ট্রুম্যানের রেকর্ড ভাঙার দিন ও গিবসের আঙুল

২০০৯ সালের ল্যান্স গিবস। বল স্পিন করাতে করাতে দেখুন তাঁর তর্জনীর অবস্থাছবি: উৎপল শুভ্র

টেস্ট ক্রিকেটে তিন শ উইকেট নেওয়ার পর ফ্রেড ট্রুম্যানের একটা কথা বিখ্যাত হয়ে আছে। আর কোনো বোলার এই মাইলফলক ছুঁতে পারবেন কি না, প্রশ্নের জবাবে ট্রুম্যান বলেছিলেন, ‘যদি কেউ তা পারেও, সে হবে খুব ক্লান্ত এক মানুষ।’ ক্লান্তির মাত্রা বোঝাতে ব্যবহার করেছিলেন ‘ব্লাডি টায়ার্ড’ কথাটাও।

আরও পড়ুন

তিন শ উইকেট অনেক দিনই আর কোনো ব্যাপার নয়। তবে একসময় তো শুধু ব্যাপার নয়, মহাব্যাপারই ছিল। টেস্ট ক্রিকেটের বয়স প্রায় এক শ বছর হয়ে যাওয়ার পরও তিন শ উইকেটের কীর্তি ছিল মাত্র দুজন বোলারের। ট্রুম্যানের পর তিন শ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়েছেন ল্যান্স গিবস। ট্রুম্যানের ৩০৭ উইকেটের রেকর্ডও ভেঙেছেন এই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অফ স্পিনারই। তা ১৯৭৬ সালের আজকের এই দিনেই। মেলবোর্নে তাঁর ৩০৮তম শিকার ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ইয়ান রেডপাথ। সময়টাও চাইলে জানিয়ে দেওয়া যায়। অস্ট্রেলিয়ার বিকাল ৫টা ২৫ মিনিট।

টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ৩০০ উইকেট পাওয়া বোলার ফ্রেড ট্রুম্যান
ছবি: আইসিসি

স্পিন বোলিং করেছেন বলে ট্রু্ম্যানের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ‘ব্লাডি টায়ার্ড’ হয়তো হননি, তবে বল স্পিন করাতে করাতে বাঁকা হয়ে গিয়েছিল গিবসের ডান হাতের তর্জনী। মধ্যমাও আদি অবস্থায় থাকেনি।

গিবসের আঙুলের এমন দশার কথা আগেই পড়েছিলাম কোথাও। ২০০৯ সালে সেন্ট ভিনসেন্টে তাঁর ইন্টারভিউ করতে গিয়ে প্রথমেই তাই বললাম, ‘আপনার ডান হাতটা একটু দেখি তো।’

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

গিবস একটু অবাক হয়ে আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। আমি ছবি তুলছি দেখে খুব মজাও পেলেন। আঙুলের এমন দশার কারণ হিসেবে আর্নস ভেলের উইকেটের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, ‘আমি আমার ক্যারিয়ারে কখনো এমন স্লো লো টার্নিং উইকেটে বোলিং করার সুযোগ পাইনি। আমার সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সব উইকেটই ছিল দ্রুতগতির। স্পিনারদের জন্য কোনো সাহায্যই তাতে ছিল না। বল স্পিন করাতে আমাকে তাই অনেক জোরে আঙুল ঘোরাতে হতো। আঙুলের ছাল-টাল উঠে যেত।’

অ্যাকশনে ল্যান্স গিবস
ছবি: আইসিসি

তাঁর কথা ভেবে কখনোই উইকেট তৈরি করা হয়নি, এখনকার মতো উইকেট পেলে আরও অনেক বেশি উইকেট পেতেন। এলবিডব্লুর নতুন আইন তখন থাকলেও। গিবসের সময় নিশ্চিন্তে অফ স্টাম্পের বাইরে প্যাড বাড়িয়ে দিতেন ব্যাটসম্যানরা। লাইনের বাইরে ইমপ্যাক্ট হলেই তো মামলা ডিসমিস। বল স্টাম্পে লাগত কি লাগত না, এটা বিবেচনার কোনো বিষয়ই ছিল না তখন।

এসব বলার সময়ও ল্যান্স গিবসের কণ্ঠে কোনো তিক্ততা ছিল না। তিক্ততা নেই কোনো কিছু নিয়েই। সুখী, পরিতৃপ্ত এক মানুষ। আর্থিক সচ্ছলতা ও পারিবারিক শান্তিটাই হয়তো কারণ। ট্রুম্যানের রেকর্ড ভাঙা নিয়ে বলতে বলতেই যেমন একবার বললেন, ‘আমার আসল রেকর্ড এটা নয়। আমার আসল রেকর্ড আমার সন্তানেরা।’

আরও পড়ুন

ক্রিকেটের রেকর্ডও খারাপ নয়। ৭৯ টেস্টে ৩০৯ উইকেট। হ্যাটট্রিক আছে। যে টেস্টে হ্যাটট্রিক, তার আগের টেস্টে চার বলে তিন উইকেট। সবচেয়ে অবাক করে দেয় তাঁর ইকোনমি রেট। ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন মাত্র ১.৯৮। টেস্ট ক্রিকেটে এর চেয়েও কিপটে বোলারের দেখা পাবেন, তবে তাঁদের কেউই এই কিপটেমিকে এত দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে পারেননি, এত উইকেটও পাননি। ১৯৬২ সালে ভারতের বিপক্ষে এক টেস্ট ম্যাচে গিবসের বোলিং অ্যানালাইসিস আপনার চোখ অস্থায়ীভাবে কপালে তুলে দেবে বলে অনুমান করি। ৫৩.৩-৩৭-৩৮-৮!

এটাও কোথায়? বিশ্বের দ্রুততম উইকেটের স্বীকৃতি পেতে পার্থের ওয়াকার প্রতিদ্বন্দ্বী বারবাডোজের কেনসিংটন ওভালে। এই মিতব্যয়িতার রহস্য কী?

রহস্য লুকিয়ে সাফল্যের সেই চিরন্তন মন্ত্রে। পরিশ্রম, পরিশ্রম, আরও পরিশ্রম। বলতে বলতে গিবস বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের ওই দুটি আঙুলে হাত বোলাচ্ছিলেন।