২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ব্যর্থতার স্মৃতি তখনো তরতাজা। ঠিক এমন সময়েই বাংলাদেশ সফরে আসে পাকিস্তান দল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর বাবর আজমের দলের বিপক্ষে ধবলধোলাই হয় বাংলাদেশ। ব্যর্থতা তখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সর্বাঙ্গে। তবে খেলাটা ক্রিকেট। উত্থান-পতন থাকবেই। সাফল্যবুভুক্ষু ক্রিকেটপ্রেমী জাতি ২০২২ সালে অন্য রকম বাংলাদেশ দেখার আশায় ছিল।
বাংলাদেশ দলের নতুন বছরটা শুরু হয় নিউজিল্যান্ডে টেস্ট সিরিজ দিয়ে। বাংলাদেশ দলের চরম আশাবাদী সমর্থকও কিউইদের আঙিনায় জয়ের কল্পনা করেনি। কিন্তু কী আশ্চর্য! সেই কঠিনতম প্রতিপক্ষ ও কন্ডিশনেই বাংলাদেশ ইতিহাস গড়ে। মাউন্ট মঙ্গানুইতে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে বছর শুরু করে মুমিনুল হকের বাংলাদেশ। অবিশ্বাস্য কীর্তিতে শুরু হওয়া বছরটার পরতে পরতে ছিল বিদেশবিভুঁইয়ে সাফল্য।
দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে ওয়ানডে সিরিজ জয়, অস্ট্রেলিয়ায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দুটি জয় এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট ড্র আর বছর শেষে ভারতকে ওয়ানডে সিরিজে হারানো ছিল বড় অর্জন। টেস্টের সাফল্যে শুরু হওয়া বছরটা শেষ হতে পারত টেস্ট জয় দিয়েই। কিন্তু ভারতের কাছে মিরপুর টেস্ট অল্পের জন্য জেতা হয়নি বাংলাদেশ দলের। তবে অর্জনের খাতা ভারী করেই বছরটা শেষ করেছে বাংলাদেশ দল।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের অধ্যায়ে ২০২২ সালের গল্প লিখতে গেলে নিউজিল্যান্ডের সেই জয় থেকেই শুরু করতে হবে। আত্মবিশ্বাস যখন তলানিতে, তখন কিউইদের আঙিনায় গিয়েছিল মুমিনুলের দল, যেখানে ২০ বছরে কোনো জয় পায়নি বাংলাদেশ। ওদিকে নিউজিল্যান্ড কদিন আগেই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি জিতে এসেছে। নিউজিল্যান্ড তাদের টেস্ট ইতিহাসের সেরা সময়টা কাটাচ্ছিল তখন। টিম সাউদি, ট্রেন্ট বোল্ট, নিল ওয়াগনার, কাইল জেমিসনদের নিয়ে সাজানো কিউই বোলিং আক্রমণটা নিজেদের কন্ডিশনে অপ্রতিরোধ্য। তাদের বিপক্ষে টেস্ট জয় কল্পনা করলে এখনো অনেকের মনে শিহরণ জাগবে।
মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের সে জয়ের মহত্ত্ব বেড়ে যায় আরেকটা কারণেও। সেই সিরিজটি বাংলাদেশ খেলেছে তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসানকে ছাড়া। মাহমুদুল হাসান, নাজমুল হোসেন, ইয়াসির আলী, শরীফুল ইসলাম ও ইবাদত হোসেনরা সে ম্যাচে নায়কের ভূমিকায় আবির্ভূত হন। উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল মুমিনুল, লিটন দাস, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাসকিন আহমেদদেরও। পরবর্তী সময়ে বছরজুড়ে তাঁদের হাত ধরেই এসেছে আরও অর্জন।
নিউজিল্যান্ড থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়নি বাংলাদেশ নারী দলকেও। প্রথমবারের মতো নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে পাকিস্তানকে হারিয়ে চমকের জন্ম নেয় নিগার সুলতানার দল। শেষ ওভারের রোমাঞ্চকর ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও প্রায় হারিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা। সেপ্টেম্বরে আইসিসির আরেক মঞ্চেও সে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিল বাংলাদেশ নারী দল। ২০২৩ নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশের মেয়েরা।
এদিকে সাকিব-তামিমরা বছরের শুরুর টেস্ট ক্রিকেটের সাফল্যটা ওয়ানডেতেও ধরে রাখে। ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে আফগানিস্তানকে ওয়ানডে সিরিজে হারায় তামিম ইকবালের দল। আফগানিস্তান বলেই তাজা ঘাসে মোড়ানো উইকেটে হয়েছে সেই সিরিজ। ব্যাটসম্যানদের জন্য সেটি ছিল চ্যালেঞ্জিং। বোলারদের দাপটের সিরিজটি ২-১ ব্যবধানে জিতেছে বাংলাদেশ।
ওয়ানডে ক্রিকেটে বড় সাফল্যটা এসেছে মার্চের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। কন্ডিশনের চূড়ান্ত পরীক্ষায় উতরে গিয়ে প্রথমবারের মতো প্রোটিয়াদের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সেরা সাফল্যের তালিকা করতে গেলে দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ জয় শীর্ষেই থাকবে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্ট ড্র–ও বছরের অন্যতম বড় অর্জনের আলোচনায় থাকবে।
টেস্টে বাংলাদেশ দলের এর পরের সময়টা ভালো যায়নি। শ্রীলঙ্কার কাছে মিরপুর টেস্টে হারের পর মুমিনুল হক অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে টেস্ট সিরিজ হেরেছে ২-০ ব্যবধানে। টি-টোয়েন্টি সিরিজও ক্যারিবীয়রা জিতেছে স্বাচ্ছন্দ্যে। বাংলাদেশ অবশ্য ওয়ানডে সিরিজ জেতায় শূন্য হাতে ফিরতে হয়নি। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে জিম্বাবুয়ে সফরে যায় বাংলাদেশ দল। সেখানে টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে সিরিজ জিততে পারেনি। ব্যর্থতাটা আরও দীর্ঘ হয় টি-টোয়েন্টির এশিয়া কাপ পর্যন্ত। সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে পড়ে বাংলাদেশ।
তবে এশিয়া কাপের পর সহজ প্রতিপক্ষ আমিরাতের বিপক্ষেই টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতে জয়ের ধারায় ফেরেন সাকিবরা। সে আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিউজিল্যান্ড ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি খেলতে যায় বাংলাদেশ। সেখানে সব ম্যাচে হারলেও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের উন্নতিটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছিল। যেটার ফল বাংলাদেশ পেয়েছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এসে। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভ পর্বে দুটি ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ। নেদারল্যান্ডস ও জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে সেমিফাইনালের সম্ভাবনাও জাগিয়েছিলেন সাকিবরা। তবে অতীত রেকর্ডের বিচারে এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে বাংলাদেশের জন্য সফলই বলা যায়।
বিদেশের বাইরে ধারাবাহিকতার আভাস দেওয়া বাংলাদেশ দলের বছরের অন্যতম সেরা সাফল্যটা এসেছে ঘরের মাঠে। তারকায় ঠাসা ভারতীয় দলকে ২০১৫ সালের পর আরও একবার ঘরের মাঠে পেয়ে ওয়ানডে সিরিজ জিতে নেয় বাংলাদেশ। টেস্ট সিরিজেও লড়াই করেছে বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম ও মিরপুরে দুটি টেস্ট হারলেও বাংলাদেশ দল দেখিয়েছে লড়াই করার মানসিকতা। ভারত সিরিজ শেষে সাকিব এই মানসিকতাকেই ২০২২ সালের অন্যতম প্রাপ্তি বলেছেন। এ মানসিকতা ধরে রাখতে পারলে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অর্জনের পাল্লা আরও ভারী হবে।