সেই ‘অপরাজিত’ জাকেরকে কি দেখা যাবে আজ
বাকি ছিল মাত্র ৩টি ডেলিভারি। জাকের আলী আর একটু অপেক্ষা করলেই হয়তো পারতেন। কিন্তু পরিস্থিতির দাবিটা ছিল অন্য রকম। ঝুঁকিটা তাই নিতেই হয়েছিল জাতীয় ‘মূল’ দলের হয়ে প্রথম খেলতে নামা এ ব্যাটসম্যানকে। তবে যেহেতু ব্যাপারটা ঝুঁকি, তাই যে কেউই ‘জ্ঞান’ দিতে পারেন। অন্তত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেটা হয় আরকি।
সমালোচকদের দাবি হতে পারে, যখন শেষ ৪ বলে লাগবে ১০ রান, আসতে বাকি শুধু শরীফুল ইসলাম ও মোস্তাফিজুর রহমান, তখন জাকের আরেকটু হিসাব করতে পারতেন। মানে যেহেতু আর কেউ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান নেই, তাই শেষ ওভারে স্ট্রাইক পেয়েই বড় শটের দিকে না গিয়ে আরেকটু অপেক্ষা করা। যেন শেষ দুই বলে ৭–৮ রানের সমীকরণ থাকলেও সেটি তিনি মেলাতে পারেন। জাকেরের অনুপস্থিতিতে গতকালের ম্যাচে যা পারেননি শরীফুল ও তাসকিন।
অবশ্যই জাকের আরও ২-১ বল থাকলেও আউট হয়ে যেতে পারতেন, বল মিস করতে পারতেন। যে শটে আউট হয়েছেন, সেটিও আরেকটু ওপরে উঠলেই ছক্কা হতে পারত। ছক্কা হলে বোলার দাসুন শানাকা যে আরও চাপে পড়তেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। দল জয় পেলে জাকেরের ইনিংসও পূর্ণতা পেত অন্য মহিমায়।
সে ক্ষেত্রে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়তে পারতেন। গত ছয় মাসে টি–টোয়েন্টিতে যেটি তিনি নিয়মিত করেছেন। জাকেরকে তো এ সময় আউটই করা যাচ্ছে না! কাল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আউট হয়েছেন বলেই ‘আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খোঁজ’ নেওয়ার মতো লেখার শুরুতেই ৪ বলে ১০ রানের সমীকরণ মেলানোর অন্য এক পথ দেখানো হলো। মাঠের বাইরে থেকে যেটা প্রায় সবাই পারেন। আর এই লেখায় জ্ঞানত সেটা করার কারণও জাকেরের পক্ষেই যায়—অপরাজিত থেকে ম্যাচটা জেতাতে পারলে গত ছয় মাসে টি–টোয়েন্টিতে জাকেরের অবিশ্বাস্য যাত্রাটা আরেকটু পূর্ণতা পেত।
আচ্ছা, ব্যাটিংয়ে ‘অতিমানবীয়’ গড়ের কথা বলতে গেলে কোন নামটা সবার আগে আসবে? উত্তরটা নিশ্চয়ই ঠোঁটের আগায়—স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, যাঁর টেস্ট গড় ৯৯.৯৪। তবে তাঁর সঙ্গে তুলনার ধৃষ্টতা নয়—অপরাজিত থাকাটা জাকের গত ছয় মাসে কেমন ‘অভ্যাসে’ পরিণত করেছেন এবং তাতে ব্যাটিং গড় যে ব্র্যাডম্যানীয় হয়ে উঠেছে, তা বোঝাতেই এ উদাহরণ। এ সময়ে জাকের ১৮ ম্যাচে ১৪ ইনিংসে ব্যাট করেছেন। আউট হয়েছেন মাত্র ৩ বার। আর তাতেই ব্যাটিং গড় গিয়ে ঠেকেছে ১০১.৬৬! উইজডেন ইন্ডিয়া বলছে, এ সময়ে অন্তত ৫ ইনিংসে ব্যাট করেছেন এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে জাকেরের ব্যাটিং গড়ই সেরা।
কিন্তু ব্যাপারটা এত দিন সেভাবে আলোচনায় আসেনি কেন? টুর্নামেন্টগুলোর দিকে তাকানো যাক। জাকের এ সময় খেলেছেন এশিয়ান গেমসের ক্রিকেট ইভেন্ট, বিপিএল ২০২৪ এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি–টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচ।
এশিয়ান গেমসের ক্রিকেট ইভেন্ট এবং বিপিএল বৈশ্বিক ক্রিকেটে সেভাবে আলোচিত কোনো টুর্নামেন্ট নয়। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটি আন্তর্জাতিক—আর সেখানে ২০৭ রান তাড়া করতে নেমে ৩৪ বলে ৬৮ রানে ইনিংসে জাকের ম্যাচটা শেষ ওভার পর্যন্ত টেনে নেওয়ায় এখন পাদপ্রদীপের আলোয়। সে আলোয় সাম্প্রতিক জাকেরকে কেমন দেখায়, সেটা একটু বুঝিয়ে নেওয়া যাক।
জাকের প্রথম জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন গত বছর মার্চে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টি–টোয়েন্টি সিরিজে। সেবারও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের হয়ে কয়েকটি ভালো ইনিংস খেলাতেই ডাক পেয়েছিলেন। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে আর মাঠে নামার সুযোগ পাননি। সুযোগ এল গতকাল। এবারও অবশ্য শুরুতে দলে ছিলেন না, স্পিনার আলিস আল ইসলাম চোটে ছিটকে যাওয়াতে দুয়ার খুলে যায় তাঁর। অবশ্য জাকেরের সুযোগ আরও আগেই পাওয়া উচিত ছিল, তেমন মনে করা লোকও ছিলেন।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে দল ঘোষণার পর তো কুমিল্লার কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন নিজের হতাশা ব্যক্ত করতে গিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘জাকেরের কথাটা সব সময় আপনারা ভুলে যান, আপনারা কেউ কিন্তু আসলে কখনোই জিজ্ঞাসা করেন না। ছেলেটার হয়তো চেহারা একটু কালো, এই কারণে আমার মনে হয়, বোর্ডও তাকে দেখে না ঠিকমতো। আপনারা ৬ নম্বর, ৭ নম্বরে প্লেয়ার খোঁজেন। এই ছেলেটা লাস্ট কয়েকটা ম্যাচ থেকে খুবই ভালো খেলছে। তার স্ট্রাইক রেট যদি দেখেন আর সে প্রতিটা দিনই আমাদের ক্রুশাল মোমেন্টে রানটা করে দিচ্ছে এবং সে অনেক সেনসিবল।’
সালাউদ্দিনের কথাগুলো শুনতে একটু রূঢ় লাগে। তবে এসব কথার পেছনে যুক্তি সম্ভবত একটাই—জাকেরের পারফরম্যান্স। গত বছর অক্টোবরে হাংজুতে এশিয়ান গেমসে জাকেরের ৩ ইনিংস— ১৪*, ২৪* ও ০*। এরপর ১৯ জানুয়ারি শুরু হলো বিপিএল। সেখানে কুমিল্লার হয়ে জাকেরের ১০টি ইনিংস—০*, ২৩* (২০ বল), ২৯ (২৭ বলে), ১৮* (৪ বলে), ১৮* (৮ বলে), ৬, ৪০* (৩১ বলে), ৭* (২), ৩৮* (১৬ বলে), ২০* (২৩ বলে)।
শুধু ইনিংসের আকার দেখে মনে হতেই পারে, জাকের এমন আহামরি কিছু করে ফেলেননি। কিন্তু তাঁর ব্যাটিংয়ের ধারা ও ধরন বলে সালাউদ্দিনের একটি কথা ভবিষ্যতে সত্য হলেও হতে পারে, ‘আপনারা ৬ নম্বর, ৭ নম্বরে প্লেয়ার খোঁজেন। এই ছেলেটা লাস্ট কয়েকটা ম্যাচ থেকে খুবই ভালো খেলছে...।’
গতকাল সালাউদ্দিনের এই ‘ভালো’ই হয়ে গেল দুর্দান্ত! দল জেতেনি ঠিক, তবে ২০১৮ সালের পর এই প্রথম টি–টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের দুই শ রানের সংগ্রহে ছয়ে নেমে কেউ অন্তত দুই শ স্ট্রাইক রেটে ৪০–এর বেশি রান করলেন। পাঁচ বছর আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আগে ব্যাট করে বাংলাদেশের ২১১ রানের সংগ্রহে ছয়ে নেমে ২১ বলে ৪৩ রান করেছিলেন মাহমুদউল্লাহ।
জাকেরের কাজটি আরেকটু কঠিন ছিল। আগে ব্যাট করে ২০৬ তুলেছিল শ্রীলঙ্কা। জাকের যখন নেমেছিলেন, তখন প্রয়োজন ছিল ৬৭ বলে ১৩৯। হাতে ৪ উইকেট। এই ম্যাচটাই জাকের টেনে নেন শেষ ওভার পর্যন্ত। দুর্ভাগ্য, শেষ করে আসতে পারেননি (৩৪ বলে ৬৮ রান)। তবু কিন্তু সালাউদ্দিনের ওই কথাটি মিথ্যা হয় না, ‘সে অনেক সেনসিবল।’
জাকেরের মাথা পরিণত ও ঠান্ডা না হলে তো ম্যাচ ওই পর্যন্ত যায় না। অন্তত এমন লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে চাপের মুখে বাংলাদেশের ভেঙে পড়ার ইতিহাস সেটাই বলে। জাকের অনেক দিন পর সেই ধারায় যেন বিপরীত স্রোতের ধারা!
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আজ দ্বিতীয় টি–টোয়েন্টিতে কি দেখা যাবে সেই ‘অপরাজিত’ জাকেরকে?