দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য যা ব্যাটিং–স্বর্গ, সেটাই যেন বাংলাদেশের জন্য মৃত্যুকূপ! হ্যাঁ, ‘মৃত্যুকূপ’ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ আসছে না। শেষবেলায় মিনিট চল্লিশেক ব্যাটিং করেই যেখানে ৩২ রানে ৪ উইকেট হারাতে হয়, সেখানে ব্যাটিং করতে নামা নিশ্চয়ই মৃত্যুর মুখে ঝাঁপ দেওয়ার মতোই।
অথচ এর আগপর্যন্ত জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের উইকেটকে ‘ব্যাটিং–স্বর্গ’ বলেই মনে হচ্ছিল। ৬ উইকেটে ৫৭৫ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে দক্ষিণ আফ্রিকা, তাদের তিন ব্যাটসম্যান পেয়েছেন টেস্টে নিজেদের প্রথম সেঞ্চুরি। সেই উইকেটেই বাংলাদেশ দ্বিতীয় দিন শেষ করেছে ৪ উইকেটে ৩৮ রান করে। প্রায় দুই দিন দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিংয়েই চলে যাওয়ার পরও ৫৩৭ রান পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের সামনে এখন ফলো অনের ফাঁদ, সঙ্গে তৃতীয় দিনেই হেরে যাওয়ার শঙ্কাও।
চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় দিনটা শুরু হয়েছিল তাইজুল ইসলামের আরেকটি ৫ উইকেট পাওয়ার উদ্যাপন দিয়ে। তবে দিন শেষে যা পরিস্থিতি তাতে টেস্টে তাইজুলের ১৪তম ৫ উইকেটের সাফল্য এখন ভুলে যাওয়ার মতোই অবস্থা। পুরো দিনের ‘হাইলাইটস’ বানালে বেশির ভাগ জুড়েই থাকবে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রভাববিস্তারী ব্যাটিং। যার যোগফল—৩ সেঞ্চুরির সৌজন্যে প্রথম ইনিংসে ৬ উইকেটে ৫৭৫ রান করে ইনিংস ঘোষণা। এরপরই আসবে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসের শুরুটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার ছবি।
তাইজুলকে আম্পায়ারের মাথার ওপর দিয়ে মারা ছক্কায় ৭ নম্বরে নামা উইয়ান মুল্ডারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি পূর্ণ হতেই ব্যাটসম্যানদের মাঠে থেকে ডেকে নেন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক এইডেন মার্করাম। ১৫০ বলে অপরাজিত ১০৫ রান করেছেন মুল্ডার।
মিরপুর টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এই টেস্টের প্রথম ইনিংসেও একই আনন্দে মেতেছেন তাইজুল। আগের দিনের দুটির সঙ্গে আজ প্রথম সেশনে নিজের পরপর ৩ ওভারে ৩ উইকেট নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ৫টি উইকেট একাই নিয়ে নেন অভিজ্ঞ এই বাঁহাতি স্পিনার।
দিনের ১৮তম ওভারে তাঁর প্রথম শিকার ডেভিড বেডিংহাম। ওভারের প্রথম বলে ছক্কা মেরে পরের বলে আবারও সে চেষ্টা করেন। তবে এবার তাইজুলের জোরের ওপর করা বলটি ব্যাটে লাগাতে না পেরে ৫৯ রানে বোল্ড হয়ে যান বেডিংহাম, ভাঙে জর্জির সঙ্গে তাঁর ১১৬ রানের জুটি।
জর্জিকে ডাবল সেঞ্চুরি বঞ্চিত করা উইকেটটি তাইজুল নেন তাঁর পরের ওভারে। ইনিংসজুড়েই সুইপ–রিভার্স সুইপ করা জর্জির ১৭৭ রানের ইনিংসটা শেষও হয়েছে সুইপ করতে গিয়ে। তাইজুলের এলবিডব্লুর আবেদনে আম্পায়ার আউট দিলে রিভিউ নিয়েও তা এড়াতে পারেননি জর্জি।
জর্জি ফেরেন দলের রান যখন ৩৯১। নিজের পরের ওভারে এসে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ওখানে রেখেই তাইজুল তুলে নেন নিজের পঞ্চম উইকেট। এবারও এলবিডব্লু—শিকার কাইল ভেরেইনা। ২ উইকেটে ৩৮৬ থেকে আর ৫ রান তুলতেই দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর ৩৯১/৫!
এক সেশনে ৩ উইকেট মানে সেশনটা বাংলাদেশেরই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ওই এক সেশনেই যে দক্ষিণ আফ্রিকা তুলেছে ১০৬ রান! এক দিকে খেলা হচ্ছে রানপ্রসবা উইকেটে, অন্য দিকে বাংলাদেশের নির্বিষ বোলিং।
চার বিশেষজ্ঞ বোলার নিয়ে খেলায় অধিনায়ক নাজমুল হোসেনের হাতে বোলার বেছে নেওয়ার সুযোগও বেশি ছিল না। প্রথম ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার খেলা ১৪৪.২ ওভারের মধ্যে একা তাইজুলকেই করতে হয়েছে ৫২.২ ওভার। টানা বোলিংয়ের একপর্যায়ে মাঠে আঙুলের শুশ্রূষাও করতে হয়েছে তাঁকে। তা সব ‘কন্ডিশন’ই যখন দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানদের অনুকূলে ছিল, তাহলে ৩টি উইকেট পড়ল কী করে? সেগুলো আসলে বাংলাদেশের বোলারদের মারতে গিয়েই দিয়েছেন ব্যাটসম্যানরা।
দিনের দ্বিতীয় সেশনটা তো পুরোই দক্ষিণ আফ্রিকার। এই সেশনে ১১৪ রান এসেছে শুধু রায়ান রিকেলটনের উইকেট হারিয়ে। নাহিদ রানার কিছুটা নিচু হয়ে আসা বল ব্যাটের নিচের দিকে লেগে জমা পড়ে উইকেটকিপার মাহিদুল ইসলামের গ্লাভসে। মধ্যাহ্নবিরতির পর বাকি সময়টায় আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করে সপ্তম উইকেটে ১৫২ রানের জুটি গড়েন মুল্ডার ও সেনুরান মুতুসামি।
দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসের ১৪৪তম ওভারে মুতুসামি পিচের মধ্য দিয়ে দৌড়ানোয় ৫ রান পেনাল্টি নিয়ে ইনিংস শুরু করে বাংলাদেশ। ওই ‘ফ্রি’ ৫ রানসহ বাংলাদেশের ৩৮ রানের মধ্যে ১৩ রানই এসেছে অতিরিক্ত থেকে।
দুঃস্বপ্নের মতো শেষ বেলায় ইনিংসের প্রথম ওভারেই কাগিসো রাবাদার বলে কট বিহাইন্ড ওপেনার সাদমান ইসলাম। পঞ্চম ওভারে তিনে নামা জাকির হাসানও রাবাদার বলেই ক্যাচ দিয়েছেন উইকেটের পেছনে। পরের দুই ওভারে আউট ওপেনার মাহমুদুল হাসান ও নাইটওয়াচম্যান হাসান মাহমুদ।
মুমিনুল হক আর অধিনায়ক নাজমুল হোসেন অবিচ্ছিন্ন থেকে দিন শেষ করে এলেও কাল সকালে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ নিয়েই মাঠে নামতে হবে তাঁদের। প্রথমত ফলো অন এড়ানো, এরপর টেস্টটাকে যতটা সম্ভব দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা। তাতে সফল না হলে এই টেস্ট চতুর্থ দিন সকালের আলো না দেখলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
দক্ষিণ আফ্রিকা ১ম ইনিংস: ১৪৪.২ ওভারে ৫৭৫/৬ (ডি.)
(ডি জর্জি ১৭৭, স্টাবস ১০৬, মুল্ডার ১০৫*, মুতুসামি ৬৮*, বেডিংহাম ৫৯; তাইজুল ৫/১৯৮, রানা ১/৮৩)।
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৯ ওভারে ৩৮/৪
(মাহমুদুল ১০, মুমিনুল ৬*, নাজমুল ৪*, হাসান ৩, জাকির ২, সাদমান ০; রাবাদা ২/৮, মহারাজ ১/৪, প্যাটারসন ১/১৫)।
* ২য় দিন শেষে বাংলাদেশ ৫৩৭ রানে পিছিয়ে।