আবাহনীর সাফল্যের রহস্য—দলীয় বন্ধন, তারুণ্য, পেশাদারত্ব, টাকা
জার্মান ফুটবল নিয়ে গ্যারি লিনেকারের সেই অমর উক্তি প্রায় সবারই জানা। ফুটবল ২২ জনের খেলা, যাতে শেষ পর্যন্ত জার্মানি জেতে। বাংলাদেশের একমাত্র লিস্ট ‘এ’ টুর্নামেন্ট ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আবাহনীর আধিপত্যের সঙ্গেও কথাটা মেলানো যায়। এক-দেড় মাস ধরে ১২টি ক্লাবের এই টুর্নামেন্ট হবে, যার শেষটা হবে আকাশি-উৎসবে।
একসময়কার প্রথম বিভাগ, পরে প্রিমিয়ার লিগ মিলিয়ে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ২৩ বার। এর ধারেকাছেও নেই অন্য কোনো দল। আবাহনীর পর সবচেয়ে বেশিবার শিরোপা জিতেছে মোহামেডান, সেটি মাত্র ৯ বার। আবাহনীর সাম্প্রতিক দাপট আরও বেশি। ২০১৫-১৬ মৌসুম থেকে ধরলে ৮টি লিগের ৬টিতেই শিরোপা।
বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ টুর্নামেন্টে আবাহনীর এই আধিপত্যের রহস্যটা কী? এ প্রশ্নের উত্তর আবাহনীর প্রধান কোচ খালেদ মাহমুদ দিয়েছেন দুটি ইংরেজি শব্দে, ‘টিম বন্ডিং।’ পরে যেটির ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘ওরা একজন আরেকজনের জন্য খেলে। ওরা সবাই বন্ধু। ঘুরতে গেলে একসঙ্গে ঘুরতে যায়। কোনো একটা প্ল্যান হলো, কোনো কারণে যদি কেউ সেই প্ল্যানে আসতে না পারে, তাহলে সেদিন প্ল্যানটাই বাতিল হয়ে যায়। মানে যা করার একসঙ্গে করব, নাহলে করব না, দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে সম্পর্কটা এখন এমন। আমার কিছুই করতে হয় না। ওরাই চিন্তা করে, দল কীভাবে জিতবে। আমি আগে মাঠে অনেক বেশি কথা বলতাম। এখন বলিই না। আমি এখন অনেকটা ম্যানেজারের মতো।’
আবাহনীর এবারের দলটির বেশির ভাগ ক্রিকেটারই তরুণ। খেলোয়াড় তালিকায় তাকালে বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রতিচ্ছবিই দেখতে পাবেন। নাজমুল হোসেনের জাতীয় দল যেমন তারুণ্যের ছোঁয়ায় একদম সবুজ, আবাহনীও ঠিক তা-ই। তারুণ্যে ঠাসা দলের ড্রেসিংরুমের আবহটা স্বাভাবিকভাবেই অন্য রকম হবে। মাহমুদ সেই আবহই ধরে রাখতে চান বলে সাকিব-তামিমদের মতো অভিজ্ঞদের দিকেও হাত বাড়াননি। তিনি বাজি ধরেছেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর, ‘এই ছেলেগুলো অনেক দিন খেলছে। ওরা সুখী পরিবারের মতো। ড্রেসিংরুমে কোনো চিন্তা নেই। তুই-তাই, গালাগালি, হইচই, মজা, আড্ডা—আমি এটা দেখতে খুব পছন্দ করি।’
মাহমুদ জানেন, অভিজ্ঞ ক্রিকেটার দলে থাকলে এই আবহ ধরে রাখা কঠিন হতো, ‘এখন যদি রিয়াদ আমার দলে খেলে, খেলতেই পারে, তাকে আমি খুব পছন্দ করি। কিন্তু রিয়াদ খেললে ওরা যে ভাষাটা এখন ড্রেসিংরুমে ব্যবহার করে…আমিও যাই না এখন অনেক সময়। ভয় পাই। কে কি–না–কি বলে ফেলে, কে জানে! ওই মাপের অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররা চলে এলে হয়তো ছেলেরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে না। এটা আমার মাথায় থাকে। ওরা ড্রেসিংরুমটা উপভোগ করুক। এখন সাকিবকে কে না দলে চাইবে? তামিমকে কেন আমি নেব না? মুশফিক, সে আমাদের হয়ে খেলেছেও। ওরা বাংলাদেশের সেরা খেলোয়াড়। কিন্তু বয়সের ওই পার্থক্যটা, সম্পর্কটা প্রতিবন্ধকতা হয়ে যায়।’
সাকিব-তামিমদের ছাড়া দল সাজিয়েও আবাহনীর খরচ কিন্তু কম হয়নি। এবারের দল সাজাতে লেগেছে ৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অঙ্কটা জানিয়ে মাহমুদই এর তাৎপর্যটা বুঝিয়ে দিতে বললেন, এই টাকায় বিপিএলে বিদেশি খেলোয়াড়সহ ভালোভাবে একটা দল গড়া সম্ভব। আবাহনীর এই আর্থিক সামর্থ্যও পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে অন্য দলের সঙ্গে। মাহমুদ তাই গর্ব করে বলেন, ‘যদি আবাহনী মনে করে আমি এই প্লেয়ারকে ছাড়ব না, এরপর কেউ যদি নিতে চায়, তাহলে তাদের তো বারগেন করতে হবে। আমি যদি কাউকে পাঁচ টাকা দিই, তুমি আট টাকা দিয়ে নিয়ে নাও। কেউ তো মানা করেনি। আমি তো কাউকে আবাহনীতে বেঁধে রাখিনি। কেউ নিতে পারবে কি না, সেটা একটা প্রশ্ন।’
ওরা একজন আরেকজনের জন্য খেলে। ওরা সবাই বন্ধু। ঘুরতে গেলে একসঙ্গে ঘুরতে যায়। কোনো একটা প্ল্যান হলো, কোনো কারণে যদি কেউ সেই প্ল্যানে আসতে না পারে, তাহলে সেদিন প্ল্যানটাই বাতিল হয়ে যায়। মানে যা করার একসঙ্গে করব, নাহলে করব না, দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে সম্পর্কটা এখন এমন।খালেদ মাহমুদ, আবাহনীর প্রধান কোচ
দলের আবহের কথা আরও একবার মনে করিয়ে দিয়েছেন মাহমুদ, ‘আবাহনীর এই পরিবেশ ছেড়ে কেউ যেতে চাইবে কি না, এটা খেলোয়াড়েরা বলতে পারবে। কারণ, সবার অন্য ক্লাবে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। আমি কাউকে ছোট করছি না। কিন্তু আমার যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস আছে, আবাহনীর প্লেয়ার নেওয়া এত সহজ হবে না। এটা শুধু টাকার ব্যাপার নয়, ক্লাবের যে পরিবেশ, সেটা খেলোয়াড়েরা খুব উপভোগ করে।’
খেলোয়াড়ের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টিও এসেছে মাহমুদের কথায়, ‘ওরা ওদের পারিশ্রমিকের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত। ওদের আবাহনীর কাছে টাকা চাইতে হয় না। ওই দিন এখন অতীত। ওরা জানে, যদি আমার চুক্তি হয় ছয় টাকার, তাহলে প্রথমে ২ টাকা পাব, এরপর দেড় টাকা, ৫০ পয়সা পাব, এভাবে আমার টাকাটা সময়মতো মিলে যাবে। অনেক ক্লাবের ঘটনা জানি, যারা কিছু টাকা বাকি রেখে দেয়। আগের বছরের ২ টাকা, এই বছরের ৫০ পয়সা নিয়ে তুমি চুক্তিটা করে নাও। তখন ছেলেদের আগের বছরের পাওনা টাকার জন্য বাধ্য হয়ে ওই ক্লাবে ওই বছর খেলতে হয়। আবাহনীতে এই সংস্কৃতি নেই।’
এই সংস্কৃতির কথা জানা থাকায় পারিশ্রমিক না নিয়েও খেলোয়াড়েরা আবাহনীর সঙ্গে চুক্তি করে বলে দাবি মাহমুদের, ‘ওদের সঙ্গে আমাদের একটা আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে। একটা ছেলে কোনো টাকা না নিয়েই চুক্তি স্বাক্ষর করে। এখানে কিন্তু কম দামি খেলোয়াড় নেই। অনেক দামি খেলোয়াড় আছে। সবাই দামি। কোনো টাকা না পেয়েই ছেলেরা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। বুঝতে পারছেন, ক্লাবের প্রতি তাদের বিশ্বাস কতটা। এই আবাহনী অনেক পেশাদার।’
শেষ কথাটা বেশ জোর দিয়েই বললেন মাহমুদ। ঢাকার ক্রিকেট লিগে আবাহনীর একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণটা যে ওই কথাতেই ফুটে ওঠে।