সামনে কী হচ্ছে, বেন স্টোকসের সেটি দেখার সামর্থ্য যেন ততক্ষণে ফুরিয়ে গেছে। সিডনিতে নিউ ইয়ার টেস্টে বাকি কয়েকটি বল, ক্রিজে স্টুয়ার্ট ব্রডের সঙ্গী শেষ ইংলিশ ব্যাটসম্যান জেমস অ্যান্ডারসন। অ্যাশেজের চতুর্থ টেস্ট, তার আগেই তিন টেস্ট হেরে সিরিজ হার নিশ্চিত হয়ে গেছে ইংল্যান্ডের। সে টেস্টে ড্র ইংল্যান্ডের জন্য সান্ত্বনা পুরস্কারের বেশি কিছু নয়।
অ্যান্ডারসন-ব্রড সে টেস্ট ড্র করতে পেরেছিলেন। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলেন যেন স্টোকসরা। সে ড্র-ই তখন ইংল্যান্ডের জন্য ছিল জয়ের সমান।
ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে এগোল, একেবারে বছরের শেষ মাস। রাওয়ালপিন্ডিতে প্রায় মরা ম্যাচে ড্র ছাড়া অন্য কোনো ফল মনে হচ্ছিল প্রায় অসম্ভব। টেস্ট ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান ওঠা সে ম্যাচ জিততে শেষ সেশনে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল ৫ উইকেট। স্টোকসদের প্রতিপক্ষ তখন শুধু পাকিস্তান নয়, কমে আসতে থাকা আলোও। সেখানেই তারা পেল রোমাঞ্চকর এক জয়।
স্টোকস আবারও ঘোষণা দিলেন, ড্র কোনো অপশন হতে পারে না। বছরের শুরুতে সিডনি আর শেষে রাওয়ালপিন্ডি—এর মাঝে যে বদলে গেছে ইংল্যান্ডের টেস্ট খেলার ধরনই! যে ধরন ছোঁয়াচে, যে ধরন নিয়ে কথা ওঠে বাংলাদেশ-ভারত সিরিজেও। সীমিত ওভারের পর এবার যেন টেস্ট ক্রিকেটের ধারা বদলে দেওয়ার মিশনে নেমেছে ইংল্যান্ড।
২০২২ সাল তো আদতে বেন স্টোকসদেরই বছর!
২.
এ বছর প্রথম ৫টি টেস্টে ইংল্যান্ডের ফল ছিল এমন—৩ ড্র, ২ হার। জো রুট অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিলেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক রব কি কোচ হিসেবে আনলেন ব্রেন্ডন ম্যাককালামকে, যাঁর প্রথম শ্রেণিতেই কোনো দলকে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা ছিল না। অধিনায়ক বেন স্টোকস, গত বছর যিনি অনির্দিষ্টকালের বিরতিতে গিয়েছিলেন ক্রিকেট থেকেই। অধিনায়কত্বের চাপ স্টোকসের ক্যারিয়ারে কেমন প্রভাব ফেলে, শঙ্কা ছিল তেমনও।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে ইংল্যান্ড ২৯৯ রান তাড়া করল ৫০ ওভারে। ম্যাককালামের ডাকনাম অনুসারে ইংল্যান্ডের এই খেলার ধরন হয়ে গেল ‘বাজবল’। তবে কথা উঠল, লড়াইটা হবে ভারতের বিপক্ষে। এজবাস্টনে ভারত পাত্তা পেল না। ‘দক্ষিণ আফ্রিকার পেস বোলিং আক্রমণের বিপক্ষেই আসল চ্যালেঞ্জ’, লর্ডসে প্রথম টেস্ট ইংল্যান্ড হারলও। ওল্ড ট্রাফোর্ড ও বার্মিংহামে প্রোটিয়ারা টের পেল, স্বাদ পেল নতুন ইংল্যান্ডের। বছর শেষে যেটির শিকার পাকিস্তান। ১৭ বছর পর পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে ইংল্যান্ড দেখাল নতুন কিছু।
স্টোকসের অধিনায়কত্বে ইংল্যান্ড খেলেছে ১০টি টেস্ট। ফল—৯ জয়, ১ হার। ‘ড্র কোনো অপশন নয়।’
ইংল্যান্ডের পর পাকিস্তানে গেল নিউজিল্যান্ড। প্রথম টেস্টে ১৩৭ রানে এগিয়ে থাকা পাকিস্তান ইনিংস ঘোষণা করে দিল ১ উইকেট বাকি থাকতেই। জয়ের জন্য ১ ঘণ্টায় ১৩৮ রান করতে হবে নিউজিল্যান্ডকে, ৭.৩ ওভারেই তারা তুলে ফেলল ৬১ রান।
বাগড়া দিল কমে আসা আলো। তবে তার আগে উজ্জ্বল হয়ে থাকল বাবর আজমের ওই ইনিংস ঘোষণা, যাতে পরিষ্কার বার্তা—ড্র কোনো অপশন নয়।
৩.
টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে হিসাব–নিকাশটা কবে থেকে মেটাতে চান, স্টোকস সেটি নিজেই বলতে পারবেন ভালো। তবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সঙ্গে তাঁর হিসাব মেটানোর ব্যাপারটা সেই ২০১৬ সাল থেকে, ইডেন গার্ডেনসের ফাইনালে ওই চার ছক্কা! ক্রিকেট থেকে বিরতিতে ছিলেন বলে গত বছরের বিশ্বকাপে খেলেননি, এবারও দলে তাঁর ভূমিকা নিয়ে ছিল প্রশ্ন।
এল ফাইনাল। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে প্রতিপক্ষ পাকিস্তান, ‘কুদরাত কা নিজাম’ বা প্রকৃতির খেয়ালে ভর করে যারা দেখাচ্ছিল অন্য রকমের এক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। আর এ বিশ্বকাপ দেখাচ্ছিল একের পর এক অঘটন। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের অন্যতম আর্দ্র গ্রীষ্ম, যেখানে গরমের চেয়ে বেশি ঠান্ডা। সে আবহাওয়ায় কখনো জিম্বাবুয়ের কাছে হারে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা থমকে যাচ্ছে নামিবিয়ায়, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আটকে যাচ্ছে স্কটল্যান্ডের কাছে, আয়ারল্যান্ড কখনো ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কখনো ইংল্যান্ডকে থামিয়ে মেটাচ্ছে কিসের যেন দেনা।
ভারতকে টি-টোয়েন্টি পাঠ দিয়ে ফাইনালে আসা ইংল্যান্ড মেলবোর্নে তখন চাপে থরথর। সেখান থেকে বের হয়ে আসা ওই স্টোকসেই। ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালের পর ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনাল—একই সঙ্গে সীমিত ওভারের দুটি বৈশ্বিক ট্রফির মালিক ইংল্যান্ড, যে শিরোপার সমীকরণ থেকে স্টোকসকে বাদ দেওয়ার উপায় নেই কোনোই!
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে স্টোকসের দায়মোচন হয়েছে হয়তো তাতেই। স্টোকস ছাড়াও এ বছর প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখেছেন আরও কয়েকজন। টি-টোয়েন্টি সংস্করণ দিয়ে প্রায় তিন বছরের সেঞ্চুরি খরা কাটিয়েছেন বিরাট কোহলি, বছরের শেষে শততম টেস্টে গর্জন করেছেন ডেভিড ওয়ার্নার, করাচিতে কেইন উইলিয়ামসন দেখিয়েছেন—ফুরিয়ে যাওয়া থেকে অনেকটাই দূরে দাঁড়িয়ে তিনি।
আর সিকান্দার রাজায় ভর করে ফিরে এসেছে জিম্বাবুয়ে। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, আয়ারল্যান্ড—জিম্বাবুয়ে দেখিয়েছে দাপট। আর পারফর্ম করে গেছেন রাজা। ফল—আইসিসির বর্ষসেরা তালিকার সবচেয়ে ‘কমন’ নামটা এ অলরাউন্ডারের।
৪.
স্টোকস ওয়ানডে থেকে অবসরে গেছেন। আদতে আর ফিরে আসবেন কি না, নিশ্চিত নয়।
ক্রিকেটের ঠাসা সূচিতে কমছে ফাঁক। দক্ষিণ আফ্রিকা, সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে ঠেকছে আইপিএলের টাকার ছোঁয়া। টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা তো নতুন নয়, ওয়ানডে ক্রিকেট আর দ্বিপক্ষীয় কিছু সিরিজের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্নটা জোরালো হচ্ছে।
তবে স্যাম কারেন গড়ছেন আইপিএলের নতুন রেকর্ড, ক্যামেরন গ্রিনকে নিয়ে পড়ছে টানাটানি। আরেকবার কোটিপতি হয়ে যাচ্ছেন স্টোকস নিজেও।
হয়তো টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎটা স্টোকসদের হাতেই। আর ২০২৩ সালে ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কী, সেটি তো আপনি বুঝে যাবেন নতুন বছরের শেষেই।