অসহ্য ভ্যাপসা গরমে সেদ্ধ হতে থাকা নগর সন্ধ্যার পর ভিজল স্বস্তির বৃষ্টিতে। সেই বৃষ্টিও চরাচর ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো। আগুনে তাপ বিকিরণ করতে থাকা মাঠ থেকে এর আগেই পাঁচ তারকা হোটেলের নিয়ন্ত্রিত শীতাতপের আশ্রয়ে ফিরেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। যেখানে বৃষ্টি হলেও যা, না হলেও তা-ই।
আসলেই কি তা-ই? বাকি সবার জন্য স্বস্তির বৃষ্টি কি একটু হলেও অস্বস্তি ছড়ায়নি বাংলাদেশ দলে! টেস্টের যা পরিস্থিতি, তাতে আফগানিস্তান প্রতিপক্ষ তো শুধুই নামে। আসল প্রতিপক্ষের নাম বৃষ্টি। বৃষ্টি, একমাত্র বৃষ্টিই শুধু পারে বাংলাদেশকে জয়বঞ্চিত করতে।
তৃতীয় দিন শেষে ব্যাটিং করতে নেমে প্রথম বলেই উইকেট হারিয়েছে আফগানিস্তান। পরের ওভারেই আরেক ওপেনারকে। টেকনিকে বড় সমস্যার মূল্য দিয়ে মাথায় বাউন্সার খেয়ে মাঠ ছেড়ে গেছেন অধিনায়ক হাসমতউল্লাহ শহীদি। কনকাশন বদলির সুযোগ থাকায় স্কোরবোর্ডে ৪৫ রানের পাশে অবশ্য ২ উইকেটই থাকছে। সম্ভাব্য শুধু নয়, এই টেস্টের নিশ্চিত ফল হিসেবেও থাকছে আফগানিস্তানের পরাজয়। যদি না...
যদি না বৃষ্টি ঝামেলা করে। করলেও আফগানিস্তানের বাকি ৮ উইকেট তুলে নেওয়ার মতো সময় না দেওয়ার নিষ্ঠুরতা হয়তো তা দেখাবে না। আফগানিস্তানের দলের যে বিপর্যস্ত অবস্থা, তাতে ম্যাচ শেষ করে দিতে খুব বেশি সময়ও কি লাগবে! কী ব্যাপার, শুধু বাংলাদেশের জয় নিয়েই যে কথা হচ্ছে!
ক্রিকেট ম্যাচে সম্ভাব্য আরও দুটি ফল আছে না! আছে, তবে তা নিয়ে আলোচনা করাটা নিছকই সময় নষ্ট। আফগানিস্তানের সামনে জয়ের যে লক্ষ্য দিয়েছে বাংলাদেশ, সেটিকে এভারেস্টসম লিখতে গিয়ে মনে হলো, এভারেস্টও জয় করা যায়। কিন্তু এখানে আফগানিস্তানের সামনে তো অজেয় শৃঙ্গ, যা জয় করার কথা শুধু কল্পনাতেই ভাবা যায়। নাকি কল্পনাও এমন লাগামছাড়া হতে লজ্জা পাবে।
স্কোরবোর্ডে ৪ উইকেটে ৪২৫ রান তোলার পর শ্রান্ত-ক্লান্ত আফগানদের একটু স্বস্তি দিয়ে যখন দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণা করলেন লিটন দাস, এর অনেক আগেই নিশ্চিত হয়ে গেছে, এই ম্যাচে শুধু একটি ফলই সম্ভব। জিততে হলে আফগানিস্তানকে করতে হবে ৬৬২ রান, যেখানে টেস্ট ক্রিকেটে চতুর্থ ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রান করে জয়ের রেকর্ডই ৪১৮।
এর আগে বাংলাদেশ কখনো প্রতিপক্ষকে এত বড় জয়ের টার্গেট তো দেয়ইনি, সাম্প্রতিক অতীতে আর কোনো দলও দিয়েছে বলে মনে পড়ছে না। টেস্ট ক্রিকেটের পুরো ইতিহাসেই তো প্রতিপক্ষকে এর চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার উদাহরণ মাত্র ৭টি।
এক নম্বরে ৮৩৬ রান। ১৯৩০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে যা করতে বলেছিল ইংল্যান্ড। কিংস্টনের সেই টেস্ট ড্র হওয়ায় এই রেকর্ড তেমন প্রচার পায়নি, যা পেয়েছে দ্বিতীয়টি। পেয়েছে, কারণ টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় জয়ের রেকর্ডটি সেখানেই। ১৯২৮ সালে ব্রিসবেনে ইংল্যান্ড জিতেছিল ৬৭৫ রানে। অস্ট্রেলিয়ার সামনে জয়ের লক্ষ্য ছিল ৭৪২। সেন্টার উইকেটে প্র্যাকটিসের মতো করে যেভাবে ব্যাটিং করে যাচ্ছিল বাংলাদেশ, এটা টপকে যাওয়া কোনো ব্যাপারই ছিল না। আর মাত্র ৮০ রানই তো লাগত। শুধু সবচেয়ে বড় জয়ের কারণেই নয়, ব্রিসবেনের ওই টেস্ট আরেকটি কারণেও স্মরণীয় হয়ে আছে ইতিহাসে। এটিতেই টেস্ট অভিষেক হয়েছিল ডন ব্র্যাডম্যান নামে এক তরুণের।
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণা করার আগে যা হয়েছে, সেটিকে বলতে পারেন রান–উৎসব। যে উৎসবে রোশনাই ছড়িয়েছে একের পর এক রেকর্ড আর মাইলফলক। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় তো অবশ্যই নাজমুল হোসেনের জোড়া সেঞ্চুরি। সেই মাইলফলক ছোঁয়ার সময় উইকেটে তাঁর সঙ্গী মুমিনুল হক। নাজমুলের ওই মুহূর্তের অনুভূতিটা বাংলাদেশে শুধু তাঁরই বোঝার কথা। ২০১৮ সালেই যে এই অনির্বচনীয় অনুভূতির স্বাদ পেয়েছেন।
মুমিনুলের সেই জোড়া সেঞ্চুরিতে ইন্টারেস্টিং একটা গল্প আছে। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে প্রথম মেয়াদকালের শেষ দিকে মুমিনুলের জীবনটা দুর্বিষহই করে তুলেছিলেন। সাদা বলের ক্রিকেট থেকে বাদ দিয়েছিলেন আগেই। ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়া সিরিজে বাদ দিয়ে দিলেন টেস্ট দল থেকেও। সংবাদমাধ্যমে তীব্র সমালোচনার পর সেই সিদ্ধান্ত বদলাল বটে, তবে ঢাকায় প্রথম টেস্টের দল থেকে মুমিনুলকে বাদ দিয়ে ঠিকই নিজের জেদটা রাখলেন হাথুরুসিংহে। চট্টগ্রামে দ্বিতীয় টেস্টে খেলালেও সেখানে মুমিনুলকে নিয়ে যা করলেন, তা স্পেশালিস্ট কোনো ব্যাটসম্যানের জন্য চরম অপমান। দ্বিতীয় ইনিংসে নামালেন আট নম্বরে!
পরের বছরই শ্রীলঙ্কার কোচ হয়ে বাংলাদেশে হাথুরু এবং চট্টগ্রামে তাঁর দলের বিপক্ষে প্রথম টেস্টেই জোড়া সেঞ্চুরিতে মুমিনুলের জবাব। তৃপ্তি নিশ্চয়ই তখনো পেয়েছিলেন, তবে কালকের সেঞ্চুরিতে হয়তো আরও বেশি। সর্বশেষ সেঞ্চুরি করেছেন ২০২১ সালের এপ্রিলে। এরপর ২৬ মাস এবং ২৬ ইনিংস, গত ডিসেম্বরে ভারতের বিপক্ষে ৮৪ রানের ইনিংসের আগে টানা ৯ ইনিংসে দুই অঙ্ক ছুঁতে পারেননি। শুধু টেস্ট ম্যাচটাই খেলেন। টেস্টই তাঁর একমাত্র অবলম্বন।
সেই টেস্ট দলে তাঁর জায়গা নিয়ে বড় প্রশ্নই উঠে গিয়েছিল। সেই প্রশ্ন সবচেয়ে বেশি কে তুলেছিলেন, তা অনুমান করতে আপনারও খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ব্যর্থতার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করতে নেমেছিলেন মাথার ওপর ঝুলন্ত খাঁড়া নিয়ে। নাজমুলের সেঞ্চুরি যদি তাঁর সুখের সময়টাকে আরও রঙিন করে তোলার উপলক্ষ হয়, মুমিনুলের সেঞ্চুরি তাঁর ক্যারিয়ারের লাইফলাইন।
বড় অর্জনের দিনে বাকি সব আড়াল হয়ে যায়। যে কারণে জাকির হাসান ও লিটনের হাফ সেঞ্চুরি সেভাবে আলোচনাতেই এল না। তবে যেটি অবশ্যই আলোচনায় আসা উচিত, তা হলো, বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের স্টোকস-ম্যাককালামের ‘বাজবল’-এর অনুসারী হয়ে যাওয়া।
এত রান করার পরও যে আফগানিস্তানকে অলআউট করার জন্য হাতে অঢেল সময়, সেটির মূল কারণ তো এটাই। টেস্টের প্রথম দিন ৪.৫৮ রানরেটে ব্যাটিং করেছে বাংলাদেশ, প্রথম ইনিংস শেষে যা ৪.৪৪। দ্বিতীয় ইনিংসে যা বেড়ে অবিশ্বাস্য ৫.৩১!
অনেক পাওয়ার এই টেস্টে জয়টাই শুধু পেতে বাকি। যে জয় হবে ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওই পরাজয়ের মধুর প্রতিশোধ!