সরফরাজ–জুরেলের টেস্ট অভিষেকে লেখা বাবা–মায়ের জয়ও

ভারতের হয়ে টেস্ট অভিষেকের টুপি হাতে ধ্রুব জুরেল (বাঁয়ে) ও সরফরাজ খানবিসিসিআই

‘রাত পোহাতে সময় লাগে। কিন্তু সূর্য তো আর আমার ইচ্ছায় উঠবে না।’

পোড়-খাওয়া জীবন নাকি কিছুটা হলেও দার্শনিকসুলভ হয়। আর সব মানুষের জীবনেই এমন কিছু না কিছু পোড়া দাগ থাকে। নওশাদ খানের ব্যক্তিগত জীবনেও হয়তো আছে। কিন্তু যে পোড়া দাগের জ্বালায় তিনি ওপরের কথাটা বলেছেন, সেটি নিজেকে নিয়ে নয়। দাগটা তাঁর ছেলের। সেই কষ্টে পুড়েছেন বাবাও। ধারাভাষ্যকক্ষে বসে আকাশ চোপড়াও সেই পোড়া দাগেরই ঘ্রাণ পেলেন। বোঝা গেল, দাগটা এখনো সতেজ, তবে এখন হয়তো মিলিয়ে যাবে দ্রুতই।

টেস্টের টুপি পেলে সেটি বাবাকে উৎসর্গ করব। কারণ তিনিই আমার নায়ক। যখনই দ্বিধায় ভুগি, তিনি সঠিক পথের দিশা দেন।
ধ্রুব জুরেল

ঘ্রাণ? পোড়ার গন্ধ তো কটু। নওশাদের জীবনে এখন সেটাই ধরা দিয়েছে ঘ্রাণ বা সুবাস হয়ে। সন্তানকে তাঁর যোগ্যতাবলে তাঁকে যে জায়গায় দেখতে চান, সে জন্য অন্য সব বাবা-মায়ের মতোই এই এক জীবনে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং তারপরও যখন স্বপ্ন পূরণ হয় না, তখন ভেতরে–ভেতরে কোথায় যেন সব পুড়ে যায়। কিন্তু বাবা-মায়েরা সন্তানের জন্য হাল ছাড়তে জানেন না। অপেক্ষায় অপেক্ষায় ধৈর্যের শেষ বালুঘড়িতে এসে যখন হুট করেই সেই স্বপ্ন পূরণ হয়, তখন কিন্তু সেই পোড়া দাগ থেকেই সুখের ঘ্রাণ আসে। বুকে সুখের ব্যথা বাজে!

সরফরাজ টেস্টে অভিষেকের টুপি পাওয়ার পর তাঁকে বুকে জড়িয়ে নেন বাবা নওশাদ
এএফপি

আজ রাজকোটে বড় ছেলে সরফরাজ খানের ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক অভিষেকের লগ্নে নওশাদও এমন ঘ্রাণ পেয়েছেন। তাই ডাক পড়েছিল ধারাভাষ্যকক্ষেও। ছেলের এমন লগ্নে বাবা হিসেবে কেমন লাগছে, অভিষেক একটু দেরিতেই হলো কি না—এসব জানতে। তখনই এই রূপক উদাহরণটা দেন নওশাদ। কথাটা ভাঙলে দাঁড়ায়—‘রাত’ বলতে জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার অপেক্ষা। নির্বাচকদের ইচ্ছায় সেই অপেক্ষা শেষে সরফরাজ সূর্য হয়ে উদিত হলেন জাতীয় দলে।

কিংবা আরেক ‘উদিত সূর্য’ ধ্রুব জুরেল। এই উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানেরও আজ অভিষেক হলো ভারতের জার্সিতে। সরফরাজের মতো অপেক্ষার উইকেটে তাঁকে ‘টেস্ট’ খেলতে হয়নি। কিন্তু সরফরাজের জুরেলের গল্পের মিলটা তাঁর বাবা ও মায়ের ত্যাগে। দিনেশ কার্তিক তাঁর হাতে টেস্টের টুপি তুলে দিয়ে বলছিলেন, ‘তোমার বাবা নিশ্চয়ই এই দৃশ্য দেখছেন...।’

আরও পড়ুন

জুরেলের বাবা নেম সিং জুরেল কারগিল যুদ্ধের বীর। খাড়া পাহাড়ে (সাফল্য) উঠতে কতটা সাধনা, কতটা ত্যাগ লাগে, তিনি জানেন। ৫ বছর বয়সে আগ্রায় বাসের চাকার তলে পড়েছিল তাঁর ছেলের বাঁ পা। ক্রিকেটার হওয়ারই কথা ছিল না। বাবাও চাননি শুরুতে। ১৪ বছর বয়সী জুরেল বাবাকে ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম কিনে দিতে বলায় ছেলেকে পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন। কারণ, সরকারি চাকরি চাই। বাবা বাস্তবতাটা জানেন। কিন্তু মা? আহা, পৃথিবীর সব মায়েরাই বুঝি এমন!

বাবার শাসনে সন্তানের স্বপ্ন পোড়ার শঙ্কায় জুরেলের মা গলার সোনার চেইন বিক্রি করে দিয়েছিলেন। জুরেল খাড়া পাহাড়ে যত উঠেছেন, বাবার মনটাও তত নরম হয়ে এসেছে। আর ছেলে সেই কোমল-কঠোর বাবাকেই ‘নায়ক’ মেনেছেন—বেশির ভাগ সন্তানই যেমন মানে! সম্ভবত বাবারা সব সন্তানের জীবনেই প্রথম ‘সুপারহিরো’। জুরেল বিসিসিআইয়ের সাইটে বলেছেন, ‘টেস্টের টুপি পেলে সেটি বাবাকে উৎসর্গ করব। কারণ তিনিই আমার নায়ক। যখনই দ্বিধায় ভুগি, তিনি সঠিক পথের দিশা দেন।’ আর মা? মায়েদের অজর, অমর অক্ষয় সব অবদান বলে তাঁদের হালকা করার মতো দুঃসাহস কোন সন্তানের হয়!

বাবা–মা, বোন এবং অন্যান্যদের সঙ্গে ধ্রুব জুরেল
ধ্রুব জুরেলের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট

হয় না। তাই হয়তো আন্তর্জাতিক অভিষেকের আগে সরফরাজ মা-বাবার ত্যাগ নিয়ে কোনো কথাই বলেননি। বলেছেন অনিল কুম্বলে, তাঁর হাতে টেস্টের টুপি তুলে দেওয়ার সময়। ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের পাহাড় বানিয়েও যখন ডাক পাচ্ছিলেন না, তখনো তাঁর ধৈর্য ধরা এবং তাতে বাবার প্রেরণা—কুম্বলে সবই একটু একটু করে বলেছেন। তবে পুরোটা পড়া গেল নওশাদের চোখের জলের ভাষায়। কুম্বলে তাঁর ছেলের হাতে টুপিটা তুলে দেওয়ার সময় কাঁদছিলেন নওশাদ।  

‘আমি ওর (অর্জুন) চেয়ে সৌভাগ্যবান। কারণ, আমার বাবা পুরো দিনটা আমার সঙ্গে কাটাতে পারে, যেটি অর্জুনের বাবা পারে না।’
সরফরাজ খান

যিনি আসলে সরফরাজের জন্য একের ভেতর তিন—বাবা, কোচ ও মেন্টর। নেটে ছেলেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থ্রো-ডাউন করে গেছেন। সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন বিভিন্ন ম্যাচে। ছেলেকে ক্রিকেটার বানাতে পারিবারিক অনুষ্ঠান পর্যন্ত বর্জন করতে বলেছেন। ছেলে সেটা করেছেনও। বাকি সব বাদ দিয়ে ভোরে উঠে নেটে বাবার থ্রো-ডাউন, ধমক-ধামক এবং পরামর্শের সিঞ্চনে সরফরাজ আজ এত দূর! ম্যাচ না থাকলেও নওশাদ দুই ছেলেকে দিয়ে প্রতিদিন ছয় থেকে সাত ঘণ্টা করে অনুশীলন করিয়েছেন। এর প্রতিদান সরফরাজের পক্ষে দেওয়া অসম্ভব। তবে ২০২২ সালে রঞ্জিতে সেঞ্চুরির পর একবার চেষ্টা করেছিলেন।

দেশের হয়ে সন্তানের টেস্ট খেলার টুপিতে চুমু খাচ্ছেন নওশাদ খান। আজ তাঁর আনন্দের দিন
এক্স

জাতীয় দলে সুযোগ পাবেন কি না, তখন ঠিক নিশ্চিত ছিলেন না। তাই হয়তো রঞ্জির শতকই উৎসর্গ করে বলেছিলেন, ‘বাবা না থাকলে আমার ক্যারিয়ারই শেষ হয়ে যেত।’ সরফরাজ এখন নিশ্চয়ই আরও বড় কিছু উৎসর্গ করতে চান বাবাকে। তাঁর হাতের টেস্টের টুপিতে পরম তৃপ্তি ও ভালোবাসার চুমু এঁকেছেন বাবা। সেই টুপি ঘিরে প্রত্যাশার প্রতিদানে তো বাবাই আসবেন সবার আগে। সেই বাবা—জুনিয়র পর্যায়ের এক ম্যাচে অর্জুন টেন্ডুলকারের (শচীন টেন্ডুলকারের ছেলে) সঙ্গে একটি ম্যাচ খেলার পর যাঁর কাছে মনের সব আক্ষেপ উগরে দিয়েছিলেন সরফরাজ, ‘আব্বু, অর্জুনের কী সৌভাগ্য! গাড়ি, আইপ্যাড থেকে সব রকম বিলাসিতা আছে ওর জীবনে।’

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নওশাদ নিজেই এ ঘটনা উল্লেখ করে বলেছিলেন, তখন তাঁর খুব অসহায় লেগেছিল। কিন্তু ছেলে এরপর যা বলেছিল, সেটিতে নিশ্চয়ই মন ভরে গেছে তাঁর, ‘কিন্তু আমি ওর (অর্জুন) চেয়ে সৌভাগ্যবান। কারণ, আমার বাবা পুরো দিনটা আমার সঙ্গে কাটাতে পারে, যেটি অর্জুনের বাবা পারে না।’
এই যে ছেলের সঙ্গে নওশাদের সময় কাটানো, জুরেলের মায়ের সোনার চেইন বিক্রি—সবই সন্তানদের জন্য। তাঁদের সাফল্যের শিকড়ে তো বাবা-মায়েরই ত্যাগ-তিতিক্ষার গল্প লেখা।

আরও পড়ুন