প্যাট কামিন্সের অন্য ভুবন: পরিবেশ আন্দোলন ও রাজনীতিতে আসার সম্ভাবনা

অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক প্যাট কামিন্স, যিনি যুক্ত পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গেএএফপি

ডেভিড পোকোকের মতে, প্যাট কামিন্স ‘আমাদের সময়ের নেতা’, ‘অস্ট্রেলিয়ানদের যাঁকে নিয়ে বাড়তি গর্ব অনুভব করা উচিত’।

কামিন্স অস্ট্রেলিয়াকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন, সাফল্যের দিক দিয়ে দারুণ একটি বছর কাটিয়েছেন। তবে পোকোকের পরিচয়টা জানা থাকলে কামিন্সকে নিয়ে করা তাঁর প্রশংসা অন্য একটি মাত্রা পায়।

পোকোক সাবেক রাগবি খেলোয়াড়। অবসর নেওয়ার পর যোগ দিয়েছেন রাজনীতিতে, ইতিহাস গড়ে হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার স্বতন্ত্র একজন সিনেট সদস্য। ফলে অস্ট্রলিয়ার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কামিন্সকে নিয়ে করা পোকোকের প্রশংসা যে শুধুই ক্রিকেট ঘিরে নয়, সেটি অনুমান করাই যায়। তাতেই বেরিয়ে আসে কামিন্সের আরেকটি দিক।

তবে সবাই পোকোকের মতো কামিন্সের এমন প্রশংসা করেন না। যে কারণে পোকোক কামিন্সকে তাঁদের ‘সময়ের নেতা’ বলছেন, সে কারণেই অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ককে সমালোচনাও শুনতে হয় অনেক। সে ‘সমালোচনা’ মাঠের বাইরে তাঁর কর্মকাণ্ডের কারণে। কী সেই কর্মকাণ্ড? কামিন্স পরিবেশবাদী একজন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বেশ সরব। তাঁর সমালোচকেরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামও দিয়েছেন তাঁকে। তাঁকে ডাকা হয়েছে ‘অতি বামপন্থী’, ‘জলবায়ু ভাঁড়’, ‘ক্যাপ্টেন ওক (কোনো বৈষম্য বা কুসংস্কারবিরোধী কেউ)’ এমন সব নামে।

সেই সব সমালোচকের মতে, কামিন্সের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ থাকা উচিত ক্রিকেটেই, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হিসেবে তিনি হবেন অরাজনৈতিক। কিন্তু কামিন্স আরেকবার বললেন, কিছু ব্যাপারে নিজের মনোভাব প্রকাশে বিরত থাকবেন না তিনি, পিছপা হবেন না নিজের মত তুলে ধরতেও।

এবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অস্ট্রেলিয়ার ৩০ বছর বয়সী অধিনায়ক এসব সমালোচনা প্রসঙ্গে সম্প্রতি বলেছেন, ‘অবশ্যই এগুলো আপনাকে থামতে বাধ্য করবে, এরপর ভাবাবে—আপনি যা করছেন, যেভাবে করছেন, সেটিই ঠিক পন্থা কি না। হয়তো এটি আপনাকে বদলে দেবে অথবা আমার সঙ্গে যা হয়েছে, এর মাধ্যমে আমার দৃষ্টিভঙ্গি আরও সুদৃঢ় হয়েছে যে এগুলো ভালো দিক।’

আরও পড়ুন

এরপর তিনি বলেন, ‘জানেন তো, যদি এ ব্যাপারে শক্ত না থাকি, একটা উচ্চকিত কিন্তু ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিয়ে যাই, তাহলে সেটি ভালো কিছু হবে না।’

পোকোকের সঙ্গে পরিবেশ আন্দোলনে কাজ করেছেন কামিন্স। তাঁর প্রশংসাকে তিনি কীভাবে দেখেন, সে সম্পর্কে তেমন কিছু বলতে চাননি। তবে কামিন্স জানেন, অতীতের কোনো অস্ট্রেলিয়া অধিনায়কের চেয়ে তিনি আলাদা। তাঁর মতে, ‘প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি পৃথিবীকে ভিন্নচোখে দেখতে শুরু করবেন, নিজের কথা ভাববেন। অধিনায়ক হিসেবে আপনার প্রভাব হয়তো আরও বাড়বে। আপনি জনগণের চোখে বেশি করে পড়বেন। তবে এগুলো আসলে নতুন কিছু নয়।’

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে প্যাট কামিন্স, আহমেদাবাদের ফাইনালে

নতুন না হলেও পার্থক্য তো আছেই। কামিন্স বলেন, ‘আমার মনে হয় পৃথিবীতে সব সময়ই কিছু না কিছু ছিল। হয়তো ২০, ৩০, ৪০ বছর আগে যেভাবে দেখা হতো, এখন ভিন্নভাবে দেখা হচ্ছে।’
কামিন্স করতে চান ভিন্ন কিছুই। এর আগে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের সময় এর পক্ষে কথা বলেছেন, হাঁটু গেড়ে একাত্মতাও প্রকাশ করেছে তাঁর দল। একসময় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম স্পনসর ছিল আলিন্টা এনার্জি, যে কোম্পানির সঙ্গে নৈতিক দিক দিয়ে সম্পর্ক থাকা উচিত নয় তাদের—এমন কথাও বলেছিলেন কামিন্স।

এরপর দুই পক্ষের চুক্তি নবায়নও করা হয়নি, যদিও তাতে কামিন্সের মন্তব্যের কোনো প্রভাব নেই বলে জানানো হয়েছিল দুই পক্ষ থেকেই। অবশ্য কামিন্স ‘ক্রিকেট ফর ক্লাইমেট’ নামের সংস্থার সঙ্গে কাজ করেন, যারা স্থানীয় ক্লাবগুলোয় সোলার প্যানেল বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

আরও পড়ুন

মাঠের বাইরে এমন কাজ কামিন্সকে প্রশংসার সঙ্গে সমালোচনাও এনে দিয়েছে। মাঠেও তাঁকে নিয়ে ছিল সমালোচনা। কোনো ফাস্ট বোলারের অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়ক হওয়া উচিত নয়, জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে সরাতে ‘আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন’—এমন অনেক কথাই প্রচলিত আছে।

দিন শেষে সমালোচনা তো ছুঁয়ে যাবেই। কামিন্সকেও যায়। কীভাবে সেগুলো সামলান, সিডনি মর্নিং হেরাল্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি তিনি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে এগুলো খুবই হতাশার। মনে হবে যে গিয়ে ব্যাখ্যা করি, কেন ওই কাজটি করেছি। তবে প্রতিবার যদি এমন করতে চান, তাহলে আসলে দিনে এক মিনিটও অবশিষ্ট থাকবে না আপনার!’

এ বছর মাকে হারিয়েছেন প্যাট কামিন্স
ইনস্টাগ্রাম

অবশ্য টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ও বিশ্বকাপ জয়, ইংল্যান্ডের মাটিতে অ্যাশেজ ড্র করা—কোনো অধিনায়কের এক ক্যারিয়ারের অর্জন মাস ছয়েকের মধ্যেই পাওয়া হয়ে গেছে কামিন্সের। অন্তত অধিনায়ক কামিন্সকে ঘিরে যে সংশয় বা সমালোচনা, তার অনেকটাই যে মিলিয়ে গেছে, সেটি নিশ্চিতই।

তবে সবই পাওয়া হয়ে গেছে, তা তো নয়। রাজনীতিতে কি কিছু পাওয়ার আছে তাঁর? ক্যারিয়ার শেষে পোকোকের পথ অনুসরণ করে রাজনীতিতে আসার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে হাসতে হাসতে কামিন্স বলেন, ‘আহ, আপনি হয়তো কখনোই একেবারেই কোনো কিছুকে না করে দেবেন না। কিন্তু সম্ভবত না (আসব না)। আমি এটা ডেভিড ও অন্য অনেকের ওপরই ছেড়ে দিতে চাই।’

আরও পড়ুন

অবশ্য কামিন্স কেন একজন ক্রিকেট অধিনায়ক হয়েও এতটা ‘সচেতন’ ক্রিকেটের বাইরের ব্যাপারেও, সে প্রসঙ্গে পরিবারকে নিয়ে বলা তাঁর কথাটি প্রাসঙ্গিক হতে পারে, ‘মা ও বাবা আমাদের সব সময়ই মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন, এ দেশে বাস করতে পারাটা, যে সুযোগ–সুবিধা পাই, সেগুলো পাওয়াটা কতটা ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু এটাও বলতেন, আমরা কতটা ক্ষুদ্র, বিশাল একটা পৃথিবীর কত ছোট অংশ। তাঁরা নিশ্চিত করতে চাইতেন, যাতে আমরা চোখ খোলা রাখি।’

এ বছর যে শুধু সাফল্যেই কেটেছে কামিন্সের, তা নয়। গত মার্চে মাকে হারিয়েছেন। তবে কামিন্স প্রতিদিনই ভাবেন তাঁর কথা, ‘তিনি এ বছরের আগে অনেক সাফল্যই দেখেছেন, আমি যা, সেটির বিশাল অংশজুড়ে আছেন তিনি। আমি নিশ্চিত যে তিনি (বিশ্বকাপ জিততে দেখে) গর্বিত হতেন।’

সমালোচকেরাও এবার তাঁকে নিয়ে গর্বিত হতে পারছেন কি না, সেটি বোঝা কঠিনই। তবে তাতে যে কামিন্সের বয়েই গেছে, সেটিও নিশ্চিতই।