সাকিবকে কেন তাঁদের এত পছন্দ
‘আজ বাংলাদেশেরই জেতা উচিত’—ভারতের এক সাংবাদিকের মুখে কথাটা শুনে অবাক হলাম।
প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে তখনো বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ চলছে। তানজিম হাসান সাকিব শুরুতেই দুই উইকেট তুলে নেওয়ায় বাংলাদেশের জয়ের ভালো সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু একজন ভারতীয় সাংবাদিক কেন নিজ দেশ ফেলে প্রতিপক্ষ দেশের জয় কামনা করবেন!
কৌতূহল দমিয়ে না রেখে জানতে চাইলাম, ‘এটা কেন বলছেন?’ তিনি বললেন, ‘নইলে সাকিবের প্রতি অবিচার হয়ে যাবে। ব্যাটিংয়ে ওরকম বাজে শুরুর পরও বাংলাদেশ যে এখন এই জায়গায়, সে তো ওর জন্য! সাকিব আশিটা রান করল, এরপরই তো অন্যরাও ভালো ব্যাটিং করল! সাকিব ওই ব্যাটিং না করলে এটা হতো?’
কলকাতার এই সাংবাদিক সাকিবের বিরাট ভক্ত। কাল তো সাকিবের ব্যাটিং আর দল পরিচালনায় এতটাই মুগ্ধ হলেন যে শুধু সাকিবের জন্যই বাংলাদেশের জয় চাইতে লাগলেন। এখন অবশ্য তাওহিদ হৃদয় আর তানজিমেরও ফ্যান হয়ে গেছেন প্রবীণ এই সাংবাদিক। ব্যাটসম্যান হৃদয়কে তাঁর মনে হয় ঠান্ডা মাথার খুনি। তানজিমের মধ্যে এক ম্যাচেই দেখতে পেয়েছেন বড় বোলার হওয়ার সম্ভাবনা।
মজার ব্যাপার হলো ভারত, শ্রীলঙ্কায় এ রকম অনেক সাংবাদিকই আছেন, যাঁরা শুধু সাকিবের জন্যই বাংলাদেশের জয়ে খুশি হন। কালকের বাংলাদেশ–ভারত ম্যাচটা প্রেসবক্সে শ্রীলঙ্কার যে সাংবাদিকের পাশে বসে কাভার করলাম, তিনিও দেখেছি বাংলাদেশ ভালো কিছু করলেই উত্তেজিত হয়ে উঠছেন। একপর্যায়ে বলে ফেললেন, ‘আজ কিন্তু আমি বাংলাদেশকে সাপোর্ট করছি! সাকিবের বাংলাদেশ।’
সাকিব বাংলাদেশের সবচেয়ে নন্দিত এবং অনেক সময় নিন্দিত ক্রিকেটারও। গত পরশুর কথাই ধরুন। টিম হোটেলে ভারত ম্যাচ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সাকিবের কথা বলার ধরন ভারতীয় সাংবাদিকদেরও কাছেও কেমন জানি লেগেছে। তাঁদের দু–একজন জানতে চেয়েছেন, ‘ও মাঝেমধ্যে এ রকম করে কেন!’ জিজ্ঞাসা না বলে অনুযোগ বলা ভালো। কারণ, তাঁদের সেই জিজ্ঞাসার মধ্যেও কেমন যেন একটা প্রশ্রয়, কাছের মানুষ হঠাৎ মন খারাপ করিয়ে দিলে যে অনুভূতি হয়, সেই অনুভূতি। সাকিবের সঙ্গে এ নিয়ে তাঁদের সরাসরি কথা বলার সুযোগ হলে হয়ত এভাবেই বলতেন, ‘তোমার কাছ থেকে তো ভাই এটা আশা করিনি...।’
এমন প্রশ্নের কি উত্তরইবা দেয়া যায়! দেশের গৌরব যেহেতু, সাকিবকে আড়াল দেয়ার চেষ্টা করি, ‘করুক না! কথা যে সব সময় আমাদের মন মতো হতে হবে—এমন তো কথা নেই। খেলাটা ঠিকমতো খেললেই হয়। ও তো সেটা খেলে।’ অবশ্য যাঁদের মনে ওই প্রশ্ন, তাঁদের কেউ কেউ আবার উত্তরটা তাঁদের মতো করে অনুমান করে নেন। যেন সাকিবের মনের ভাষা পড়তে পারছেন তাঁরা, ‘ওর হয়ত বড় কোনো অতৃপ্তি রয়ে গেছে। ওর মতো বড় মাপের ক্রিকেটারের বিশ্ব ক্রিকেট থেকে যা পাওয়া উচিত, তা সে পায়নি। সে ক্ষোভটাই মাঝেমধ্যে ফুঁসে ওঠে।’
সাকিব কী পেয়েছেন আর কী পাননি, সেটা তিনিই সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন। আমরা শুধু এটুকুই বলতে পারি যে বাংলাদেশ একজন সাকিবকে পেয়েছে। ভারতের মতো দলকে যিনি ঘোষণা দিয়ে হারানোর সাহস এবং আত্মবিশ্বাস রাখেন। ভারত যদিও এ ম্যাচে নিয়মিত অনেককে খেলায়নি, কিন্তু বাংলাদেশকে তো ম্যাচটা ভালো খেলেই জিততে হয়েছে। আর সেই ভালো খেলায় ম্যান অব দ্য ম্যাচ সাকিবের অগ্রণী ভূমিকা সবাই দেখেছেন।
অথচ এ ম্যাচের আগের কয়েক দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাকিব পরিণত হয়েছিলেন ট্রলের পাত্রে। অধিনায়ক হয়েও শ্রীলঙ্কা ম্যাচের পর তিনি তিন দিনের ছুটিতে ঢাকায় চলে গিয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমের খবর, এ সময় সাকিব নির্বাচন করার আগ্রহের কথা জানাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন, পণ্যদূত হিসেবেও নাকি কিছু অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাকিবকে নিয়ে ট্রলের উপাদান ছিল সেগুলোই।
আবার এই সাকিবই যখন ভালো খেলে বাংলাদেশকে জয়ের আনন্দে ভাসালেন, ফেসবুকের ভাষা তখন বদলে গেল। নিন্দার জায়গা নিয়ে নিল ভালোবাসা। সাকিবের যেমন সমালোচকের অভাব নেই, এ রকম সময়েও সাকিবের পাশে লোকের অভাব হয় না। সাকিব যে বাংলাদেশের কত বড় সম্পদ, সেটাই তখন প্রচার হতে থাকে।
কাল রাতে সাকিব যখন ভারতকে হারিয়ে দিলেন, তাঁর পক্ষ নিয়ে ট্রলের জবাব দিতে লাগলেন ‘সাকিবিয়ান’রা। ফেসবুকে একজন দেখলাম রসিকতা করে জানতে চেয়েছেন, ‘সাকিব আবার কবে শো রুম উদ্বোধন করতে যাবেন?’ অর্থাৎ সাকিব এ রকম কিছু করলে সমালোচিত হন। এরপর জবাবটা দেন ব্যাটে-বলে। আর তাতে জিতে যায় বাংলাদেশ। তাহলে তো সাকিবের দোকান উদ্বোধন করে বেড়ানোই ভালো!
ডমিনিকায় সাকিবের এক ভক্ত সাকিবের নামে রেখেছেন সন্তানের নাম। সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সাকিবের সঙ্গে সেই ভদ্রলোক নিজের ছেলেকে দেখাও করিয়ে নিয়েছেন। এবার কলম্বোতেও পাওয়া গেল শ্রীরানী জয়াবিক্রমা নামে ৮০ বছর বয়স্কা এক প্রৌঢ়াকে, যিনি একই সঙ্গে বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব এবং পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজমের বিশাল ফ্যান। বাসায় সাকিবের বড় ছবি নাকি বাঁধাই করে রেখেছেন। পরশু টিম হোটেলে এসে সাকিব, বাবরের সঙ্গে ছবি তুলেছেন, তাঁদের অটোগ্রাফ নিয়েছেন। সাকিবকে কেন এত পছন্দ জানতে চাইলে ভদ্রমহিলার সহজ–সরল উত্তর, ‘কারণ, সাকিব খুব ভালো খেলে, দারুণ এক ক্রিকেটার সে।’
ভিনদেশি ভক্তদের কাছে সাকিবের খেলাটাই আসল। ব্যক্তি সাকিব, ব্যবসায়ী সাকিব তাঁদের বিবেচনার বাইরে। বাংলাদেশে স্বাভাবিকভাবেই চিন্তাটা ভিন্ন। দেশের সবচেয়ে বড় তারকাকে সব দিক দিয়ে সেরা হতে হবে, সব দিক দিয়ে ‘আইকন’ হতে হবে, তাঁর মধ্যে এক ফোঁটা কালির দাগ থাকতে পারবে না—এই হলো প্রত্যাশা।
সমস্যা হলো সাকিবও তো রক্ত–মাংসে গড়া মানুষ। ভুলভ্রান্তি তাঁরও থাকবে। ভক্তদের মনে সেসব কখনো কখনো রক্তক্ষরণের কারণ হবে, সেটাও অস্বাভাবিক নয়। আবার সাকিব ‘সাকিব’ বলেই জানেন, সেই রক্তক্ষরণের ওষুধটা কী, কীভাবে বদলে দেওয়া যায় ফেসবুকের ভাষা। ব্যাট হাতে ভালো ইনিংস, বল হাতে ভালো বোলিং, ক্রিকেটার হিসেবে ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্স।
তখন আর স্বীকার না করে উপায় থাকে না যে নিন্দিত–নন্দিত যাই হোন, দিন শেষে সাকিবই সেরা।