স্টেডিয়ামে ঢোকার আগেই দর্শকের চিৎকার শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম। ঠিক শুনছি তো! নেপাল-নেদারল্যান্ডস ম্যাচে এত দর্শক কোত্থেকে আসবে? এলেও কি আর উপমহাদেশের ক্রিকেট–দর্শকের মতো এত হইচই করবে নাকি!
গ্র্যান্ড প্রেইরি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ঢোকার পর তো চোখ ছানাবড়া। এই স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচের দর্শকও একটু চমকে দিয়েছিল। সেদিনেরটা যদি চমক হয়, এদিনেরটা রীতিমতো বিস্ময়।
যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা ম্যাচে প্রায় ভরা গ্যালারি চমকে দিলেও খুব বেশি অবাক করেনি। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী দক্ষিণ এশিয়ান জনগোষ্ঠীই তো এই দেশে ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রেখেছে। মার্কিন মুলুকে বিশ্বকাপ শুরুর এই মহালগ্নের সাক্ষী তো তাঁরা থাকতে চাইবেনই।
কিন্তু এদিন এটা কী দেখছি! নেপাল-নেদারল্যান্ডস ম্যাচে বিরান গ্যালারি দেখব বলে অনুমান এভাবে ধাক্কা খাবে, এটা তো কল্পনাও করিনি। গ্যালারি উপচে পড়ছে দর্শক। হঠাৎ দু–একটা জায়গায় একটু সাদার ছোপ, বাকি সবটাই নীল। নেপালের জার্সি! এত নেপালি কোত্থেকে এল!
দক্ষিণ এশিয়ারই দেশ তো! উপমহাদেশীয় ক্রিকেট–সংস্কৃতির ছাপ সেখানে পড়বেই। দর্শকের আচার-আচরণেও সেটিরই প্রকাশ। হাজার সাতেক দর্শকই ২০ হাজারের মতো আওয়াজ তুলছে। একটু পরপর গ্যালারিতে উঠছে মেক্সিকান ওয়েভ। বিরতিহীন কিচিরমিচির তো আছেই। প্রেসবক্সে ঢুকে যাওয়ার আগে গ্যালারির পেছনে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে দেখতে কিছুক্ষণ সেটি শুনলাম।
কৌতূহল মেটাতে কথাও বললাম চার–পাঁচজনের সঙ্গে। একটা জিনিস কমন। কেউই নেপাল থেকে বিশ্বকাপ দেখতে আসেননি। সবাই যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। পাঁচজনের দুজন তো টেক্সাসেই থাকেন।
সকালে ঘণ্টা চারেক দূরত্বের অস্টিন থেকে গাড়ি চালিয়ে খেলা দেখতে এসেছেন টেকো মাথার যে তরুণ, তাঁর জার্সির পেছনে লেখা SANDEEP। যা অনুমান করেছিলাম, তা-ই। নেপালি লেগ স্পিনার সন্দীপ লামিচানের ভক্ত। ধর্ষণের অপরাধে জেল খাটা সাবেক নেপালি অধিনায়ককে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা না দেওয়ার ব্যাপারে অনড় থাকায় যাঁর এই বিশ্বকাপে খেলা হচ্ছে না।
লামিচানে এত বড় একটা অপরাধ করেছেন, তারপরও তাঁর জার্সি গায়েই খেলা দেখতে চলে এলেন! কথাটা শুনে যেন একটু বিরক্ত, ‘অপরাধ করেছে, শাস্তিও তো পেয়েছে। ইউএস ওকে ভিসা না দিয়ে খুব অন্যায় করেছে। লামিচানের জার্সি পরে আসাটাকে বলতে পারেন আমার প্রতিবাদ। তা ছাড়া এখনো ও-ই আমার হিরো।’
দর্শক দেখে চমকের রেশটা প্রেসবক্সে ঢোকার পরও বজায় থাকল। সেখানেও দেখি সারি সারি নেপালি মুখ। বিশ্বকাপ কাভার করতে নেপাল থেকে এত সাংবাদিক!
একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, সংখ্যাটা ১৪–১৫। দর্শক উন্মাদনায় বাংলাদেশের সঙ্গে মিল পেয়েছিলাম। মিল তো দেখি এখানেও। বিশ্বকাপ তো বটেই, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের যেকোনো সফরে বাংলাদেশের বিশাল সাংবাদিক–বহর অন্য দেশের সাংবাদিকের বিস্ময়ের কারণ হয়। নেপালও তাহলে সেই পথেই হাঁটছে।
মিল আছে আরও। প্রেসবক্সে বসেও পেশাদারত্বের কথা ভুলে গিয়ে নেপালি সাংবাদিকদের সমর্থক বনে যাওয়া মনে করিয়ে দিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের শুরুর দিনগুলোকে। আমরাও তো একসময় এমনই ছিলাম!
মিল খুঁজে পেলাম কথাবার্তায়ও। নেপালের ক্রিকেট সে দেশের মানুষের কী দারুণ সমর্থন পায়—এ কথা বলতেই নেপালের তরুণী সাংবাদিক বললেন, ‘সমর্থন করার দিক থেকেই শুধু আমরা ভালো। খেলায় তো ভালো নই।’
কী আশ্চর্য, বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুরুর দিনগুলোতে বিদেশি কোনো সাংবাদিকের তোলা একই প্রসঙ্গে একই রকম কথা তো আমরাও বলেছি! জনপ্রিয়তায় ফুটবলকে সরিয়ে ক্রিকেটের ১ নম্বর হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গেও যেমন ‘বাংলাদেশ’কে মনে পড়ে যেতে বাধ্য। ফুটবলের দেশ নেপালে কেন ফুটবল আর আগের জায়গায় নেই? নেপালের প্রায় সাংবাদিকই দেখলাম একমত—নেপালের ফুটবল ধ্বংস করেছে দুর্নীতিগ্রস্ত ফুটবল প্রশাসকেরা।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুরুর দিনগুলোর সঙ্গে নেপালের মিলটা এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন দিনের সূচনা বললে সবাই যেমন ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফিতে ফিরে যায়, তেমনি হিমালয়ের দেশ নেপালে ক্রিকেট-সূর্য উদিত হওয়ার দিনক্ষণও সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব।
ঘটনাচক্রে সেটি ছিল আবার বাংলাদেশে যাওয়ার ছাড়পত্র পাওয়ায়। আবুধাবিতে বাছাইপর্ব জিতে ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করে বিজয়ীর বেশে দেশে ফেরেন নেপালি ক্রিকেটাররা। কাঠমান্ডুতে বিজয় র্যালির আয়োজন করা হয়, রাস্তায় ঢল নামে মানুষের। ক্রিকেটারদের জন্য ঘোষণা করা হয় অর্থ পুরস্কার। ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফির সঙ্গে কেমন মিলে যাচ্ছে, দেখুন!
আইসিসি ট্রফি জিতে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করা যেমন বাংলাদেশের হাজারো শিশু-কিশোরের চোখে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল, নেপালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করাও তা-ই করেছে। নেপালের বর্তমান অধিনায়ক রোহিত পৌডেলই যেমন ওই বিশ্বকাপে নেপালকে দেখে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন। বাংলাদেশ যেমন প্রথম বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ড ও পাকিস্তানকে হারিয়েছিল, বাংলাদেশে আয়োজিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও হংকং ও আফগানিস্তানকে হারিয়েছিল নেপাল।
একটু ছেলেমানুষি শোনাতে পারে, তারপরও আরেকটি মিলের কথা না বলে পারছি না। বাংলাদেশের হোম অব ক্রিকেট শেরেবাংলা স্টেডিয়াম মিরপুরে। নেপালের হোম অব ক্রিকেট বলতে পারেন ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় মাঠকে। সেটি কোথায়, জানেন? এখানেও ‘পুর’ কথাটা আছে। কীর্তিপুর!