও আছে।
আফগান খেলোয়াড়দের মিডিয়াভীতির কারণে টেস্টের চার দিনই সংবাদ সম্মেলনে আসা ট্রট বাংলাদেশের সেই সব দিনের কথা মনেও করিয়ে দিয়েছেন। খোঁচা দিতে নয়; টেস্ট ক্রিকেট শুরুর সময়টা যে এমন কঠিনই হয়, তা বোঝাতে। জয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরও এই টেস্টে বাংলাদেশ যেমন আরও ব্যাটিং করে দ্বিতীয় ইনিংসের লিডটাকে ৬৬১ রানে নিয়ে গেছে, অতীতে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ দলেরও অনেকবারই তা করার সুযোগ ছিল।
তা করলে রেকর্ড বই তোলপাড় করে তোলা এমন বড় পরাজয়ের কলঙ্ক বাংলাদেশের গায়েও হয়তো লাগত। যা হয়নি, তা নিয়ে কথা বলে তো লাভ নেই। তবে বাংলাদেশের শুরুর সময়ের সঙ্গে যেহেতু আফগানিস্তানকে মেলানো হয়েছে, টেস্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পরাজয়টাও জানিয়ে দেওয়া কর্তব্য বলে মনে হচ্ছে। সেটি ৪৬৫ রানের, ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে। সেই পরাজয়ের ভুক্তভোগী বাংলাদেশ দলের এক মুশফিকুর রহিমই শুধু আছেন এখানেও। এই জয়টা মুশফিকের কাছে তাই একটু বেশিই মধুর লাগার কথা।
টেস্টের ম্যাচ রিপোর্টে এত অতীতচারী হওয়াটাকে কি একটু অস্বাভাবিক লাগছে? একটু ভাবলেই অবশ্য আর লাগবে না। আপনিই বলুন না, কাল চতুর্থ দিনে এমন কী ঘটেছে, যেটি ঘটা করে বর্ণনা দাবি করে? হাতে ৮ উইকেট নিয়ে ২২ ওভারে ৭০ রান যোগ করতে পেরেছে আফগানিস্তান। আসা–যাওয়ার মিছিলে শামিল আফগান ব্যাটসম্যানদের আউট হওয়ার ধরনও এমনই শিশুতোষ যে কে কীভাবে আউট হয়েছেন, তা মনে করাও কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবে সমাপ্তিটা অবশ্যই নয়। সেই সমাপ্তিও তো একবার নয়, তিন–তিনবার!
শুরুটা আফগানিস্তানের শেষ ব্যাটসম্যান জহির খানকে আম্পায়ারের কট বিহাইন্ড ঘোষণা করা দিয়ে। বোলার তাসকিনের অমন উন্মাতাল উদ্যাপনের কারণ ছিল। আনন্দটা যে ডাবল! প্রথমবারের মতো টেস্টে ইনিংসে ৫ উইকেট পাওয়ার আনন্দ, বাংলাদেশের টেস্ট জেতার আনন্দ। কিন্তু সেই আনন্দে জল ঢেলে দিল ডিআরএস। একটু রেগে যাওয়াতেই কিনা তাসকিনের পরের বলটি ফুল টস, যা সরাসরি গিয়ে লাগল স্টাম্পে। এবার তো তাহলে সত্যিই শেষ!
না, এবারও নয়। বল ব্যাটসম্যানের কোমর উচ্চতার চেয়ে বেশি ওঠায় যে তা ‘নো’ হয়ে গেছে। ৩ বল পর ম্যাচ সত্যি সত্যি শেষ। তবে সেটি অপঘাতে। তাসকিনের বাউন্সার জহিরের কনুইয়ে এমন ছোবল দিল যে তিনি আর ব্যাটিংই করতে পারলেন না। যে টেস্টে তিন পেসারের ১৪ উইকেটে বাংলাদেশের পেস বোলিং ইতিহাসে নতুন যুগ শুরুর ঘোষণা, সেটির এমন শেষটাকে কি প্রতীকী বলা যায়?
যায় হয়তো!